এই নগরীর দিনরাত্রিঃ বাধা দিলে বাধবে লড়াই by রেজোয়ান সিদ্দিকী

সত্তরের দশকে শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনকালে তখনকার প্রধান বিরোধী রাজনৈতিক দল জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ)-এর প্রধান রাজনৈতিক স্লোগান ছিল ‘বাধা দিলে বাধবে লড়াই, সেই লড়াইয়ে জিততে হবে, আর সামনে আছে জোর লড়াই, সে লড়াইয়ে জিততে হবে।’ আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিতে কিংবা ক্লাসরুমে বসে এই স্লোগানটি শুনতাম এবং দেখতে দেখতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন এলাকা থেকে শত শত ছাত্র সে মিছিলে যোগ দিযে বুলন্দ আওয়াজ তুলত ‘বাধা দিলে বাধবে লড়াই ... ...।’ শেখ মুজিবের ওই শাসনামলে বাধা দেয়াই যেন রেওয়াজে পরিণত হয়েছিল।
বিরোধী রাজনৈতিক দলের কেউ মিছিল করতে গেলে, জনসভা করতে গেলে কিংবা অন্য কোনো কর্মসূচি পালন করতে গেলে বাধা দেয়াটাই প্রতিদিনের রেওয়াজ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। সে বাধাদানে শরিক হতো আওয়ামী পেটোয়া বাহিনী, লালবাহিনী, নীলবাহিনী, বিডিআর ও রক্ষীবাহিনী। রক্ষীবাহিনীও তখন বৈধ বাহিনী ছিল। সেনাবাহিনীর বিকল্প হিসেবে ভারতীয় প্রশিক্ষণ ও পরামর্শে শেখ মুজিবুর রহমান রক্ষীবাহিনীকে গণনির্যাতনের বিশেষ প্রশিক্ষণে প্রশিক্ষিত করেছিলেন। তাদের সেসব নির্যাতনের লোমহর্ষক কাহিনী স্মরণ করলে এখনও আঁেক ওঠেন সেই সময়ের তরুণ-যুবকে এবং প্রবীণেরা।
জাসদ সমর্থিত ছাত্রলীগ বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন ‘বাধা দিলে বাধবে লড়াই’ স্লোগান দিয়ে সমবেত হতো তখন বারান্দায় দাঁড়িয়ে হাজার হাজার ছাত্রছাত্রী করতালি দিয়ে তাদের স্বাগত জানাতেন। অর্থাত্ শেখ মুজিবুর রহমানের অপশাসনের বিরুদ্ধে; অত্যাচার, নির্যাতন-নিপীড়নের বিরুদ্ধে; সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, দখল, ছিনতাই, অপহরণের বিরদ্ধে কেউ যখন প্রতিবাদ করছে, রুখে দাঁড়াচ্ছে—তখন সেই করতালি তাদের প্রতি নীরব বা সরব সমর্থন ঘোষণা করেছে। বিরোধী দলের জনসভাগুলো ভেঙে দেয়ার জন্য রক্ষীবাহিনীর ফ্লাইং কিকের ছবি পত্রিকায় প্রকাশ হয়েছে। কী রূঢ়, নিষ্ঠুর সে নির্যাতন!
সে সময়ও শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন তত্কালীন শাসকগোষ্ঠী যেন মরিয়া হয়ে নেমেছিল বিরোধী দলকে নির্মূলের জন্য; কিন্তু জনতার স্রোত সাগরের জোয়ারের মতোই ভয়াবহ প্রতিরোধ। ফলে শেখ মুজিবুর রহমানের কোনো বাধাই তার শাসনকালে দুর্ভেদ্য হয়ে ওঠেনি। তখন দেশের পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছিল যে, গোটা দেশের মানুষ একদিকে আর শাসকগোষ্ঠী আরেক দিকে। শাসকগোষ্ঠীর সঙ্গে ছিল তাদের ঘৃণিত পেটোয়া বাহিনী ও পুলিশ, বিডিআর, রক্ষীবাহিনী; কিন্তু সামান্য কয়েক হাজার সশস্ত্র লোক দিয়ে কয়েক কোটি মানুষকে দমন করা যায় না। শাসকগোষ্ঠী এই সত্য উপলব্ধি করতে তখন ব্যর্থ হয়েছে। দেশের মানুষের সেই অপশাসন থেকে মুক্তির লড়াই থেকে বোঝা যায় যে, জনগণের এই দুর্দিন সম্পর্কে শাসকগোষ্ঠীর কোনো ধারণা ছিল না। ফলে সে সময়ও যখন দুর্ভিক্ষে প্রতিদিন শত শত মানুষ মরেছে তখন বিশাল আকৃতির কেক কেটে শেখ মুজিবের জন্মবার্ষিকী পালন করা হয়েছে। যখন দুর্ভিক্ষে মানুষ ঘটি-বাটি, জমি-গরু বিক্রি করে অন্ন সংস্থানের চেষ্টা করছিল তখন শেখ মুজিবের পুত্রের বিয়েতে আওয়ামী নেতারা সোনার মুকুট উপহার নিয়ে হাজির হয়েছিল। এটি জনগণ থেকে বিচ্ছিন্নতার একটি নিকৃষ্ট উদাহরণ।
