অবিশ্রান্ত লেখনী ফেলে চলে গেলেন সুনীল by আবু এন. এম. ওয়াহিদ

আধুনিক বাংলা সাহিত্যে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ছিলেন বিশাল মাপের কীর্তিমান পুরুষ। দুই বাংলায় লেখাপড়া জানা কোনো মানুষের কাছে তাঁর নাম আজ আর অজানা নয়। তিনি এক কিংবদন্তিতুল্য সাহিত্য-ব্যক্তিত্ব।


বাংলা সাহিত্যে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে একটি প্রতিষ্ঠান বললেও ভুল হবে না। কবিতা, উপন্যাস, গল্প, ও নাটক- প্রতিটি ক্ষেত্রে ছিল তাঁর স্বচ্ছন্দ বিচরণ। নিজের লেখালেখির সঙ্গে তিনি সাহিত্য পত্রিকা সম্পাদনাও করেছেন। বহুমুখী প্রতিভাধর এই মানুষটি একজন সাংবাদিকও ছিলেন। জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত পত্রিকায় কলাম লিখে গেছেন। তিনি যে শুধু একজন সার্থক শিল্পী ছিলেন তা-ই নয়, যাঁরা তাঁর সঙ্গে মিশেছেন, তাঁরা জানেন তিনি একজন সাদা মনের বড় মাপের মানুষও ছিলেন। বন্ধুত্বের মর্যাদায় তিনি কারো কাছে কখনো হারেননি। তাঁর জীবন ছিল মানবিক গুণাবলিতে পরিপূর্ণ। সমরেশ মজুমদার তাঁকে সাহিত্যের রাজা বলে অভিহিত করেছেন। রাহাত খান তাঁকে বলেছেন, 'সরল সুন্দর সুনীল', সৈয়দ শামসুল হক সুনীলকে তুলনা করেছেন নক্ষত্রের সঙ্গে। শাকুর মজিদ তাঁকে ও হুমায়ূন আহমেদকে চিত্রায়িত করেছেন বাংলা সাহিত্যের দুই তারকা হিসেবে। বেলাল চৌধুরী তাঁকে আকাশের সঙ্গে তুলনা করে বলেছেন, 'সুনীল আকাশ'।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখা বইয়ের সংখ্যা সব মিলিয়ে প্রায় ২৫০টি। অসামান্য গুণী এই লেখক রেখে গেছেন এক বিশাল সাহিত্যভাণ্ডার। বলতে গেলে এর কোনোটার সঙ্গেই আমার কোনো পরিচয় ছিল না। আর তাই অনেক দিন আগে তাঁকে নিয়ে কথা হচ্ছিল আমার এক বন্ধুর সঙ্গে। বন্ধুটির কাছে প্রশ্ন রেখেছিলাম, 'সুনীলবাবু প্রধানত কবি না ঔপন্যাসিক?' বন্ধু বেশ আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলেছিল, 'অবশ্যই ঔপন্যাসিক।' আমার ধারণাও সে রকমই ছিল। সম্প্রতি আমি ইউটিউবে তাঁর অনেক পুরনো টিভি ইন্টারভিউ দেখেছি ও শুনেছি। এর মধ্যে একটি ছিল কলকাতার স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেল তারা মিউজিকের জনপ্রিয় অনুষ্ঠান বইপড়া-বইপাড়ায় রঞ্জন মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে দেওয়া সাক্ষাৎকার। ওই সাক্ষাৎকারে সুনীলবাবু বলেছিলেন, 'কবি হিসেবে পরিচয় দিতেই আমি বেশি ভালোবাসি।' আমার অনেক দিনের ভুল ভেঙেছিল সেদিন।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় আজ আর নেই। গত ২২ আগস্ট সোমবার রাত ২টায় দুই বাংলার জনপ্রিয় এই কবি ও ঔপন্যাসিক হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে তাঁর কলকাতার ফ্ল্যাট বাড়িতেই মারা গেছেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৮। জন্মসূত্রে তিনি একজন বাংলাদেশি। তিনি জন্মেছিলেন ১৯৩৪ সালের ৭ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশের মাদারীপুর জেলার পূর্ব মাঝিপাড়া গ্রামে। তাঁর বাবা ব্রিটিশ আমলে কলকাতার কোনো এক স্কুলে মাস্টারি করতেন। সেই সুবাদে চার বছর বয়স থেকেই তিনি কলকাতায় বড় হয়েছেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে, ১৯৪২ সালে জাপানিরা যখন কলকাতা শহরে এলোপাতাড়ি বোমা ফেলছিল, তখন তাঁর বাবা তাঁকে ও তাঁর মাকে গ্রামের বাড়িতে রেখে গিয়েছিলেন প্রায় এক বছরের জন্য। তখন কিছুদিনের জন্য তিনি মাদারীপুরের কোনো এক স্কুলেও ভর্তি হয়েছিলেন। বাংলাদেশের প্রতি এই নাড়ির টান সুনীল সারাটা জীবন অনুভব করে গেছেন।
