'এর চেয়ে বাসের ছাদে যাওয়াই ভালো'

রিকশাচালক আমজাদ কুষ্টিয়া যাবেন বউ-ছেলে-মেয়ের সঙ্গে ঈদ করতে। সকাল ৯টা থেকে ঘুরছিলেন গাবতলী বাস টার্মিনালের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত। কিন্তু সাড়ে ৪০০ টাকার নিচে কেউ তাঁকে টিকিট দিল না। অবশেষে দুপুর দেড়টার দিকে সিদ্ধান্ত নিলেন ভেঙে ভেঙে যাবেন। পাটুরিয়ার দিকে ছেড়ে যাওয়া লোকাল বাসগুলোর ভাড়াও ২০০ টাকা।


তবে ছাদে মাত্র ৫০ টাকা। আমজাদ বললেন, 'ভালোভাবে যেতে হলে আমার এক দিনের কামাই চলে যাবে। এর চেয়ে বাসের ছাদে যাওয়াই ভালো। আল্লাই রক্ষা করবেন।'
আমজাদের মতো নিম্ন আয়ের অনেক মানুষই বাস-ট্রেনের ছাদে ঝুলে বাড়ির পথে পাড়ি জমান। কাওরানবাজার ও আমিনবাজার থেকে ট্রাকেও যাত্রী তুলতে দেখা গেছে। গরুসহ বিভিন্ন মালপত্র নিয়ে যেসব ট্রাক ঢাকায় এসেছিল সেগুলো ফিরতি পথে যাত্রী তুলে নিয়ে গেছে। নিম্ন আয়ের মানুষ কম টাকায় ট্রাকে চেপে বসেন। গতকাল বৃহস্পতিবারও বাস, ট্রেন ও লঞ্চে ছিল উপচেপড়া ভিড়। শেষ মুহূর্তে ঘরমুখো মানুষের ঢল নেমেছিল টার্মিনালগুলোতে। বেলা যতই গড়াচ্ছিল, ভিড় ততই বাড়ছিল। ঈদের আগে গতকাল শেষ অফিস থাকলেও সবাই কোনোরকমে অফিসে ঢুকেই বেরিয়ে গেছেন। রাজধানীর চেহারাও ফাঁকা ফাঁকা। নগরীর যানজটও চোখে পড়েনি। কিন্তু টার্মিনালে এসে যাত্রীদের অপেক্ষারও বিকল্প ছিল না।
তবে গতকাল সকাল থেকেই একটি সুখবর শোনা যাচ্ছিল। তা হচ্ছে অধিকাংশ রুটেই যানজট কমেছে। ঢাকা-টাঙ্গাইলের ভয়াবহ যানজট কিছুটা কমেছে। পাটুরিয়া-দৌলতদিয়ায় গাড়ির চাপও খুব বেশি ছিল না। তবে ২০০-৩০০ গাড়ির সিরিয়াল থাকছে। ঈদে গাড়ির সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় এই সিরিয়াল স্বাভাবিক বলেই জানান সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটে আগের চেয়ে গাড়ির চাপ কমেছে, গতি বেড়েছে। ঢাকা-ময়মনসিংহ রুটে মহাসড়কের পাশে বিভিন্ন গরুর হাট থাকায় মাঝেমধ্যেই গাড়ির চাকা থেমে গেছে। গাবতলী ও আমিনবাজারে গরুর হাটের জন্য গাড়ি বেরোতে বেশ বেগ পেতে হয়।
গাবতলী গিয়ে বেশ কিছু ভিন্ন দৃশ্যও চোখে পড়ল। অগ্রিম টিকিট বিক্রি শুরুর এক-দুই দিন পর থেকেই কাউন্টার থেকে জানানো হয়েছিল, টিকিট শেষ। অধিকাংশ কাউন্টারের সামনেই এখনো লেখা আছে ২৫ ও ২৬ তারিখের টিকিট নেই। অথচ গতকাল প্রায় সব কাউন্টার থেকেই টিকিট বিক্রি হয়েছে। তবে তা উচ্চ মূল্যে।
খুলনা ও বাগেরহাটের ঈগল পরিবহনের ১২টার টিকিট কেটে বসে ছিলেন ফরহাদ হোসেন। তিনি বলেন, 'সকাল ৯টায় এসেছি। এর আগে কোনো টিকিট পেলাম না। গাড়ি এসেছে সাড়ে ১২টায়। কাউন্টার থেকে বলেছে, একটার দিকে ছেড়ে যাবে।' হানিফ পরিবহনের কাউন্টার মাস্টার গাজী নজরুল বলেন, 'এখন অবস্থা ভালো। মূলত গরুর ট্রাক পারাপার বন্ধ হওয়ায় যানজটের উন্নতি হয়েছে। ঘাট কনট্রোল করতে পারলে আমাদের খুব একটা সমস্যা হবে না।'
