বাশারের পতন কত দূরে?

এক ভয়াবহ বিপর্যয়ের দিকে ধাবিত হচ্ছে সিরিয়া। ১৭ মাসের গৃহযুদ্ধ এখন চূড়ান্ত ও শেষ পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে। এখানেই নির্ধারিত হবে সিরিয়ার ভবিষ্যত। নির্ধারিত হবে কে চূড়ান্ত অর্থে বিদায়ী হবেÑ প্রেসিডেন্ট বাশার, নাকি বিদ্রোহীরা। সে কথা স্বয়ং বাশারের মুখ থেকেও বেরিয়ে এসেছে।


বাশারের অনুগত বাহিনী আলেপ্পো ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ শহরে বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে লড়ছে। আলেপ্পোর তিনাটি থানা বিদ্রোহীরা দখল করে নিয়েছে। যোদ্ধারা ক্রমেই এগিয়ে আসছে দামেস্কের দিকে। দামেস্কের পুরনো শহরের দুটি খ্রীস্টান এলাকায় ক’দিন আগে লড়াই ছড়িয়ে পড়ে। শহরের কেন্দ্রীয় বাগদাদ সড়ক থেকেও গুলিগোলার আওয়াজ শোনা যায়। এসব থেকে স্পষ্ট যে, বিদ্রোহী বাহিনী প্রেসিডেন্ট বাশারকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলতে যাচ্ছে। অথচ বাশারের পদত্যাগ ও পলায়নের কোন লক্ষণ নেই। এমনকি নির্বাসনে যাওয়ার প্রস্তাবও তিনি প্রত্যাখ্যান করেছেন। অর্থাৎ বাশার শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত ক্ষমতা আঁকড়ে থাকবেন। তার জন্য তাঁর অনুগত বাহিনী শেষ নিঃশ্বাসটি থাকা পর্যন্ত লড়বে। এর ফলে দেশটির শেষ অধ্যায়ের গৃহযুদ্ধ প্রলম্বিত, রক্তপাতময় ও ভয়াবহ হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। তাতে কি ব্যাপক ধ্বংসলীলা নেমে আসবে ও মানবিক বিপর্যয় দেখা দেবে কল্পনাও করা যায় না।
গত ১৪ জুলাইকে সিরিয়ার গৃহযুদ্ধের শেষ অধ্যায়ের সূচনা ধরা হচ্ছে। ঐদিন রাজধানী দামেস্কে বাশার সরকারের ১৪ সদস্যের জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলের বৈঠক চলাকালে বিদ্রোহীদের পেতে রাখা বোমা বিস্ফোরণে প্রতিরক্ষামন্ত্রী দাউদ রাজিহা আসাদের শ্যালক সাবেক সামরিক গোয়েন্দা প্রধান আসেফ সাখাওয়াতসহ নিরাপত্তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বেশ কিছু ব্যক্তি নিহত হন। বলতে গেলে বাশারের গোটা ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট টিমটাই এই বিস্ফোরণে শেষ হয়ে যায়।
সত্যিই যদি ১৪ ফেব্রুয়ারির ঐ ঘটনাটির মধ্যদিয়ে সিরিয়ার গৃহযুদ্ধের শেষ অধ্যায় সূচিত হয় তাহলে অধিকাংশ সিরীয় স্বস্তিবোধ না করে পারবে না। কারণ ১৭ মাসের লড়াইয়ে ২০ থেকে ২২ হাজার লোক প্রাণ হারিয়েছে। ১ লাখ ১২ হাজার লোক বিদেশে উদ্বাস্তুর খাতায় নাম লিখিয়েছে। ২ লাখ লোক বাড়ি-ঘরহীন ছিন্নমূলে পরিণত হয়েছে এবং আরও প্রায় ৩০ লাখ লোকের মানবিক ত্রাণ সাহায্যের প্রয়োজন হয়ে পড়েছে।
