ঢাকা মহানগরীতে দেড় লাখ কোটি টাকার সরকারী জমি বেহাত- মহানগর জরিপে বেদখল ভূমি উদ্ধারের নির্দেশ ডিসিকে by ফিরোজ মান্না

মহানগর জরিপে বেদখল হওয়া ভূমি উদ্ধারের জন্য ঢাকার ডিসিকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। একইসঙ্গে জরিপ অধিফতরে জড়িত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতেও বলেছে ভূমি মন্ত্রণালয়। বেদখল কাজে জড়িত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের চিহ্নিত করার জন্য দুটি কমিটি করা হয়েছে।


এই কমিটি কাজ শুরু করার পরই একজন সেটেলমেন্ট অফিসার হাইকোর্টে একটি রিট মামলা দায়ের করেন। কোর্ট চার মাসের জন্য এ বিষয়ে কার্যক্রম স্থগিত করার নির্দেশ দিয়েছে। ডিসি অফিস এসি ল্যান্ডের মাধ্যমে বেদখল হয়ে যাওয়া জমির সন্ধান করছে। বেদখল হয়ে যাওয়া জমির একটি তালিকা করে ভূমি মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়া হবে। পরে ওই জমি কিভাবে উদ্ধার করা যায় সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। তবে এই তালিকা তৈরির কাজটি সময়সাপেক্ষ বলে মনে করছে মন্ত্রণালয়।
ভূমি মন্ত্রণালযের সচিব মোঃ মোখলেছুর রহমান জনকণ্ঠকে জানান, সরকারী জমি উদ্ধারের জন্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে সবধরনের ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। ঢাকার ডিসিকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। সেখান থেকে রিপোর্ট এলেই ব্যবস্থা নেয়া শুরু হবে। হাজার হাজার কোটি টাকার সরকারী সম্পত্তি কোনভাবেই বেহাত হতে দেয়া হবে না। একইভাবে ভূমি অধিদফতরের ডিজিকেও জরিপ কাজের সঙ্গে জড়িত অসাধু কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছে। মহানগর জরিপে ২ হাজার ৮শ’ একরের বেশি জমি বেহাত হয়ে গেছে। মোট ১৯১টি মৌজায় এই জমিগুলো বেদখল হয়ে গেছে। জরিপ অধিদফতরের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সহযোগিতায় বিরাট অঙ্কের টাকার জমি সরকারের হাতছাড়া হয়েছে।
জরিপ অধিদফতরের ডিজি মোঃ আব্দুল মান্নান জনকণ্ঠকে বলেন, দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা জরিপ কাজে সরকারের বিপুল পরিমাণ সম্পত্তি হাতছাড়া হয়। এখন এগুলো উদ্ধারের বিষয়ে দুটি কমিটি করা হয়েছে। বেদখলকারীদের সহযোগিতাকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের শনাক্ত করাও কঠিন হয়ে পড়েছে। ভূমি রক্ষা টাস্কফোর্স ও নদী রক্ষা টাস্কফোর্সের দেয়া চিঠির ভিত্তিতে ছয় মাস আগেই আমরা দুটি কমিটি করি। ঈদের আগে ভূমি মন্ত্রণালয় থেকে আরেকটি চিঠি আমাদের দেয়া হয়। এর মধ্যেই একজন সেটেলমেন্ট অফিসার জড়িত কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের পক্ষে আদালতে একটি রিট দাখিল করেন। ওই রিটে বলা হয়েছে, চার মাসের মধ্যে সন্দেহভাজন কোন কর্মকর্তা ও কর্মচারীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া যাবে না। এখন আমরা আমাদের প্যানেল ল-ইয়ার দিয়ে মামলাটি খারিজ করার চেষ্টা করছি। মামলাটি খারিজ হওয়ার পরই জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। যদিও এটি একটি জটিল প্রক্রিয়া। অনেক সময়ের ব্যাপার। এরপরও সরকারী জমি দখলমুক্ত করতে আমাদের কার্যক্রম চলবে।
