টক শোতে শাজাহান খান ও মিডিয়া by কাজী মুস্তাফিজ

গত সোমবার মধ্যরাতে আরটিভির একটি টক শোতে বিএনপি নেতা ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়ার চোখ উপড়ে ফেলার হুমকি দেন নৌমন্ত্রী শাজাহান খান । আলোচনার এক পর্যায়ে মন্ত্রী নিজ চেয়ার থেকে ওঠে হাতের আস্তিন গুটিয়ে বিরোধীদলের নেতাকে মারতে উদ্যত হয়ে বলেন, “আমি এর আগেও অনেকের চোখ উপড়ে ফেলেছি, শাজাহান খান সবই পারে।” টক শোর বিষয় ছিল ‘ঈদ-পূজায় নিরাপদে ঘরে ফেরা’।

অনুষ্ঠানটি সরাসরি সম্প্রচার হচ্ছিল। তবে এ ঘটনায় আরটিভি কর্তৃপক্ষ তড়িঘড়ি করে সরাসরি সম্প্রচার সাময়িকভাবে বন্ধ করে দেয়। এ টক শো তেজগাঁও শিল্প এলাকায় আরটিভির নবনির্মিত স্টুডিও থেকে সরাসরি সম্প্রচার হচ্ছিল।
এই ঘটনায় গত দু দিন ধরে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনার সমালোচনার ঝড় বইছে। সরকারের ভেতরে-বাইরে থেকেও সমালোচনার তীরে বিদ্ধ হচ্ছেন এই প্রভাবশালী মন্ত্রী। গণমাধ্যমগুলোও বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে সংবাদ ছাপছে। বৃহস্পতিবার দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিন বিষয়টি নিয়ে লিড নিউজ করেছে। শিরোনাম দিয়েছে ‘ফের বিতর্কে মন্ত্রী শাজাহান খান’।

এছাড়া ঘটনার পর রফিকুল ইসলামের প্রতিক্রিয়াকেও গুরুত্ব দিয়ে সংবাদ ছেপেছে দৈনিক পত্রিকাগুলো। প্রথম আলো’র সপ্তম পৃষ্ঠায় সিঙ্গেল কলামে শিরোনাম- ‘মন্ত্রীরাও সন্ত্রাসী আচরণ শুরু করেছেন।’ একই শিরোনামে ছেপেছে আমার দেশ তৃতীয় পৃষ্ঠায় তিন কলাম। 

বুধবারও এই ঘটনায় ফলাওভাবে সংবাদ ছেপেছে দৈনিকগুলো। ইত্তেফাকের প্রথম পাতায় সিঙ্গেল কলামে শিরোনাম দিয়েছে- ‘টিভি টক শোতে মল্লযুদ্ধ হওয়ার উপক্রম’।আমার দেশের প্রথম পাতায় তিন কলামের বক্স করে শিরোনাম দেয়া হয় ‘টক শোতে ভিন্ন দৃশ্য: হাত থাকতে মুখে কী?’। পত্রিকাটির সম্পাদকীয় পাতায় এই বিষয়ে সিরাজুর রহমানের কলাম ছাপা হয়েছে। শিরোনাম ছিল- ‘ভাষার শালীনতা এবং মন্ত্রিত্বের যোগ্যতা’। কালের কন্ঠের দ্বিতীয় পৃষ্ঠায় দুই কলামের শিরোনাম- ‘টকশোতে নৌমন্ত্রী চোখ তুলে নেয়ার হুমকি দিয়েছেন: ব্যারিস্টার রফিকুল’।

ঘটনার বিস্তারিত
আরটিভির নিয়মিত মধ্যরাতের টক শো 'আওয়ার ডেমোক্রেসি'র অনুষ্ঠানেই সেদিন বৃহৎ পরিসরে অনেকটা গোলটেবিল ধাঁচে আয়োজন করা হয় 'ঈদ-পূজায় নিরাপদে ঘরে ফেরা' শীর্ষক আলোচনা। বক্তব্য শুরু করেন নৌমন্ত্রী মো. শাজাহান খান। নৌপথের উন্নয়নে বর্তমান সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপের কথা বলেন। একপর্যায়ে তিনি বলেন, বিগত জোট সরকারের আমলে নৌপরিবহন খাতের কোনো উন্নয়ন হয়নি। তখন চাঁদাবাজি আর দুর্নীতি হয়েছে এ খাতে। মির্জা আব্বাস ও গয়েশ্বর চন্দ্র রায় টার্মিনালে চাঁদাবাজি করেছেন।