গত কয়েক সপ্তাহে সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ ভূখ-গত ব্যাপ্তি ও হিংস্রতা এই দু’দিক দিয়ে এত দ্রুত প্রসার লাভ করেছে যে বাইরের পর্যবেক্ষকরা রীতিমত শঙ্কাবোধ করছেন। কারণ এতে আরও অগণিত মানুষ বাস্তুচ্যুত হবে। দুর্ভোগ আর দুঃখ দুর্দশার শিকার হবে, সাম্প্রদায়িক শুদ্ধি অভিযানে নিষ্পেষিত হবে।
সিরিয়ার ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা হচ্ছে জর্দান থেকে তুরস্ক পর্যন্ত প্রধান সড়ক বরাবর ২৮০ মাইল জুড়ে বিস্তৃত। প্রধান যুদ্ধক্ষেত্রগুলো এখানেই অবস্থিত। এখান থেকেই বেশিরভাগ অধিবাসী পালিয়ে গেছে। ইদলিব, মারাট, নুমান, রাস্তান ও ডেরার মতো বড় বড় শহরের বাড়িঘর মাসের পর মাস নিক্ষিপ্ত গোলাবর্ষণ ও স্নাইপার হামলায় বিধ্বস্ত ও বিপর্যস্ত হয়েছে। সিরিয়ার তৃতীয় শহর হোমসের ১২ লাখ অধিবাসীর প্রায় দুই- তৃতীয়াংশই পালিয়ে গেছে। আশপাশের গ্রামগুলোও হয়ে পড়েছে জনশূন্য। এর কারণ আর কিছুই নয় নির্বিচার হত্যা, ধর্ষণ ও লুটতরাজ। সুদূর পূর্বে ফোরাত অববাহিকার বিশাল প্রাদেশিক শহর দির-এজ-জোরও একইভাবে বিধ্বস্ত জনপদে পরিণত হয়েছে। এখানে হাল্কা অস্ত্রধারী বিরোধীদলীয় মিলিশিয়াদের বের করে আনতে শাসকচক্র ট্যাঙ্ক, কামান, হেলিকপ্টার গানশিপের ব্যাপক যথেচ্ছ ব্যবহার করছে।
বিরোধী মিলিশিয়াদের হুমকি যত বাড়ছে সরকারের আক্রমনাভিযানের ব্যাপকতাও তেমন বাড়ছে। সেই সঙ্গে রয়েছে অস্ত্র ও গোলাবারুদের এলোপাতাড়ি ব্যবহার। মিলিশিয়াদের বেশিরভাগই হচ্ছে সেনাবাহিনী থেকে পালিয়ে আসা সৈনিক ও স্বেচ্ছাসেবীদের স্থানীয় মিশ্রণ। এই মিলিশিয়া বাহিনীর একটি নাম আছেÑ ফ্রি সিরিয়ান আর্মি। এর মোট লোকবল ৪০ হাজার পর্যন্ত হতে পারে। কেউ ঠিকমত জানে না। এদের দক্ষতা ও সাজসরঞ্জামের গুণগত তারতম্য ব্যাপক। তবে সবারই এক অভিযোগ। তাহলো বিদেশীরা অর্থ ও অস্ত্রের কত রকম প্রতিশ্রুতিই না দিয়েছে। কিন্তু কদাচিতই তারা সেই প্রতিশ্রুতি রেখেছে। বেশিরভাগ অস্ত্র ও সাজসরঞ্জাম বিদ্রোহীরা কিনেছে স্থানীয় অস্ত্র ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে ধনাঢ্য সিরীয়দের দেয়া টাকায়। রাজধানী দামেস্কে প্রতি তিনজন বিদ্রোহী যোদ্ধার জন্য একে-৪৭ রাইফেল রয়েছে মাত্র একটি। কালোবাজারে