এ বিষয়ে ঢাকার ডিসির সঙ্গে টেলিফোনে বার বার কথা বলার চেষ্টা করেও সম্ভব হয়নি। তবে ডিসি অফিসের এক কর্মকর্তা জানান, ভূমি মন্ত্রণালয় থেকে একটি চিঠি দেয়া হয়েছে মহানগর জরিপে বেদখল হওয়া জমির তালিকা তৈরির জন্য। বিষয়টি নিয়ে কাজ চলছে। কাজটি করতে অনেক সময় লাগবে বলে ওই কর্মকর্তা মন্তব্য করেন। কারণ দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে চলে আসা জরিপের ভুলত্রুটি এক দেড় বছরের মধ্যে কিছুতেই শেষ করা সম্ভব হবে না।
সূত্র জানিয়েছে, ভূমি মন্ত্রণালয়ের সচিবের কাছে এ মাসের গোড়ার দিকে সরকারী সম্পত্তি বেদখলের তদন্ত রিপোর্ট জমা দিয়েছে তদন্ত কমিটি। ঢাকা মহানগর চূড়ান্ত জরিপে ২ হাজার ৮১৫ দশমিক শূন্য ৫৬৯ একর সরকারী জমি বেহাত হওয়ার প্রমাণ পেয়েছেন তাঁরা। এ ঘটনার কারণে ১৫ বছর ধরে চলা ঢাকা মহানগরীর ১৯১টি মৌজার চূড়ান্ত জরিপ বাতিল ও সরকারী সম্পত্তি উদ্ধারের বিষয়ে সুপারিশ করেছে তদন্ত কমিটি। ভূমি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মোয়েজ্জদ্দীনের নেতৃত্বে গঠিত ছয় সদস্যের কমিটি ভূমি মন্ত্রণালয়ের সচিব মোখলেছুর রহমানের কাছে রিপোর্ট জমা দিয়েছে। তদন্ত রিপোর্টের আলোকে বৈঠকে ভূমি মন্ত্রণালয় সরকারী জমি উদ্ধারের ব্যবস্থা নিয়েছে।
ভূমি মন্ত্রণালয়ের এক উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তা বলেন, দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে যে জমি ব্যক্তিবিশেষ মালিকানা দাবি নিয়ে বসে আছে, তাদের কাছ থেকে কোনভাবেই এই জমি উদ্ধার করা সম্ভব হবে না। যদি কোন প্রতিষ্ঠান জমি দখল করে থাকে তাহলে ওই সব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে লোক দেখানো ব্যবস্থা নেয়া হতে পারে। এর চেয়ে বেশিকিছু আশা করা যায় না বেদখল হয়ে যাওয়া জমি নিয়ে। কারণ বেশিরভাগ জমিই প্রভাবশালীদের হাতে চলে গেছে। এই জমি উদ্ধার করতে গেলেই হাজার হাজার মামলা হবে। এসব মামলা যুগের পর যুগ চলতে থাকবে। সরকারের পক্ষে এত মামলা মোকাবেলা করা কঠিন হয়ে পড়বে। এই জমি উদ্ধারের বিষয়টি আসলে কত দূর আগাতে পারবে ভূমি মন্ত্রণালয় তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দিহান।
ঢাকা মহানগরীর জরিপ কর্মসূচীর আওতায় চূড়ান্তভাবে প্রকাশিত ১৯১ মৌজার জরিপ কার্যক্রম বহাল বা বাতিলের সুপারিশের জন্য ভূমি মন্ত্রণালয় ২৭ জুলাই একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। এই কমিটি সাতদিনের মাথায় ভূমি সচিবের কাছে রিপোর্ট জমা দিয়েছে বলে খবর মিলেছে। কমিটিতে ভূমি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিবকে আহ্বায়ক করা হয়। সদস্য করা হয়েছিল যুগ্ম সচিব (আইন), পরিচালক (ভূমি রেকর্ড), ভূমি সংস্কার বোর্ডের এক কর্মকর্তা, অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (রাজস্ব- ঢাকা), অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব-ঢাকা), কমিটির সদস্য সচিব করা হয়েছে