বি দ্যু ত বো ল্ট by মোঃ মামুন রশীদ

ক্ষিপ্র চিতা কিংবা হিংস্র বাঘ শিকার ধরার আগে একটি হুঙ্কার ছাড়ে। পৃথিবীর বুকে সবচেয়ে গতির লড়াই সম্ভবত একটি ক্ষুধার্ত বাঘ আর একটি প্রাণভয়ে পলায়নপর হরিণের ভেতরেই হয়। সেটি তো আর বনে ঘাপটি মেরে বসে থেকে পুরোপুরি দেখা সম্ভব নয়।


তবে ওই ব্যবস্থা করা হয়েছিল এবার লন্ডন অলিম্পিকেই। হয়ত ক্ষিপ্র চিতা কিংবা হরিণের ভেতর নয়। যাঁরা লড়েছেন তাঁরা মানবকুলের ভেতর সবচেয়ে বেশি গতিধর। আর দূরত্বটা যদি হয় মাত্র ১০০ মিটার, তাহলে তো কথাই নেই। চোখের কয়েকটি পলক ফেলা আর দুয়েকবার নিশ্বাস ফেলা বন্ধ রাখলেই শেষ হয়ে যাবে দূরত্বটুকু। নতুবা যনি স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে চাইবেন কিংবা পলক ফেলবেন মুহূর্তেই কোন একজনকে বিজয় উদযাপন আর কয়েকজন প্রতিযোগীকে হতাশায় মুষড়ে পড়তে। স্বাভাবিকভাবে হয়ত চিন্তা করা যায় না, কিন্তু বিস্ময়করভাবে সত্য লড়াইটা মাত্র ১০ সেকেন্ডেরও কম সময়ের। যার দিকে বিশ্ববাসীর চোখ সেই জ্যামাইকান স্প্রিন্টার উসাইন বোল্ট ইতোমধ্যেই বিশ্বরেকর্ড সৃষ্টি করে মাত্র ৯.৫৮ সেকেন্ডে ১০০ মিটার শেষ করে বিনামেঘে বজ্রপাতই ঘটিয়েছিলেন। এবারও স্বর্ণ তাঁর অবশ্যই দরকারী ছিল। তাই লড়াইয়ে নামার আগেই হুঙ্কার দিয়েছিলেন বিশ্বের দ্রুততম এই মানব। অস্বাভাবিক দ্রুততার জন্যই তাঁর বিশ্বব্যাপী পরিচিতি হয়েছে ‘বিদ্যুৎ’ বোল্ট নামে। সেটা লন্ডন অলিম্পিকে আরেকবার প্রমাণ করেছেন ‘ট্রিপল-ট্রিপল’-এর অভাবনীয় কীর্তি গড়ে।
দৌড়ের দুনিয়ায় অলিম্পিক ইতিহাসে সেরা কীর্তিগাথা রচনা করেছেন আগেই। বেজিংয়ের ন্যায় লন্ডনেও ১০০ ও ২০০ মিটার স্প্রিন্টে স্বর্ণপদক জিতে ডাবল জয়ের অনন্য দৃষ্টান্তও স্থাপন করেন বোল্ট। ১০০ মিটারে নিজের গড়া আগের রেকর্ড (৯.৬৯) ভেঙ্গে নতুন রেকর্ডের জন্ম দেন বোল্ট। ৯.৬৩ সেকেন্ড সময় নিয়ে জেতেন ১০০ মিটারের স্বর্ণ। আর ২০০ মিটার স্প্রিন্টে বাজিমাত করেন ১৯.