এগুলোর প্রতিটির দাম দেড় হাজার ডলার। সঙ্কট শুরুর আগে যা ছিল মাত্র ৩শ’ ডলার। অস্ত্রশস্ত্রের এই ঘাটতির কারণেই বিদ্রোহী বাহিনী সুদক্ষ ও সুসজ্জিত সরকারী বাহিনীর বড় ধরনের আক্রমণের মুখে সহজে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। গত ১২ জুলাই হামার কাছে ট্রেমশে গ্রামে সরকারী বাহিনীর এক সর্বাত্মক হামলায় তাই প্রায় ২শ’ বিদ্রোহী প্রাণ হারায়।
এই দুর্বল অস্ত্রশস্ত্র নিয়েও ফ্রি সিরিয়ান আর্মি যতটুকু যা অর্জন করেছে তাও কম নয়। তাদের হাতে এ পর্যন্ত সরকারী বাহিনীর ৩ থেকে ৭ হাজার সৈন্য প্রাণ হারিয়েছে। হতাহতের সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বিদ্রোহীরা গেরিলা কৌশল অনুসরণ করেছে। কিন্তু সম্প্রতি তাদের কৌশলে পরিবর্তন এসেছে। তারা ক্রমবর্ধমান সংখ্যায় সুপরিকল্পিত হামলা চালাচ্ছে যার মধ্যে অপহরণও অন্তর্গত। ইতোমধ্যে রাজধানীতে সিনিয়র কিছু কর্মকর্তাকে এবং বাশারের ঘনিষ্ঠতম এক সহকর্মীর ব্যবসায়ীপুত্রকে অপহরণ করা হয়েছে।প্রেসিডেন্ট বাশারের সেনাবাহিনীর সদস্যসংখ্যা ৩ লাখ। তাদের হাতে আছে ট্যাঙ্ক, কামান, হেলিকপ্টার গানশিপের মতো ভারি অস্ত্র, বোমারু বিমান, ক্ষেপণাস্ত্রের মতো আধুনিক রণসম্ভার। কিন্তু তারপরও এই বাহিনীর বেশ কিছু দুর্বলতা আছে। এই বাহিনীতে সুন্নি সৈন্যের সংখ্যা কম নয়। তাদের অনেককে নিষ্ক্রিয় অবস্থায় রাখা হয়েছে। কিছু কিছু সৈন্য অহরহ সেনাবাহিনী থেকে পালিয়ে যাচ্ছে। কেউ কেউ আবার ইনফর্মার হিসাবে কাজ করছে। অফিসারদের একটি অংশ নানাভাবে বিদ্রোহীদের সাহায্য করছে। অন্যদিকে খ্রীস্টান, ফিলিস্তিনী, ক্রজ ও কুর্দীর মতো সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী এই সরকারকে একটা দুর্বৃত্ত-পাপিষ্ঠ সরকার হিসাবে দেখছে এবং সরকারের আশু পতন কামনা করছে।
এই অবস্থায় সিরিয়ার দুই পক্ষ এখন লড়াইয়ে চূড়ান্ত পর্যায়ে অবতীর্ণ হয়েছে। এই পর্যায়ে কি যুদ্ধের দ্রুত পরিসমাপ্তি ঘটবে, নাকি তা আরও প্রলম্বিত লড়াইয়ের দিকে এগিয়ে যাবে? প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের খুনী সরকারের কি দ্রুত পতন ঘটবে, নাকি নিষ্ঠুর শক্তি প্রয়োগের আশ্রয় নিয়ে এ যাত্রা টিকে যাবে? এসব প্রশ্নের রাতারাতি কোন জবাব পাওয়ার উপায় নেই। আগামী দিনগুলোই বলে দেবে কোন্ পথে যাচ্ছে সিরিয়াÑ আরও রক্তপাত, হত্যা, ধ্বংসযজ্ঞ নাকি অন্য কিছু।
সূত্র : দি ইকোনমিস্ট

No comments

Powered by Blogger.