সায়েদাবাদ টার্মিনালে দেখা গেছে, অনেকেই ব্যাগ, বাক্স-পেটরা নিয়ে অপেক্ষা করছেন। গাড়ি ছাড়তে খুব দেরি না হলেও টিকিট পেতে সমস্যা হচ্ছে। ৯টায় এলেও দুপুর ১২টা-১টার আগে টিকিট পাওয়া যায়নি। ময়মনসিংহে যাওয়ার উদ্দেশ্যে এনা পরিবহনের টিকিট কেটে অপেক্ষারত যাত্রী ইয়াসমিন আক্তার বলেন, 'খুব বেশি একটা সমস্যা হচ্ছে না। সবার সঙ্গে ঈদ করার আনন্দই আলাদা। এখন পথে খুব একটা যানজট না পেলেই হয়। তবে অন্যবারের মতো এবার ভিড় দেখা যাচ্ছে না।' ঢাকা-টাঙ্গাইল রুটের বেশ কিছু স্পিডব্রেকার ভেঙে ফেলায় এবং বঙ্গবন্ধু সেতুর যানজট কমে যাওয়ায় এ রুটেও নির্বিঘ্নে গাড়ি চলাচল করছে।
ঢাকা-চট্টগ্রাম-নোয়াখালী রুটেও যানজট অনেকটা নিয়ন্ত্রণে চলে এসেছে। ব্যাংক কর্মকর্তা রেজাউল করিম রায়হান ইকোনো সার্ভিসের ৩টার টিকিট কেটেছিলেন। গাড়ি ছাড়ে সাড়ে ৩টায়। তিনি গতকাল বিকেল সোয়া ৫টায় পৌঁছান কুমিল্লার দাউদকান্দিতে। তিনি মোবাইল ফোনে এই প্রতিবেদককে বলেন, 'তেমন কোনো ভোগান্তি হয়নি। যাত্রাবাড়িতে হালকা যানজট ছিল। এ ছাড়া পথে যা হয়েছে ঈদের সময় তা স্বাভাবিকই।'
রেলে উপচেপড়া ভিড় : গতকাল বিকেলে ঢাকা-নীলফামারীর নীল সাগর এঙ্প্রেস বিমানবন্দর রেলওয়ে স্টেশনে আসার পর শুরু হয়ে যায় প্রতিযোগিতা- কার আগে কে উঠবে। অনেকেই মালপত্র রেখেই আগে ভেতরে ঢুকে যান। তারপর অন্য কারো সাহায্যে জানালা দিয়ে মালপত্র তুলে নেন। ট্রেন বোঝাই হওয়ার পর শুরু হয় ছাদে ওঠা। সামনে বা পাশের রেলিং ধরেও অনেকেই ট্রেন যাত্রা করছেন। এমনকি মহিলারাও ছাদে উঠছেন। কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনের চেয়ে বিমানবন্দর স্টেশনেই ভিড় বেশি লক্ষ করা গেল।
কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন ম্যানেজার মো. খায়রুল বশির বলেন, 'এবার আমরা সফল। সব ট্রেনই যথাসময়ে ছাড়তে পেরেছি।'
লঞ্চে ভিড় বেড়েছে : অন্যান্য দিনের চেয়ে গতকাল লঞ্চের ভিড় অনেক বেশিই দেখা যায়। লঞ্চের সংখ্যা বাড়ায় যাত্রীর চাপ গত ঈদের তুলনায় কিছুটা হলেও কমেছে। তবে লঞ্চের কোনো কেবিনের টিকিট গতকাল পাওয়া যায়নি। এগুলো আগে থেকেই বিক্রি হয়ে গেছে বলে জানানো হয় কাউন্টার থেকে। বিকেল ৪টা পর্যন্ত ৩৭টি লঞ্চ ছেড়ে গেছে এবং সন্ধ্যা নাগাদ আরো ৩০টি লঞ্চ ছেড়ে যাবে বলে জানা যায়। সদরঘাটে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক নিরাপত্তাকর্মীর তৎপরতাও চোখে পড়ল।

No comments

Powered by Blogger.