চরাচর-সোনার সন্ধানে আমজাদ by এম হোসেইন

বাবা সোনা পাইছ? জানতে চায় ছোট্ট সোনামণি। সন্ধ্যায় গরম ভাত খেতে খেতে ইয়াসিনের এমন প্রশ্ন তো নিত্যদিনের। জবাবও সেই একটাই। না রে বাপ, আশা আছে, পাইমু একদিন। সেই একদিন আর আসে না আমজাদ-ইয়াসিনের। সূর্য ডোবার খানিক পরই ইয়াসিন ঘুম দেয় বাবার বিছানায়।


বাবা আমজাদ ছেলেকে ঘুম পাড়িয়ে যায় বাজার করতে। দিঘির দক্ষিণেই তো চান্দলা বাজার। কুমিল্লা-মিরপুর সড়কের পূর্বদিকের বড় বাজার। কী আর বাজার করবে। আলু, পেঁয়াজ, লবণ-তরকারি যখন যা মিলে।
রাত পোহালে আবার ছুটে গ্রাম থেকে গ্রামে। পথ চলতে চলতে হাতের ডুগডুগিটা বাজায়। হাঁক দিয়ে চলে- সোনা পড়ছে গো, সোনা? পানিত পড়ছেনি সোনা? পথের পাশের বাড়ি পেলে ঢুঁ মারে ওই বাড়িতে। একই কায়দায় বাড়ির মহিলাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। আপারা, খালারা, পানিতে কি সোনা পড়ছে কারো? তুলে আনবেন সোনা? কত কিলোমিটার পথ চলেন আমজাদ মিয়া? জানতে চাইলে তাৎক্ষণিক জবাব দেন-
পথ চলার কি শেষ আছে ভাইজান?
পশ্চিমে যদি যাই, তাইলে শিদলাই, প্রজাপতি গ্রাম ছেড়ে অন্তত পাঁচ কিলোমিটার। পূর্বদিকে গেলে সাজঘর হয়ে একবারে ভারত সীমান্তবর্তী সালদা নদী পর্যন্ত। সেই পুরনো হাঁক। সোনা পড়ছে গো সোনা?
কোথাও হয়তো কারো জবাব আসে। বলবে, ওই পুকুর কিংবা ওই খালে গোসল করতে গিয়ে হারিয়েছি আমার কানের জিনিস। পারবে কি তুলে আনতে?
আমজাদ মিয়া খুশিমনেই বলবে একবার। দেখাইয়া দেন জায়গাডা।
নেমে পড়বে পানিতে। ডুগডুগি থাকবে, পুকুর কিংবা খালের পাড়ে। হাতে থাকবে ত্রিকোণাকৃতির বিশেষ সরঞ্জাম। ডুব দেবে তাই নিয়ে। ভেসে এসে কাদামাটি আর পাথর নুড়ি ছড়িয়ে দেবে পুকুর পাড়ে। অনুসন্ধান চলবে দীর্ঘক্ষণ। যদি ভাগ্য ভালো হয়, তাইলে পেয়ে যাবে সোনার জিনিস। হাসবে অলংকারের মালিক। তারও হাসি আসবে। কারণ দুই রতি হোক আর দুই ভরি হোক, এক-দশমাংশ থেকে এক-তৃতীয়াংশ পাওনা হবে তাঁর। কিন্তু এমন ভাগ্য কি আর চার-ছয় মাসেও একবার হয়? তার পরও আশায় আশায় পথ চলে আমজাদ। ভাবে, এবার নিশ্চিত বাড়ি যাবে। মা-বাবার কথা মনে পড়ে। স্ত্রীর কথা মনে পড়ে। সবচেয়ে খারাপ লাগে ইয়াসিনের জন্য। ছেলেটাকে এক মাসের কথা বলে ছয় মাস আগে এনেছিল নিজের কাছে। সোনা খুঁজতে বের হলে ছেলেটা ঘরে থাকে একবারে একা। ভাত রান্না করে রেখে আসে ঘরের ভেতর। তাই খায় দুপুরবেলা। আর সারা দিন বাজারে ঘুরে, মাঠে ঘুরে। যখন যা মন চায়, তা-ই করে। খুব খারাপ লাগে ইয়াসিনের জন্য। হাতে পয়সা আসে না। ইয়াসিনও তার মায়ের দেখা পায় না।
কত দূর তাদের বাড়ি। কুমিল্লা থেকে ছাতক। কত দূর হবে রাস্তা? মাইল-কিলোমিটার এত হিসাব বের করা আমজাদের কাজ নয়। তাই ছেলের প্রশ্নেরও জবাব দেন- মাইল দিয়া কী করবি রে বাপ। একবার যদি দান পাইয়া যাই, তাইলেই তোরে তোর মায়ের কাছে দিয়া আমু। কিন্তু আমজাদের ডুগডুগি বাজতে থাকে প্রতিদিনই। পথে পথে ঘুরে আমজাদ। আর সোনার খোঁজাখুঁজি চলে নিত্যদিন। আশা থাকে বাড়ি যাওয়ার, আশা থাকে বড় মেয়েটাকে স্কুলে ভর্তি করানোর, ছোটটাকেও স্কুলে দেওয়ার। সেই সোনার খোঁজ পাবে কবে আমজাদ?
এম হোসেইন

No comments

Powered by Blogger.