৩২ সেকেন্ড সময় নিয়ে। এরপরই বোল্টকে জীবন্ত কিংবদন্তি হিসেবে মেনে নিয়েছেন সবাই। অবলীলায় সবাইকে পেছনে ফেলে ইতিহাসের সাক্ষী হলেও গতিদানবের মনের কোণে হয়ত কিঞ্চিৎ আফসোস লুকিয়ে ছিল! সাফল্য পেলেও যে বিশ্বরেকর্ড গড়া হয়নি। ১০০ মিটার স্প্রিন্টে করেছিলেন অলিম্পিক রেকর্ড। কিন্তু ২০০ মিটারে নিজের বিশ্বরেকর্ড তো নয়ই, এমনি ছুঁতে পারেননি বেজিংয়ের সাফল্য। এ কারণে শেষটা হয়ত করতে চেয়েছিলেন বিশ্বরেকর্ড গড়ে। অবশেষে প্রত্যাশা পূরণ হয়েছে জ্যামাইকান কালো মানিকের। পুরুষদের ৪ী১০০ মিটার রিলেতে স্বর্ণ জিতে মনোবাসনা পূরণ করেন উসাইন বোল্ট। তিন জ্যামাইকান সতীর্থ ইয়োহান ব্লেক, নেস্টা কার্টার ও মাইকেল ফ্রেটারকে সঙ্গী করে বিশ্বরেকর্ড গড়ে জ্যামাইকাকে উপহার দেন স্বর্ণপদক। জ্যামাইকান চতুষ্টয় স্বর্ণ জিতেছেন ৩৬.৮৪ সেকেন্ড সময় নিয়ে। ‘ডাবল-ডাবল’ (বেজিং ও লন্ডনে ১০০ ও ২০০ মিটারের স্বর্ণ জয়) অর্জন করা বোল্টকে ঠেকাতে ব্যর্থ হন যুক্তরাষ্ট্রের এ্যাথলেটরা। ৩৬.৮৪ সেকেন্ড সময় নিয়ে নিজেদের গড়া বিশ্বরেকর্ড ভেঙ্গে স্বর্ণ জয় করায় গৌরবময় ‘ট্রিপল-ট্রিপল’ও পূর্ণ হয়েছে বোল্টের। অর্থাৎ এ্যাথলেটিক্সের জীবন্ত কিংবদন্তি বেজিংয়ের পর লন্ডনেও জয় করলেন ১০০ ও ২০০ মিটার স্প্রিন্ট এবং ৪ী১০০ মিটার রিলের স্বর্ণ। পৃথিবী নামক গ্রহে বোল্টের আগে কেউ দুই অলিম্পিকে এই তিন ইভেন্টে স্বর্ণ জয় করতে পারেননি। আগেই অমর হয়ে যাওয়া বোল্ট নিজের অমরত্বকে করলেন আরও পাকাপোক্ত। দু’পায়ে যেন চিতার ক্ষিপ্রতা। উল্কাবেগে যেমন করে শিকার ধরতে উড়ে যায় ঈগল সেই দ্রুততা উসাইন বোল্টকে বিশ্বজুড়ে দিয়েছে আকাশের সমান খ্যাতি। কিন্তু কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা ধরার ক্ষেত্রে বোল্ট কতখানি দ্রুততা পেয়েছেন? একটা সময় ছিল যখন চলনসই অর্থের জোগান পাওয়া বোল্টের পকেট এখন বছরের পুরোটা সময়ই থাকে পকেট ভারি। তাঁর উপার্জনের পরিমাণও আকাশ ছুঁয়েছে অর্জিত খ্যাতির সঙ্গে সঙ্গে। গত ১২ মাসে শুধু প্রাইজমানি, বোনাস, অংশগ্রহণের ফি এবং স্পন্সর থেকে বোল্ট পকেটে পুরেছেন ২ কোটি ৩ লাখ মার্কিন ডলার। এরপরও বিশ্বের সর্বাধিক পারিশ্রমিকপ্রাপ্ত এ্যাথলেটদের তালিকায় বোল্টের অবস্থান ৬৩। সর্বোচ্চ আয় করা স্প্রিন্টারের চেয়েও ২০ গুণ বেশি আয় বর্তমানে বোল্টের। শুধু তাই নয়, ট্র্যাক এ্যান্ড ফিল্ডের ইতিহাসে তাঁর মতো আয় করতে পারেননি কোন এ্যাথলেট। অথচ তাঁর শুরু হয়েছিল ইতিহাসের সর্বনিম্ন পারিশ্রমিকপ্রাপ্ত এ্যাথলেট হিসেবে।

No comments

Powered by Blogger.