ইব্রাহীমের সঙ্গে এক কৃষ্ণবালিকা by কাজী জহিরুল ইসলাম

একটু একটু করে ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে। মাথার কাছে কাচের জানালা। জানালার ওপাশে রক্তকরবীর গাছ। রক্তকরবীর গাছভর্তি এক ঝাঁক মুনিয়া পাখি, ভোর না হতেই কিচিরমিচির শুরু করে দিয়েছে। কে বলেছে পাখির ডাক মধুর? ওদের কলকাকলির অত্যাচারে আমার সকালের ঘুমটাই মাটি। এ মুহূর্তে পাখির কলকাকলির চেয়ে বিরক্তিকর জগতে আর কিছু আছে বলে মনে হচ্ছে না।
ঘুম ভেঙে গেছে বটে কিন্তু এখনও চোখ বুজে পড়ে আছি। এপাশ-ওপাশ করছি। তখনই যান্ত্রিক পাখি ডেকে ওঠে। আমি আসলে বুঝতেই পারিনি যে ডোরবেল বাজছে। এরপর অ্যাপার্টমেন্টের মেটাল গেটে দুদ্দার শব্দ। লাফ দিয়ে উঠেই দরজা খুলি। দেয়াল ঘড়িতে তাকিয়ে দেখি সাড়ে সাতটা বাজে। কী আশ্চর্য, সেই কাকভোরেইতো উঠে গেলাম, তাহলে এতটা সময় পেরিয়ে গেল কী করে? দরোজা খুলে দেখি আমাদের নৈশ প্রহরী ইব্রাহীম, সঙ্গে এক কৃষ্ণ বালিকা। ইব্রাহীমকে বলেছিলাম আমার জন্য একজন কাজের মেয়ে জোগাড় করতে। গত সন্ধ্যায় ও জানিয়েছে, সকালে নিয়ে আসবে। ইব্রাহীমের সকাল মানে ছয়টা। ওর ডিউটি ছয়টায় শেষ, এতক্ষণ আমার ঘুম ভাঙার অপেক্ষায় ছিল। দেড় ঘণ্টা ধরে আমার জন্য অপেক্ষা করেছে। সেই ঝালটাই ঝেড়েছে লোহার গেটের ওপর।
তোমার নাম কী? আমার এ প্রশ্নের কোন উত্তর দিচ্ছে না তেইশ/চব্বিশ বছরের কৃষ্ণ বালিকা। ইব্রাহীম ওর শাহাদাত আঙুল বাতাসে বাউলি কেটে বলে, নো আংলে, ফসে সিলভু প্লে। আমি বলি, আমি তো ফসে জানি না। ‘ওকে, আই ট্রান্সলেট ফর ইউ’। আমার ভাঙা ফরাসি আর ইব্রাহীমের ভাঙা ইংরেজির ভাষান্তরে মেয়েটির সঙ্গে যোগাযোগ করি। ওর নাম ফাতিমা, বাড়ি বুরকিনা ফাসো। ইব্রাহীমের দেশি বোন। রান্না করা, বাড়িঘর সাফ করা, কাপড় ধোয়া, ইস্ত্রি করা, বাজার করা সব করতে পারে ফাতিমা। এর আগে ইন্ডিয়ান বাড়িতে কাজ করেছে, সুতরাং রুটি বানাতে পারে, ডাল রান্না করতে পারে। আমি ভীষণ খুশি। বেতন পঞ্চাশ হাজার সিএফএ, মানে সাত হাজার টাকা। চোখের নিমিষে কাজ হয়ে যাচ্ছে। রান্না খুবই চমত্কার, বাড়িঘর ঝকঝকে-তকতকে, বিছানার চাদর টানটান, কড়কড়ে ভাঁজ খোলা জামা-কাপড়, সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে মনে হয় পাঁচতারা হোটেলের এক পরিপাটি স্যুটে ঢুকেছি। মেয়েটি খুবই ইন্টেলিজেন্ট। এরই মধ্যে বেশ কিছু ইংরেজি শব্দ শিখে ফেলেছে, কিছু হিন্দি সে আগে থেকেই জানে। আমিও কিছুটা ফরাসি জানি। মাঝে মাঝে ওর সঙ্গে গল্প করি। বিশেষ করে শনিবারে, যেদিন আমার অফিস থাকে না। ফাতিমা বলে ওর জীবনের গল্প। চৌদ্দ বছর বয়সে আমার বিয়ে হয়। দুটি ছেলে আছে। একটির বয়স আট আর একটির পাঁচ। স্বামী বেকার। কোন কাজ নেই। আয়-রোজগার নেই। তাই আমি দুই বছর আগে জীবিকার সন্ধানে পাড়ি জমাই আইভরিকোস্টে। এখনও দেশে যাইনি। আর কিছু টাকা জমিয়ে দেশে যাব। আমার স্বামী ইলেকট্রিকের কাজ জানে। দেশে গিয়ে স্বামীকে ড্রিল মেশিন আর টুল বক্স কিনে দেব।
