সংকট কাটাতে ছুটছেন খালেদা জিয়া by মোশাররফ বাবলু

ভেতরে-বাইরে নানা সংকটে বিএনপি। নির্বাচনকালে নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার পদ্ধতির দাবিসহ বিভিন্ন দাবিতে বারবার কঠোর কর্মসূচি দিয়েও আন্দোলন জমাতে পারছে না দলটি। কর্মসূচিতে মাঠে থাকছেন না সব পর্যায়ের


নেতা-কর্মীরা। মামলা-কোন্দল সামলাতে ব্যস্ত তাঁরা। এ ছাড়া প্রতিবেশী দেশ ভারত এবং এশিয়ার বৃহৎ শক্তি চীনের সঙ্গে সম্পর্কের টানাপড়েন আগামী নির্বাচনে বিএনপির জয়লাভের পথে কাঁটা হয়ে আছে। প্রভাবশালী এ দুই দেশের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের বিষয়টিকে তাই সর্বোচ্চ গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছেন দলীয় প্রধান খালেদা জিয়া। এরই মধ্যে তিনি চীন সফর করে এসেছেন। এক সপ্তাহের সফরে তিনি ভারতে যাচ্ছেন আগামী রবিবার।
বিরোধীদলীয় নেতা ও বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার আসন্ন ভারত সফরকে খুবই গুরুত্বের সঙ্গে দেখছেন বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা। তাঁরা মনে করছেন, এ সফরের মধ্য দিয়ে ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে উঠলে আগামী দিনগুলোতে বিএনপির রাজনীতিতেও নতুন গতি আসবে।
জানা গেছে, নির্বাচন সামনে রেখে বিএনপির কৌশল কী হবে, সেটা ঠিক হবে খালেদা জিয়া ভারত থেকে ফেরার পর। বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন করছে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোট। কিন্তু এ দাবি ও আন্দোলন আমলে নিচ্ছে না ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। আবার সরকারকে দাবি মানতে বাধ্য করার মতো জোরদার আন্দোলনও গড়ে তুলতে পারছে না বিরোধী দল। বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান দীর্ঘদিন ধরে অবস্থান করছেন বিদেশে। পলাতক আছেন দলের একসময়ের প্রভাবশালী নেতা হারিছ চৌধুরী। বিএনপি-জামায়াত জোট আমলের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর একাধিক মামলায় কারাবন্দি। জোটের প্রধান শরিক দল জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষস্থানীয় নেতারা কারাগারে আছেন একাত্তরে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায়। দলটির অন্য নেতারাও মামলার আতঙ্কে ভুগছেন। এর বাইরে জোটের বেশির ভাগ দলই নাম ও সাইনবোর্ডসর্বস্ব। এ অবস্থায় নির্বাচনকালে নির্দলীয় সরকার পদ্ধতির দাবির প্রতি সমর্থন আদায়ে প্রভাবশালী দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের জোর চেষ্টা চালাচ্ছে বিএনপি।
বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রভাবশালী দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের পাশাপাশি দলের ভেতরের সংকট কাটাতে নানামুখী উদ্যোগ নিয়েছেন দলীয় চেয়ারপারসন। নিজে বিভিন্ন দেশ সফর করা ছাড়াও দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবসহ জ্যেষ্ঠ নেতাদের দেশি-বিদেশি কূটনীতিকদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখার দায়িত্ব দিয়েছেন তিনি।
দলের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের এক নেতা কালের কণ্ঠকে বলেন, নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে আগামী নির্বাচন আদায়ের দাবিতে অনড় বিএনপি। কূটনীতিকরাও বলেছেন, বড় দুই দলের সংলাপের মাধ্যমে রাজনীতিতে সমঝোতা প্রয়োজন। এ অবস্থায় বাংলাদেশের রাজনীতিতে যেসব দেশ প্রভাব বিস্তার করছে সেসব দেশের সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করছে বিএনপি। বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকদের সঙ্গেও প্রতিনিয়ত বৈঠক করছেন বিএনপির নেতারা।
নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালে তাইওয়ানে বাণিজ্যিক অফিস খোলার কারণে নাখোশ হয়েছিল চীন। চীনের সেই অসন্তুষ্টি দূর করে সম্পর্ক জোরদার করার চেষ্টা চালাচ্ছেন খালেদা জিয়া।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, সারা বিশ্বে অর্থনৈতিক দিক দিয়ে অগ্রসরমান ভারত। এসব বিবেচনায় রেখে ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তুলেছে যুক্তরাষ্ট্র। চীনও ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টা চালাচ্ছে। অন্যদিকে কিছু ঘটনায় কয়েক বছর আগে প্রতিবেশী দেশটির সঙ্গে সম্পর্কে টানাপড়েন দেখা দেয় বিএনপির। বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালে ২০০৪ সালে চট্টগ্রামে ১০ ট্রাক অস্ত্রের যে চালান ধরা পড়েছিল, সেই অস্ত্র ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীর জন্য আনা হয়েছিল বলে অভিযোগ আছে। ২০০৬ সালে প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে খালেদা জিয়া ভারত সফর করেছিলেন। বিশ্লেষকদের মতে, তখন ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টা করেও সফল হননি খালেদা জিয়া। আগামী দিনেও বিএনপি ক্ষমতায় গেলে বাংলাদেশে ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী গ্রুপের সক্রিয় হয়ে ওঠা নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে নয়াদিল্লির।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, বিএনপিকে নিয়ে নয়াদিল্লির উদ্বেগ নিরসন করার মিশন নিয়েই ভারত সফরে যাচ্ছেন খালেদা জিয়া। বিরোধী দলের নেতা হিসেবে এটাই হবে তাঁর প্রথম ভারত সফর। তিনি এবার নতুন করে সম্পর্ক গড়ার উদ্যোগ নিচ্ছেন।
আগামী রবিবার সকালে ঢাকা ত্যাগ করবেন বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া। তাঁর সফরসঙ্গী হিসেবে থাকছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য তরিকুল ইসলাম, ভাইস চেয়ারম্যান শমসের মবিন চৌধুরী, সেলিমা রহমান, বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা রিয়াজ রহমান, সাবিহউদ্দিন আহমেদ, প্রেসসচিব মারুফ কামাল খান সোহেল প্রমুখ। তাঁদের ৩ নভেম্বর ঢাকায় ফিরে আসার কথা রয়েছে।
এদিকে রবিবার নয়াদিল্লি গিয়েই ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন খালেদা জিয়া। এরপর তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং, ক্ষমতাসীন দল কংগ্রেসের সভাপতি সোনিয়া গান্ধী, জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা শিব শংকর মেনন এবং লোকসভায় বিরোধীদলীয় নেত্রী বিজেপির সুষমা স্বরাজের সঙ্গে বৈঠক করবেন। ভারত-বাংলাদেশ দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক বিষয়ে একটি সেমিনারেও ভাষণ দেবেন বিএনপির চেয়ারপারসন।
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শমসের মবিন চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, বিরোধীদলীয় নেতার ভারত সফর খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই সফরের মধ্য দিয়ে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক আরো সুদৃঢ় হবে।
বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা সাবিহউদ্দিন আহমেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ভারত সফরে বাংলাদেশের সঙ্গে অমীমাংসিত বিষয় নিয়ে আলোচনা হবে।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে ঢাকা সফরকালে খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং তাঁকে ভারত সফরের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। পরে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস এম কৃষ্ণ ও অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখার্জি (বর্তমানে রাষ্ট্রপতি) বাংলাদেশ সফরে এসে খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং তাঁকে সফরের আমন্ত্রণ জানান।

No comments

Powered by Blogger.