ইউরোপের জানালা- ইউরোপীয় ইউনিয়নের নোবেলপ্রাপ্তির পক্ষে-বিপক্ষে by সরাফ আহমেদ

একসময়ের পররাজ্যলোভী ইউরোপ আজ শান্তি পুরস্কারে জয়ী হয়েছে, এটি বিস্ময়করই বটে। ষাট-সত্তর বছর আগে এই মহাদেশের প্রথম সারির দেশগুলো পরিচিত ছিল সাম্রাজ্যবাদী শক্তি হিসেবে। এশিয়া ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশকে তারা পদানত রেখেছিল।


সেসব দেশের কাঁচামাল দিয়েই ইউরোপ শিল্প বিপ্লব ঘটিয়েছে। এমনকি অতি সম্প্রতি ইরাকসহ বিভিন্ন দেশে সংঘটিত যুদ্ধে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোর সংশ্লিষ্টতাও বিতর্কিত। এ অবস্থায় ইউরোপীয় ইউনিয়নের শান্তিতে নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্তির বিষয়টি অনেকেই মানতে পারেনি।
ঊনবিংশ শতকের শুরু থেকে ইউরোপকে প্রভাবিত করেছে ফরাসি বিপ্লব। ১৮১৫ সালের ভিয়েনা কংগ্রেসের পর থেকেই ইউরোপের বুদ্ধিজীবী, দার্শনিকেরা জনগণের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার আলোচনা শুরু করেন এবং উদ্বুদ্ধ করেন যুদ্ধ আর হানাহানির বিপরীতে গণতন্ত্র, মানবাধিকার আর সহমর্মিতা প্রতিষ্ঠায়। তার পরও ১৯১৪ সালের প্রথম আর ১৯৩৯ সালের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগুনে পুড়েছে সারা ইউরোপ।
এই ইউরোপেরই স্পেন জেনারেল ফ্রান্সিসকোর স্বৈরশাসনে ছিল। ফ্রাঙ্কোর মৃত্যুর তিন বছর পর ১৯৭৮ সালে স্পেনের সংবিধান রচিত হলেও, ১৯৮১ সালে জেনারেল ফ্রাঙ্কোর সমর্থিত সেনাবাহিনী সামরিক অভ্যুত্থানের চেষ্টা চালায়। দক্ষিণ ইউরোপের অপর দুই দেশ পর্তুগাল আর গ্রিসে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এই সেদিন, যথাক্রমে ১৯৭৬ আর ১৯৭৭ সালে। সেনাবাহিনীর আধিপত্য সেখানে এখনো প্রবল।
বিশ্বজুড়ে আধিপত্য, রাজতন্ত্র, যুদ্ধ, স্বৈরশাসন, বিপ্লবী সমাজবাদ আর পুঁজিবাদের উত্থান পতনের কেন্দ্র এই ইউরোপ। আবার গণতন্ত্রকে সুসংহত করে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা এবং অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যে নিরলসভাবে কাজ করে ইউরোপ পৃথিবীতে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে। কেউ ঐতিহ্যকে সঙ্গে নিয়ে, কেউবা দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া থেকে শিক্ষা নিয়েছে। মাত্র তিন দশক আগেও ইউরোপীয় পার্লামেন্টারি গণণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ফিরে আসতে পূর্ব ইউরোপের জাতিসত্তাগুলোকে বিস্তর লড়াই-সংগ্রাম করতে হয়েছে।
নিজেদের মধ্য সংশয় অবিশ্বাসবোধকে পেছনে ফেলে ইউরোপের চার দেশ ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি ও বেলজিয়াম ১৯৫১ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-উত্তর ভেঙে পড়া অর্থনীতি পুনর্নির্মাণে প্যারিসে ইউরোপীয় কয়লা-ইস্পাতগোষ্ঠী গঠন করে। নিজেদের সম্পদ বিনিময়ে লাভবান হয়ে ১৯৫৭ সালে ছয় ইউরোপীয় দেশ মিলে রোমে গঠিত হয় ইউরোপীয় অর্থনীতিক গোষ্ঠী। যুদ্ধকে পরিহার করে সেটাই ছিল এক পথে চলার শান্তিপূর্ণ সূচনা।
অর্থনৈতিক উন্নয়ন ছাড়াও দেশগুলোর জনগণের সার্বিক কল্যাণে এই গোষ্ঠী কাজ করতে থাকে। বারো বছরের মধ্যে সদস্য দেশগুলো নিজেদের মধ্যে শুল্কমুক্ত বাজার অর্থনীতি গড়তে সম্মত হয়। পরিকল্পনামতো ১৯৬৮ সালে শুল্কমুক্ত বাণিজ্য বিনিময় শুরু হয়। অর্থনীতি-বাণিজ্য ছাড়াও সমন্বিত আঞ্চলিক রাজনীতি, জ্বালানি, পরিবেশ ইত্যাদি বিষয়কে সামনে রেখে আবার একটি নতুন চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ইতিমধ্যে যুক্ত হয় আরও চার দেশ। ইউরোপীয় অর্থনৈতিক সংহতি বা একত্রীকরণ এবং অদূর ভবিষ্যতে একটি অভিন্ন মুদ্রাব্যবস্থা গড়ার লক্ষ্যে ১৯৭৯ সালে ইউরোপীয় অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ইএমই প্রতিষ্ঠার চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। সেই একই বছর ইউরোপীয় গোষ্ঠীভুক্ত দেশগুলোকে নিয়ে ইউরোপীয় পার্লামেন্ট ও সদস্যভুক্ত দেশগুলো থেকে জনসংখ্যার ভিত্তিতে পার্লামেন্ট সদস্য নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হয়। ইউরোপীয় পার্লামেন্টের সদর দপ্তর হয় জার্মানি-ফ্রান্স সীমান্তসংলগ্ন ফরাসি শহর স্টার্সবুর্গ।