শুধু ফাতিমা নয়, ফাতিমার মতো হাজার হাজার বুরকিনি মেয়ে আইভরিকোস্টে পাড়ি জমায় জীবিকার সন্ধানে। আইভরিকোস্টের বর্তমান ক্রাইসিসের এটা একটি বড় কারণ। প্রতিবেশী দেশ বুরকিনা ফাসো থেকে সীমানা পেরিয়ে ঢুকে পড়া বুরকিনিদের সংখ্যা এখন অনেক। কয়েক প্রজন্ম ধরে এখানে এসে স্থায়ীভাবে বসবাস করা বুরকিনি অভিবাসীর সংখ্যা এখন প্রায় ৩৫ লাখ, যা মোট জনসংখ্যার ২০ শতাংশ। আয়তনের দিক থেকে আইভরিকোস্টের চেয়ে সামান্য ছোট বুরকিনা ফাসো। ২ লাখ ৭৪ হাজার বর্গকিলোমিটার আয়তনের এ দেশটিতে লোক বাস করে মত্র দেড় কোটি। জনসংখ্যার প্রায় ৬০ শতাংশ মুসলমান, ১৭ শতাংশ খ্রিস্টান আর বাকিরা এনিমিস্ট। একটি কথা বুরকিনিদের মধ্যে প্রচলিত আছে, জনসংখ্যার ৫০% মুসলমান, ৫০% খ্রিস্টান এবং ১০০% এনিমিস্ট। অর্থাত্ যে যেই ধর্মের অনুসারীই হোক না কেন সনাতন ধর্মীয় সংস্কার সবাই পালন করে। আর যে কারণে বুরকিনি অর্থনীতিতে এখনও লাগেনি বিজ্ঞানের ছোঁয়া। শিক্ষার হার গত এক যুগে দ্বিগুণ হলেও এখনও ২৫ শতাংশ অতিক্রম করেনি। আফ্রিকার অন্যান্য অংশের চেয়ে বুরকিনিদের মধ্যে এইচআইভি ভাইরাস বহনকারীর সংখ্যা কিছুটা কম। তবে গড় আয়ু মাত্র ৪৮ বছর। এর মূল কারণ হলো শিশুমৃত্যুর হার খুবই বেশি। সবচেয়ে বড় ঘাতকব্যাধির নাম ম্যালেরিয়া। চিকিত্সাসেবার অপ্রতুলতার কারণেই ম্যালেরিয়ার মতো সাধারণ ব্যাধিতে এত মানুষ মারা যায়। গড়ে প্রতি ১ লাখ মানুষের জন্য ডাক্তার আছে মাত্র ৬ জন।
বুরকিনা ফাসোর অভ্যন্তরে প্রবাহিত তিনটি নদী নীল ভোল্টা, সাদা ভোল্টা আর লাল ভোল্টার নামানুসারে দেশটির নামকরণ হয়েছিল আপার ভোল্টা স্বাধীনতার দু’বছর আগে, ১৯৫৮ সালে। পরবর্তীকালে বুরকিনিদের প্রধান দুটি আদিভাষার একটি, মোরে ভাষাতে এর নামকরণ হয় বুরকিনা ফাসো। বুরকিনা শব্দের অর্থ হলো সত্ মানুষ আর ফাসো শব্দের অর্থ হলো পিতার ঘর। পুরো অর্থ দাঁড়ায় সত্ পিতার ঘর বা সত্ পিতার দেশ। এখন কথা হচ্ছে বুরকিনা ফাসোর বর্তমান পিতা প্রেসিডেন্ট ব্লেইজ কম্পাওরে কতখানি সত্? ২০০০ সাল থেকে তিনি বুরকিনা ফাসোর প্রেসিডেন্ট। ফাতিমা এই প্রশ্নের কোন উত্তর জানে না। ও রাজনীতি বোঝে না এবং বুঝতেও চায় না। শিক্ষায় অনগ্রসর বুরকিনিরা মোটেও রাজনীতি সচেতন নয়, আর এ কারণেই কম্পাওরের মতো মানুষেরা ১০/১১ বছর ধরে রাষ্ট্রক্ষমতার শীর্ষে বসে থাকতে পারে অনায়াসেই।
লেখক : কবি, জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক কর্মকর্তা

No comments

Powered by Blogger.