অপরাধ স্বীকার করলেন ডেসটিনির চেয়ারম্যান-এমডি by আশরাফ-উল-আলম ও হায়দার আলী

অবশেষে ডেসটিনি গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) রফিকুল আমীন ও ডেসটিনি ২০০০ লিমিটেডের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ হোসাইন তাঁদের অপরাধ স্বীকার করে নিয়েছেন। গতকাল বৃহস্পতিবার প্রতারণা ও অর্থপাচারের দায় স্বীকার করে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন এই দুজন।


আট দিনের রিমান্ড শেষে গতকাল দুজনকে ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হাজির করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। প্রায় এক হাজার ১৭৮ কোটি টাকা আত্মসাৎ ও পাচারের অভিযোগে দায়ের করা মামলায় আট দিন ধরে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা দুজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। গতকাল অষ্টম দিনের মতো জিজ্ঞাসাবাদ শেষে দুজনকে আদালতে হাজির করে ১৬৪ ধারায় তাঁদের স্বীকারোক্তি লিপিবদ্ধ করার আবেদন জানান তদন্ত কর্মকর্তা। প্রায় দুই হাজার ৬০০ কোটি টাকা আত্মসাতের মামলায় তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ৯ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর হয়ে আছে।
গতকাল আদালতে হাজির করার পর চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট বিকাশ কুমার সাহা ডেসটিনি গ্রুপের এমডি রফিকুল আমীনের জবানবন্দি লিপিবদ্ধ করার জন্য মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট সাইফুর রহমানকে ও ডেসটিনি ২০০০-এর চেয়ারম্যান
মোহাম্মদ হোসাইনের জবানবন্দি লিপিবদ্ধ করার জন্য মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট হারুন অর রশীদ দায়িত্ব দেন। আদালত সূত্রে জানা গেছে, দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে দুই আসামিকে দুদক কার্যালয় থেকে আদালতে আনা হয়। এরপর ম্যাজিস্ট্রেটদের খাস কামরায় নেওয়া হয়। এরপর যথেষ্ট সময় দিয়ে বিকেল ৩টার দিকে তাঁদের জবানবন্দি নেওয়া হয়। ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি লিপিবদ্ধ করা হয়।
দুদক ও আদালত সূত্রে জানা গেছে, রফিকুল আমীন ও মোহাম্মদ হোসাইন স্বীকার করেছেন, তাঁরা জনগণের সঙ্গে প্রতারণা করেছেন। ডেসটিনির বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ করা টাকা তাঁরা ওই সব প্রতিষ্ঠান থেকে সরিয়ে নিজেদের নামে-বেনামে বিভিন্ন ব্যাংক অ্যাকাউন্টে জমা রেখেছেন।
দুজন আরো স্বীকার করেন, ডেসটিনি মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ নামের প্রতিষ্ঠানে গ্রাহকদের বিনিয়োগ করা টাকা অর্থাৎ এক হাজার ১৭৮ কোটি টাকার পুরোটাই তাঁরা আত্মসাৎ করেছেন। ডেসটিনির প্রেসিডেন্ট হারুন-অর-রশিদ, এমডি রফিকুল আমীন, ডেসটিনি ২০০০ লিমিটেডের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ হোসাইনসহ এ মামলার অন্য আসামিরা পরস্পর যোগসাজশে ডেসটিনির বিভিন্ন ফান্ড থেকে টাকা সরিয়ে আত্মসাৎ করেছেন। স্বীকারোক্তিতে আরো বলা হয়, সব টাকা তাঁরা ভাগবাটোয়ারা করে নিয়েছেন। মোহাম্মদ হোসাইন স্বীকারোক্তিতে জানিয়েছেন, তাঁর বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। সেখানে তিনি এক কোটি ২০ লাখ টাকা ব্যয় করে বাড়ি তৈরি করেছেন। রফিকুল আমীন জানিয়েছেন, তিনিও আত্মসাৎ করা টাকা দিয়ে বিশাল সম্পত্তির মালিক হয়েছেন। শুধু তারা দুজনই নন, ডেসটিনির অন্যান্য পরিচালকও বিপুল অর্থ সম্পদের মালিক হয়েছেন গ্রাহকদের টাকায়।