১৯৮৬ সালে লুক্সেমবার্গের সেনজেন শহরে সদস্য দেশগুলোর নাগরিকদের কেবল জাতীয় পরিচয়পত্রের মাধ্যমে অবাধ ভ্রমণের লক্ষ্যে
নতুন ভিসা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, এই সময় থেকেই উঠে যায় সদস্য দেশগুলোর মধ্যে সীমান্ত প্রহরা ও শুল্ক ফাঁড়ি।
১৯৯২ সালে বারোটি সদস্যভুক্ত দেশের সমন্বিত চেষ্টায় হল্যান্ডের মাসট্রিখটে সম্পাদিত হয় ব্যাপকভিত্তিক সমঝোতা। অভিন্ন মুদ্রাব্যবস্থাসহ শিল্প, শিক্ষা, সংস্কৃতি, স্বাস্থ্য, ভোক্তা অধিকার এবং দরিদ্র দেশগুলোয় উন্নয়ন সহযোগিতা ও বিশ্ব নিরাপত্তা বিষয়ে সমন্বিত কর্মসূচির জন্য একযোগে পরিকল্পনা প্রণীত হয়। এ সময় ইউরোপীয় অর্থনৈতিক গোষ্ঠীর নাম পরিবর্তিত হয়ে নতুন নামকরণ হয় ইউরোপীয় ইউনিয়ন। ইউনিয়নভুক্ত ১৭টি দেশে অভিন্ন মুদ্রাব্যবস্থা ইউরো চালু হয় ২০০২ সালে।
গত প্রায় ৭০ বছরে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্যসংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২৭। সদস্যসংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মহাদেশীয় ঐক্য উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করেছে। আর তাই ৭০ বছর আগের আর এখনকার ইউরোপের আদল অনেকটাই আলাদা। সার্বিকভাবে সদস্য দেশগুলোর নিয়ম-কানুন একই নিয়মে বাঁধার চেষ্টা সাম্প্রতিক ঘটনা। বিশাল অভিন্ন বাজারব্যবস্থায় পণ্য ও সেবা অবাধে চলাচল করতে পারছে। ১৯৮৯ সালে বার্লিনের প্রাচীর পতনের পর পূর্ব ইউরোপের সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোর সঙ্গে শীতল স্নায়ুযুদ্ধের অবসান, পরমাণু যুদ্ধের ঝুঁকি থেকে বের হয়ে আসা এবং পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোর অর্থনীতিকে পুনর্নির্মাণে সহযোগিতার মাধ্যমে ইউরোপীয় সংযুক্তি আরও বেগবান হয়।
নব্বইয়ের দশকে যুগোস্লাভিয়ার যুদ্ধকে কেন্দ্র করে ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে দ্বিধাবিভক্তি এবং ইরাক ও সর্বশেষ লিবিয়ার যুদ্ধকে কেন্দ্র করে প্রকাশ্য মতভেদ দেখা গেছে। ইসরাইল-ফিলিস্তিন রাজনীতি নিয়েও ইউরোপীয় ইউনিয়নের দৃষ্টিভঙ্গি স্বচ্ছ নয়। ইউরোপীয় মানচিত্রে তুরস্কের অবস্থান এবং ন্যাটো জোটের সদস্য হওয়া সত্ত্বেও টালবাহানা করে তুরস্ককে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্যপদ দেওয়া হচ্ছে না। তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী এরদোগান কয়েক বছর আগে বার্লিনে বলেছিলেন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন আদতে একটি খ্রিষ্টান ক্লাব। পূর্ব ইউরোপের অনেক ছোট দেশ ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্যপদ পেলেও তুরস্কের ব্যাপারে বিমাতাসুলভ আচরণ করা হচ্ছে।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের নোবেল শান্তি পুরস্কারপ্রাপ্তিতে ব্রাসেলসে ইউরোপীয় কমিশনের সভাপতি জোসে ম্যানুয়েল ব্যারোসা বলেছেন, এই বিজয় সারা ইউরোপের সব মানুষের। জার্মানির চ্যান্সেলর আঙ্গেলা মেরকেল বলছেন, ‘এটি একটি চমৎকার ঘটনা। ইউরোপীয় ইউনিয়নের বিগত ৬০ বছরের চেতনা সম্মানিত হলো। পাশাপাশি শান্তি, মানবাধিকার আর গণতন্ত্রের পথে আমাদের দায়িত্বটা আরও বেড়ে গেল।’ ইউরোপীয় পার্লামেন্ট ঘৃণার বিপরীতে সহমর্মিতার নিদর্শন হয়ে রইবে। ঐক্যবদ্ধ জার্মানি গড়ার অন্যতম কারিগর ৮২ বছর বয়স্ক সাবেক চ্যান্সেলর হেলমুট কোহল বলেছেন, শান্তির সপক্ষে ইউরোপীয় ইউনিয়নের যে বার্তা, তা এই পুরস্কারপ্রাপ্তিতে আরও বেশি করে স্বীকৃত হলো। ফ্রান্সের সরকারি মাধ্যম বলেছে, ইউরোপীয় ইউনিয়ন দেখিয়েছে যে দীর্ঘ সময় ধরে যাদের মধ্য শত্রুতা বজায় ছিল, তাদের মধ্যে কীভাবে শান্তি ফিরে আসে।
সরাফ আহমেদ: প্রথম আলোর হ্যানোভার (জার্মানি) প্রতিনিধি।
Sharaf.ahmed@gmx.net

No comments

Powered by Blogger.