তার এ বক্তব্যের তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ জানিয়ে বিএনপি নেতা সাবেক মন্ত্রী ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া বলেন, 'আমাদের সময় দুর্নীতি আর চাঁদাবাজি হয়েছে, এখন কি এসব বন্ধ হয়ে গেছে? সে সময় বেশি চাঁদাবাজি হয়েছে, নাকি এখন বেশি হচ্ছে- সেই হিসাব দেন। এখন তো লোকজন আপনাদের চোর বলছে।' এ সময় শাজাহান খান কিছুটা উত্তেজিত হয়ে বলেন, 'আপনি চুপ করুন। আমার বলা শেষ হলে আপনি বলবেন।' জবাবে রফিকুল ইসলাম মিয়া বলেন, 'এ অনুষ্ঠানে আমাকে দাওয়াত দেওয়ার সময় বলা হয়েছিল যে, কোনো রকম আক্রমণাত্মক বক্তব্য দেয়া হবে না। কিন্তু এখন দেখছি শুধু আমাদের আমলের বদনাম করা হচ্ছে।'

এ পর্যায়ে উপস্থাপক বলেন, 'জনাব রফিকুল ইসলাম মিয়া, আপনাকে বলার সুযোগ দেওয়া হবে, আপনি তখন বলবেন।' কিন্তু তাতে কর্ণপাত না করে তিনি শাজাহান খানের কথার পিঠে কথা বলে যাচ্ছিলেন। আর এতেই প্রচণ্ড ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন নৌমন্ত্রী। 'আপনি' থেকে হঠাৎ 'তুমি' সম্বোধন শুরু করেন তিনি।

মন্ত্রী উত্তেজিত স্বরে বলেন, 'আপনার কথা বলার অধিকার আছে। আমার কথার মধ্যে কেন বলছেন? রফিক সাহেব, আপনি আমাকে ধমক দিলেন, আমি শুনে গেলাম, এইটা মনে করার কোনো কারণ নেই। আমি শাজাহান খান আপনার চাইতে কোনো অংশে কম নই, এইটা মনে রাইখেন। আপনি বেশি কথা বলবেন না। রফিক সাহেব, আমি শাজাহান খান কাউকে তোয়াক্কা করি না, এইটা মনে রাইখেন। আপনি কী মনে করেছেন? বেয়াদবের মতো কথা বলেন।... বেয়াদবের হাড্ডি।'

পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ায় সঞ্চালক রোবায়েত ফেরদৌস প্রযোজক ও ক্যামেরাম্যানদের উদ্দেশে বলেন, 'বন্ধ করো', 'ব্রেকে যাও', 'বর্তমান প্রজন্ম তাদের কাছে কী শিখছে', 'টকশো বন্ধ করো'। কিন্তু তাতেও থামছিলেন না শাজাহান খান। ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া টেবিল চাপড়ে বলতে থাকেন, 'স্টপ ইট'। অন্যদিকে মন্ত্রী শাজাহান খান চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বিরোধীদলীয় নেতাকে শাসাতে থাকেন। একপর্যায়ে অনুষ্ঠানের অন্যতম আলোচক চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন চেয়ার ছেড়ে টক শো থেকে বেরিয়ে যেতে উদ্যত হন। এ সময় টকশো বন্ধ হয়ে যায়।

কিন্তু তাতেও থামছিলেন না দুই নেতা। চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ান দুজনই। শাজাহান খান হুঙ্কার দিয়ে বলে ওঠেন, 'হারামজাদা, তুমি জানো না একজন মন্ত্রীর সঙ্গে কীভাবে কথা বলতে হয়! তোমাকে আজ জুতাপেটা করব।' মন্ত্রীর এসব কথায় একেবারেই হতভম্ব হয়ে যান রফিকুল ইসলাম মিয়া। তিনি মাথা নিচু করে বেরিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন স্টুডিও থেকে। এ সময় তার দিকে তেড়ে যান মন্ত্রী শাজাহান খান। বলে ওঠেন, 'রফিক, তুমি শাজাহান খানকে চেনো না। আজ, এখন তোমার চোখ তুলে ফেলব। মারামারি করতে চাইলে চলো ফিল্ডে নামি।'