সূত্রে আরো জানা যায়, ডেসটিনির ২২ জন পরিচালক, যাঁরা শেয়ারহোল্ডার, তাঁরা নিজেদের মধ্যে অধিকাংশ শেয়ারের লেনদেন, ডেসটিনি মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেডের (ডিএমসিএসএল) মাধ্যমে চড়া সুদে অবৈধ ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনা করেছেন বলেও স্বীকার করেন।
স্বীকারোক্তিতে আরো বলা হয়, ডেসটিনির প্রতিষ্ঠালগ্নে সংঘ স্মারকে কোনো মাল্টিলেভেল মার্কেটিং পদ্ধতির মাধ্যমে ব্যবসা করার প্রবিধান ছিল না। তা সত্ত্বেও ডেসটিনি ২০০০ লিমিটেড কর্তৃপক্ষ বেশ কয়েকটি প্যাকেজ বাজারে ছাড়ে। এর মধ্যে ১০ হাজার টাকার প্যাকেজ থেকে কমিশন হিসেবে কেটে নেওয়া হয় তিন হাজার ৮০০ টাকা। আট হাজার টাকার প্যাকেজ থেকে কেটে নেওয়া চার হাজার ২৬০ টাকা এবং পাঁচ হাজার টাকার প্যাকেজ থেকে কেটে নেওয়া হয় তিন হাজার ৭৫৫ টাকা করে। এটা ছিল অবৈধ।
আসামিরা স্বীকারোক্তিতে আরো জানিয়েছেন, ডেসটিনি প্রতারণামূলকভাবে জনগণের কাছ থেকে টাকা নিয়ে ব্যবসা করেছে- এটা ছিল অন্যায়। তাঁরা ভুল করেছেন। তবে তাঁদের মাত্র ছয় মাস সময় দেওয়া হলে ডেসটিনির ফান্ডে সব টাকা ফেরত দিয়ে দেবেন। একই সঙ্গে গ্রাহকদের টাকাও ফেরত দেবেন।
আদালতে জবানবন্দি দেওয়ার পর রফিকুল আমীন ও মোহাম্মদ হোসাইনকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেওয়া হয়। অন্য মামলায় ঈদের পর তাঁদের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে বলে দুদক সূত্রে জানা গেছে।
গতকাল আদালতে হাজির করার আগে রফিকুল আমীন ও মোহাম্মদ হোসাইনকে অষ্টম দিনের মতো ইন্টারোগেশন সেলে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন। সকাল থেকে তিন ঘণ্টা তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদ করে দুদকের উপপরিচালক বেনজীর আহমেদের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের একটি দল। উল্লেখ্য, গত ১৭ অক্টোবর এমডি রফিকুল আমীন, চেয়ারম্যান মোহাম্মদ হোসাইন ও প্রেসিডেন্ট সাবেক সেনাপ্রধান হারুন-অর-রশিদ দুদকের দুটি মামলায় আদালতে আত্মসমর্পণ করে জামিনের আবেদন করলে আদালত জামিন না দিয়ে তাঁদের জেলহাজতে পাঠান। পরের দিন ১৮ অক্টোবর দুটি মামলায় তাঁদের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করার আবেদন করে দুদক। এরপর দুজনকে ৯ দিন করে মোট ১৮ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালত। অন্যদিকে হারুন-অর-রশিদ অসুস্থ থাকায় তাঁকে আদালতে হাজির করা হয়নি। পরে হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ শর্ত সাপেক্ষে ডেসটিনি গ্রুপের প্রেসিডেন্ট হারুন-অর-রশিদকে দুই মাসের জামিন দেন। দুদকের উপপরিচালক মো. মোজাহার আলী সরদার ও সহকারী পরিচালক মো. তৌফিকুল ইসলাম গত ৩১ জুলাই এ মামলা দুটি দায়ের করেন।

No comments

Powered by Blogger.