আর এই অবস্থা মোকাবেলা করতে না পেরে নিজের দলকে সংশোধনের বদলে নেতা-নেত্রীদের নিয়ন্ত্রণে না এনে শেখ মুজিবুর রহমান সত্য প্রকাশ রুদ্ধ করতে, ভিন্ন মতের অস্তিত্ব নির্মূল করতে বন্ধ করে দিয়েছিলেন স্তুতি-গাওয়ার জন্য চারটি পত্রিকা রেখে বাকি সব সংবাদপত্র। নিষিদ্ধ করে দিয়েছিলেন তার নিয়ন্ত্রণে বাকশাল রেখে বাকি সব রাজনৈতিক দল। ইতিহাস প্রমাণ করেছে, এই সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল না।
শেখ হাসিনার বর্তমান শাসনকালেও বিরোধী দলের ওপর তেমনি হিংস্রতা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে শাসকদল। সংসদে বিরোধী দলের মাইক বন্ধ, তাদের মিটিং-মিছিলে হামলা, বাধাদান, তাদের নেতাকে কটূক্তি, অপদস্ত করা, তাদের নেতৃবৃন্দের নামে কুত্সা রটানো, সংসদের ভেতরে-বাইরে অশালীন মন্তব্য, মিছিলে কাঁটাতারের বেড়া—সবই আবার নগরীতে প্রত্যাবর্তন করেছে। সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি-মাস্তানি, ছিনতাই, টেন্ডারবাজি সবই যেন ১৯৭২-’৭৫-এর মতো জেঁকে বসেছে।
কয়েকদিন আগে প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনা জাতীয় সংসদে বলেছেন, বিরোধী দলে থাকতে বিএনপি আমাদের কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে আটকে রেখেছিল, আমরাও এবার তাই করব। তার ছয়দিনের মাথায় গত ১৫ মার্চ নয়াপল্টনে বিএনপি অফিসের সামনে প্রতিবাদ সভা ডেকেছিল যুবদল; কিন্তু কাঁটাতারের বেড়া আর শত শত পুলিশ দিয়ে বিএনপি কার্যালয় ঘেরাও করে ফেলা হয়। জনসভার জন্য মাইক লাগাতে গেলে পুলিশ তা কেড়ে নেয়। জলকামান, প্রিজন ভ্যান তৈরি রাখা হয়। ফকিরেরপুল মোড় থেকে বিজয়নগর মোড় পর্যন্ত রাস্তা বন্ধ করে দেয় পুলিশ। রাস্তা যদি বন্ধই করা হলো তাহলে সমাবেশটি করতে দিতে বাধা ছিল কোথায়?
যুবদলের ওই সমাবেশ একদিনই হতো। এ রকম একটি সমাবেশ করলে সরকারের পতন ঘটে যেতে পারে না। কিন্তু বাধাদানের প্রতিবাদে এখন যুবদল তিনদিনের কর্মসূচি ঘোষণা—১৯ মার্চ সারাদেশে থানা ও পৌরসভায় বিক্ষোভ, ২০ মার্চ জেলা ও মহানগরীতে প্রতিবাদ সমাবেশ, ২২ মার্চ ঢাকায় প্রতিবাদ বিক্ষোভ। তবে কি পুলিশ প্রতিটি থানা ও পৌরসভায় বিএনপির মিছিল-সমাবেশে এভাবে বাধা দেবে? জেলায় জেলায় কেবলই কাঁটাতারের বেড়া তুলবে? রাজধানীতে ক’দিন বিক্ষোভ-সমাবেশ রুখে দিতে পারবে। বরং এ বাধা লড়াই বাধাবে এবং ১৯৭২-৭৫-এর মতো যারা কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গেই জড়িত নয় তারাও পথের পাশ থেকে অপশাসনের প্রতিবাদে করতালি দেবে। কিংবা মিছিলে অংশ নেবে। নিরুত্তাপ রাজনীতিতেই সরকার প্রতিদিন গড়ে প্রায় দেড়শ’ রাজনৈতিক নেতা-কর্মীকে গ্রেফতার করেছে। উত্তপ্ত হলে তবে কি প্রতিদিন হাজার হাজার রাজনৈতিক কর্মীকে গ্রেফতার করা হবে? কোথায় পাওয়া যাবে এত বড় কারাগার। নাকি এর আগের বারের মতো প্রতিটি বন্দিকে জামা খুলে রোদের ভেতর বসিয়ে রাখা হবে সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যানে! সেটা করতে চাইলে গোটা দেশকে একটি কারাগার বলে ঘোষণা দিতে হবে সরকারকে। নাগরিকরা সে রকম ভয়াবহ দৃশ্য কল্পনাও করতে পারেননি।