উপসচিব (আইন) ভূমি মন্ত্রণালয়। তদন্ত কমিটি কতিপয় খতিয়ান ব্যতীত মৌজা রেকর্ড চূড়ান্তভাবে প্রকাশ করা সঠিক ছিল কি না, তড়িঘড়ি করে রেকর্ড প্রদানের কারণ নির্ণয় এবং এর দায়দয়িত্ব নিরূপণ, মহানগর জরিপে বেহাত হওয়া সরকারী সম্পত্তির পরিমাণ নির্ণয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের দায়দায়িত্ব নিরূপণ ও বেহাত হওয়া সম্পত্তি উদ্ধারের বিষয়ে সুপারিশ প্রণয়ন, সার্বিকভাবে মহানগর জরিপ বহাল বা বাতিলের বিষয়ে কিছু সুপারিশ করেছে।
কমিটি কোতোয়ালি সার্কেলে ১৪টি মৌজায় ২৬ দশমিক ১৬২০ একর, তেজগাঁও সার্কেলে ৬৩ মৌজায় এক হাজার ১০ দশমিক ৫৪৮০ একর, ডেমরা সার্কেলের ৪৯টি মৌজায় ৫৪৭ দশমিক ৯৫৭৬ একর, ধানম-ি সার্কেলের ২৮টি মৌজায় ২৫৮ দশমিক ৯৫৭৬ একর ও মিরপুর সার্কেলের ৩৭টি মৌজায় ৯৭১ দশমিক ৮৬২৯ একর সরকারী জমি বেদখলের প্রমাণ পেয়েছে। এতে মোট জমির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৮১৫ দশমিক শূন্য ৫৬৯ একর। ঢাকা মহাগনরীতে বর্তমানে প্রতিকাঠা জমির গড়মূল্য ১ কোটি টাকা ধরা হলেও এই হিসাবে ২ হাজার ৮১৫ একর জমির মূল্য দাঁড়ায় এক লাখ ৬৮ হাজার ৯শ’ কোটি টাকা।
ভূমি মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, বিশাল অঙ্কের টাকার সম্পত্তি জরিপ অধিদফতরের কতিপয় অসৎ কর্মকর্তা ও কর্মচারীর যোগসাজশে প্রভাবশালীরা নিয়ে গেছে। টানা ১৫ বছর ধরে চলা জরিপ কাজ চূড়ান্ত গেজেট প্রকাশের পর এই জালিয়াতি ধরা পড়েছে। বিপুল পরিমাণ সরকারী সম্পত্তি উদ্ধারের জন্য চূড়ান্ত জরিপ কাজ বাতিল করা হতে পারে। বিপুল পরিমাণ জমি ব্যক্তিমালিকানায় রেকর্ড হয়েছে।
উল্লেখ্য, মহানগর জরিপের চূড়ান্ত পর্যায়ের রেকর্ড প্রিন্ট করার পর প্রজাস্বত্ব বিধিমালার বিধি ৪২-এর বিধান মোতাবেক ৯৫ হাজার খতিয়ানের ওপর শুনানি করে সংশোধনের আদেশ দেয়া হয়েছে। ১৯১টি মৌজার রেকর্ডসমূহের গেজেট প্রকাশ করার পর ১নং রেজিস্টারসমূহ রেকর্ডরুমে সংরক্ষিত ছিল। পরবর্তীতে মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে ২০১১ সালের ১ জানুয়ারি মহানগর রেকর্ডের ওপর নামজারিসহ অন্যান্য কার্যক্রম শুরু হয়। জেলা রেকর্ডরুমে কর্র্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারী, সহকারী কমিশনার (ভূমি) ভূমি সহকারী কর্মকর্তাদের কাছ থেকে বিভিন্ন রকম অভিযোগ আসে। আবার ভূমি মালিকরা মহানগর জরিপে তাঁদের কাক্সিক্ষত খতিয়ান খুঁজে পাচ্ছিলেন না। খতিয়ানে নামের বানান ভুল, দাগ ও জমির পরিমাণে কম-বেশি, জাল খতিয়ান, খতিয়ানের পৃষ্ঠা ফাঁকা থাকার বিষয়ে কয়েক হাজার অভিযোগ জমা পড়েছে। সহকারী কমিশনার (ভূমি), আরএস রেকর্ডে সরকারী স্বার্থসংশ্লিষ্ট সরকারী জমি মহানগর রেকর্ডে বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নামে রেকর্ডের অভিযোগ পাওয়া যায়। এ অবস্থায় ভূমি মন্ত্রণালয় মহানগর জরিপের ৫টি সার্কেলের সহকারী কমিশনারদের বেহাত হওয়া জমির তালিকা তৈরি করার নির্দেশ দেয়। রাজধানীর ৫টি সার্কেলে ২ হাজার ৮১৫ দশমিক শূন্য ৫৬৯ একর জমি বেহাত হয়ে যাওয়ার প্রমাণ পান।

No comments

Powered by Blogger.