সম্ভবত এ কারণেই তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে আমাদের দিকে বাড়িয়েছিলেন তাঁর সহৃদয় সহযোগিতার হাত। তখন তিনি বাংলাদেশের অনেক কবি-সাহিত্যিককে বিভিন্নভাবে সাহায্য করেছেন। কারো থাকার ব্যবস্থা করেছিলেন। কাউকে অস্থায়ী চাকরি দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। অনেককে কলকাতায় তাঁদের লেখা ছাপানোরও ব্যবস্থা করেছিলেন। শুধু লেখকই নন, তিনি একজন দার্শনিকও ছিলেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হলে এই নবজাত দেশটির সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদে যে ভারতের সুসম্পর্ক হবে না, এ বিষয়ে প্রথম থেকেই তাঁর মনে একটি শঙ্কা কাজ করছিল। বাস্তবে তা হয়েছে বৈকি। পারস্পরিক দেনা-পাওনা, ধর্মের বিভাজন, অবিশ্বাস, সন্দেহ, আর কিছু ঐতিহাসিক কারণে সুনীল মনে করতেন দুই দেশের মধ্যে সুসম্পর্ক হবে না, হলেও সেটা বেশিদিন টিকবে না। লেনদেন নিয়ে বড় ভাইয়ের সঙ্গে ছোট ভাইয়ের সমস্যা সর্বজনীন। এসব কারণে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের সাম্প্রতিক বাংলাদেশ সফরের সময় তিনি ভারত সরকারের উদ্দেশে বলেছিলেন, 'বাংলাদেশ যা চায়, দরকষাকষি না করেই তা-ই দিয়ে দেওয়া উচিত। ছোট ভাইয়ের কাছ থেকে সম্মান পেতে হলে বড় ভাইকে আগে বড় ভাইয়ের মতো উদার আচরণ করতে হয়।' তিনি ভারত-বাংলাদেশ যাতায়াতের ক্ষেত্রে ভিসাপ্রথা তুলে দেওয়ার পক্ষপাতী ছিলেন। তিনি আরো মনে করতেন, ধর্মীয় বিভাজনের কারণে আমরা হয়তোবা কোনো দিনই এক হতে পারব না, তবে শান্তিপ্রিয় পড়শি হিসেবে যুগ যুগ ধরে আমাদের পাশাপাশি থাকতেই হবে। এর কোনো বিকল্প নেই।
তাঁর গ্রামের প্রতিবেশী প্রবাসী আবদুর রাজ্জাক তাঁদের পরিত্যক্ত বাড়িতে একটি লাইব্রেরি বানিয়েছেন। সুনীলবাবু সে লাইব্রেরিতে এক হাজার বই দান করেছিলেন। আবদুর রাজ্জাকের উদ্যোগে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের জন্মদিন অর্থাৎ সেপ্টেম্বরের ৭ তারিখ তাঁর শৈশবের সেই স্মৃতিমাখা বাড়িতে প্রতিবছর সুনীলমেলা বসে। তাঁর সাহিত্যকর্ম ও বাংলাদেশের প্রতি দরদমাখা মনের জন্য এই সৃষ্টিশীল মানুষের ব্যাপারে আমার উৎসাহ ও কৌতূহলের কোনো শেষ ছিল না। আমার যত দূর মনে পড়ে, বেশ কিছুদিন আগে তাঁকে নিয়ে আমি ঢাকার বাংলা কাগজের জন্য একটি কলামও লিখেছিলাম এবং সেটি ছাপাও হয়েছিল। সম্প্রতি আনন্দবাজারে তাঁর একটি ছোট্ট নিবন্ধ বেরিয়েছে। রচনার বিষয়বস্তু, 'মানুষ কেন মানুষ মারে?' মৃত্যুর পর, লেখকের স্মরণে তাঁরই বয়ানের ওপর ভিত্তি করে আমার কিছু প্রতিক্রিয়া নিয়ে আমি একটি কলাম লিখে ঢাকার আরেকটি দৈনিকে পাঠিয়েছি। সম্পাদকের পছন্দ হলে লেখাটি ছাপাও হতে পারে।

লেখক : অধ্যাপক, টেনেসি স্টেট ইউনিভার্সিটি ও এডিটর,
জার্নাল অব ডেভেলপিং এরিয়াজ
awahid2569@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.