বসন্ত যে যায়
আদিকাল থেকে ফাল্গুন নিয়ে যত কাব্যকথা রচিত হয়েছে, চৈত্র নিয়ে কেউ ততটা ব্যাকুল হয়নি। চৈত্র কেবল শুরু হয়েছে। রোদের খরতাপ ক্রমেই বাড়তে শুরু করেছে। গরমের জামা-কাপড় বেশ আগে আবার স্যুটকেস, ট্রাঙ্ক, ক্লজসেট, ওয়ারড্রবে ফিরে গেছে। বসন্তের মধুর হাওয়া ক্রমেই অবসিত হয়ে আসছে। পাখিরা অধিকাংশই বাসা তৈরি করে ডিমে তা দিতে শুরু করেছে। ফাল্গুনের মন-কেমন-করা উদাস হাওয়া এখন তপ্ত হয়ে উঠছে; তবু পঞ্জিকার হিসেবে চৈত্রও তো বসন্তেরই মাস। তবে বসন্ত বায়ু এখন আর নেই বললেই চলে।
এরই মধ্যে ফাল্গুনে দু’দিন তুমুল বৃষ্টি হয়ে গেছে। প্রথমদিন বৃষ্টির সঙ্গে ছিল তীব্র ঝড়। সে ঝড়ে গাছপালার শুকনো মুকুল মরা ডাল ঝরে গেছে। তারপর পুরো শীতকালজুড়ে বৃষ্টিহীন পরিবেশে গাছের পাতায় পাতায় জমেছিল পুরো ধুলার আস্তরণ, ঝড়-বৃষ্টিতে তা ধুয়ে-মুছে এখন গাঢ় সবুজ হয়েছে। পত্রপল্লব পুষ্প আপন রং ফিরে পেয়েছে। এখন বোঝা যাচ্ছে প্রকৃতি কী আশ্চর্য। বর্ণিল রংময় ঘ্রাণময় এই বৃষ্টি অনাকাঙ্ক্ষিত ছিল না। বসন্তের শুরুতে এমনি একটি বৃষ্টি কোথা থেকে যে নামে! তারপর সবকিছু ধুয়ে-মুছে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে দিয়ে যায়। এও যেন বসন্তের উচ্ছ্বাসকে বাড়িয়ে তোলার প্রয়াসের অংশ। প্রকৃতির অন্য দশটা প্রাণী যেমন বসন্তের জন্য নিজেকে সাজিয়ে গুছিয়ে তৈরি করে, বৃক্ষ তার শরিক হবে না কেন? পক্ষীকুল পুচ্ছের চর্বি দিয়ে নিজেদের সাজায়, ফুল ফোটে, ভ্রমর মধুকরের আনাগোনা বেড়ে যায়। সেখানে বৃক্ষ যদি থাকে ধূলি-ধূসরিত তাহলে মানাবে কেন। সুতরাং প্রকৃতি বৃক্ষকেও বসন্তের অনুকূলে সাজায়। এভাবেই একটি সমন্বিত পরিবর্তন ঘটে প্রকৃতির ভেতরে। অনাদিকাল থেকেই এমন ঘটে আসছে।
আমরা গাছে গাছে গ্রীষ্মের ফলের মুকুলের বাহারের কথা শুরুতে বলেছিলাম। এখন মুকুলগুলো গুটিতে পরিণত হয়েছে। বাজারে কাঁচা আম পাওয়া যাচ্ছে। রাস্তার পাশে হকাররা কাঁচা আম স্লাইস করে কাসুন্দি দিয়ে বিক্রি করছে। ডালের ভেতরে আমের টক আসতে শুরু করেছে। কাঁঠালের মোচা ভেদ করে বেরিয়ে আসা ফল এখন কাঁঠালের কাঠামো ধারণ করতে শুরু করেছে। বরই পেকে টোব্বা বরই হয়েছে। শিশুরা গাছে ঢিল দিয়ে জানালার কাচ ভেঙেছে। জামগুলো সবুজ গুচ্ছে বেড়ে উঠছে। এর সবই গ্রীষ্মের আয়োজন। গ্রীষ্মে খরতাপ থাকলেও ব্যাপক ফলের সমারোহ ঘটে। প্রকৃতি এখন তার প্রস্তুতিতে ব্যস্ত। নাগরিকরা এর কতটুকু দেখতে পায়?
ফুটনোট
এক ব্যাংকার অন্যায় তদিবরকারী একজন প্রতিমন্ত্রীকে চিনতে পারেননি। সেই ‘অপরাধে’ ওই প্রতিমন্ত্রী ব্যাংকারকে ধরে আনার জন্য তার গানম্যানসহ ৫-৬ জন মাস্তান পাঠিয়ে ছিলেন। এই খবর শুনে মন্তব্য করলেন জনৈক নাগরিক— ‘আমিও তো তার নাম শুনিনি, এখন আমার কী হবে? ব্যাংকারকে তবুও তার কর্মকর্তারা রক্ষা করেছিলেন, আমাকে কে রক্ষা করবেন?’

No comments

Powered by Blogger.