এমন উত্তেজনাকর পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগ দলীয় এমপি ইসরাফিল আলমও নৌমন্ত্রীর পক্ষ নিয়ে ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়াকে বকাঝকা করতে থাকেন। তবে বাকি সবাই নীরবে দেখতে থাকেন সেই দৃশ্য। এমনকি অপর দুই এমপি গোলাম মওলা রনি ও রাশেদা বেগম হীরাও নিজ নিজ আসনে বসে ছিলেন চুপচাপ।

একপর্যায়ে রফিকুল ইসলাম মিয়া স্টুডিও থেকে বেরিয়ে যান। উঠে দাঁড়ান ইলিয়াস কাঞ্চনসহ অন্যরা। কিন্তু আরটিভির স্টাফদের অনুরোধে তারা আবার চেয়ারে বসেন। এ পর্যায়ে রাশেদা বেগম হীরা চেয়ার থেকে উঠে বেরিয়ে যান। এ সময় আওয়ামী লীগের এমপি ইসরাফিল আলম তাকে উদ্দেশ করে বলেন, 'আপনি আবার কোথায় যাচ্ছেন।' জবাবে রাশেদা বেগম হীরা বলেন, 'আমি প্রচণ্ড ভয় পেয়েছি। তাই আর বসতে চাই না।'

কিছুক্ষণ পর দেখা যায়, আরটিভির কর্মকর্তারা ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া ও রাশেদা বেগম হীরাকে আবার স্টুডিওতে ফিরিয়ে এনেছেন। তাদের অংশগ্রহণেই কয়েক মিনিট পর আবার শুরু হয় অনুষ্ঠানটি এবং সরাসরি সম্প্রচার করা হয় বাকি অংশ। টকশোর শেষ অংশের আলোচনায় আর তেমন উত্তাপ-উত্তেজনা ছিল না। অনুষ্ঠান শেষে আরটিভি কর্মীদের অনুরোধে মন্ত্রী শাজাহান খান স্টুডিও থেকে বের হওয়ার পথে হাত মেলান ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়ার সঙ্গে।

মন্ত্রী হওয়ার পর শাজাহান খান বহুবার বিতর্কের সৃষ্টি করলেও এবারের ঘটনাটি যেন পেছনের সব ঘটনাকেই ছাপিয়ে গেছে। পরীক্ষা ছাড়াই সাড়ে ২৭ হাজার ড্রাইভিং লাইসেন্স দেওয়ার জন্য চাপ প্রয়োগ এবং 'গরু-ছাগল চিনতে পারে' এমন চালকদের লাইসেন্স দেওয়ার প্রস্তাব করে গত বছর বিতর্কের সৃষ্টি করে তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েন শাজাহান খান। তার উপস্থিতিতে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের চেয়ারম্যান নায়ক ইলিয়াস কাঞ্চনের ছবি পদদলিত করার ঘটনায় নিন্দার ঝড় উঠলে তিনি দুঃখ প্রকাশ করে বিবৃতি দিয়ে পরিস্থিতি শান্ত করেন।

২০১১ সালের ২ জুন ও ১২ জুলাই দুই দফায় নৌমন্ত্রী ২৭ হাজার ৩৮০ জন অদক্ষ চালককে ভারী ড্রাইভিং লাইসেন্স দেওয়ার সুপারিশ করেন বিআরটিএ'র কাছে। মিডিয়ার বিরুদ্ধে কথা বলেও তিনি বিতর্কে আসেন।

টক শোতে এমন ঘটনার পর বিএনপি সরকার আমলের সাবেক মন্ত্রী ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া বলেছেন, “কোনো সভ্য মানুষ এ ধরনের ভাষায় কথা বলতে পারে না।” তবে মন্ত্রী শাজাহান খান সাংবাদিকদের বলেছেন, “আমি রাগের মাথায় কী বলেছি মনে নেই। উনার অসদাচরণ সহ্যের মাত্রা ছাড়িয়ে গিয়েছিল।”

No comments

Powered by Blogger.