সেরার মুকুট ফের যুক্তরাষ্ট্রের by মোঃ নুরুল ইসলাম পাঠান

সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, আনন্দ-বেদনার কাব্যগাথা শেষে ইতোমধ্যে বিদায় ঘণ্টা বেজেছে লন্ডন অলিম্পিকের। গত ১২ আগস্ট সুরের মূর্ছনায় বিদায় জানানো হয় বিশ্বের সর্ববৃহৎ ক্রীড়াযজ্ঞের ৩০তম আসরকে। পূর্ব লন্ডনের স্ট্যার্টফোর্ডের অলিম্পিক স্টেডিয়াম সমাপনী দিনে সেজেছিল বর্ণাঢ্য সাজে।


ব্রিটিশ ফ্যাশন ও সঙ্গীতের মূর্ছনায় সফল আয়োজনে ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই করে নিয়েছে ইংল্যান্ডের রাজধানী লন্ডন। লন্ডনকে বিদায় জানানোর সঙ্গে সঙ্গে স্বাগত জানানো হয়েছে পরবর্তী অলিম্পিকের আয়োজক রিওডি জেনিরোকে। ২০১৬ সালে অলিম্পিকের ৩১তম আসর বসবে ব্রাজিলের এ শহরেই। আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটির (আইওসি) সভাপতি জ্যাক রগে আনুষ্ঠানিকভাবে সমাপ্তি ঘোষণার আগে অলিম্পিক পতাকা তুলে দেন পরবর্তী আসরের আয়োজক ব্রাজিলের রিওডি জেনিরোর মেয়র এডওয়ার্দো পায়েসের হাতে। সেই সঙ্গে নিভে যায় অলিম্পিক মশাল, ভেঙ্গে যায় মিলনমেলা।
গত ২৭ জুলাই অলিম্পিক স্টেডিয়ামে বর্ণাঢ্য উদ্বোধনী অনুষ্ঠান শেষে জ্বলে উঠেছিল যে মশাল, টানা সতেরো দিন সাড়ে দশ হাজার বিশ্বসেরা এ্যাথলেটের আলো ছড়ানো অনবদ্য ক্রীড়া নৈপুণ্যের মাধ্যমে তার সমাপ্তি ঘটেছে গত ১২ আগস্ট। যুক্তরাষ্ট্রের সাম্রাজ্য পুনরুদ্ধার, চীনের শীর্ষস্থান হাতছাড়া, স্বাগতিক গ্রেট ব্রিটেনের শত বছরের সেরা সাফল্য, গতির রাজা উসাইন বোল্টের গৌরবময় কীর্তিগাথা, মাইকেল ফেলপসের সবচেয়ে বেশি অলিম্পিক পদক জয়ের রেকর্ড, পা হারানো দৌড়বিদ অস্কার পিস্টোরিয়াসের ঐতিহাসিক অংশগ্রহণ, ব্রাজিল পুরুষ ফুটবল দলের আরও একবার স্বর্ণ জিততে না পারার হাহাকার, বিভিন্ন ডিসিপ্লিনে রেকর্ড ভাঙ্গাগড়ার খেলাÑ এ রকম অসংখ্য কীর্তির সাক্ষী হয়ে রয়েছে এবারের ৩০তম লন্ডন অলিম্পিক। ‘এ সিম্ফোনি অব ব্রিটিশ মিউজিক’ এ শিরোনামে অলিম্পিক স্টেডিয়ামে শুরু হয়েছিল সমাপনী অনুষ্ঠানের কার্যক্রম। আর্টিস্টিক ডিরেক্টর কিম গ্যাভিনের নির্দেশনায় যুক্তরাজ্য তথা লন্ডনের সংস্কৃতিকে অনুষ্ঠানে উপস্থাপন করা হয়। সমাপনীতে গত অর্ধশতাব্দীতে পপ মিউজিকে ব্রিটেনের অর্জনকে তুলে ধরা হয়। বিশ্বের প্রতিটি প্রান্তরকে ছুঁয়ে গেছে যে সব গানও নতুন করে পরিবেশন করা হয়। শুধু গান নয়, সুপার মডেলদের নিয়ে ছিল চোখ ধাঁধানো ফ্যাশন শো।
সমাপনীতে আট মিনিটের একটি পর্ব ছিল ২০১৬ অলিম্পিকের আয়োজক দেশ ব্রাজিলের জন্য। দক্ষিণ আমেরিকায় প্রথম অলিম্পিক আয়োজনের সুযোগ পাওয়া দেশটির শিল্পীরা ব্রাজিলের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য তুলে ধরেন। তাঁদের পরিবেশনায় ছিল প্রকৃতিপ্রেম, তারুণ্যের জয়গান আর মানবতার প্রচারণা। ব্রাজিলের সাম্বা ছন্দের তালে তালে স্বাগত জানানো হয় রিও গেমসকে। ব্রাজিলীয় পর্বের শেষভাগে মঞ্চ আলো করে আসেন সর্বকালের অন্যতম সেরা ফুটবলার পেলে। সমাপনী অনুষ্ঠানে অলিম্পিকে অংশ নেয়া বিভিন্ন দেশের ক্রীড়াবিদরা সৌহার্দ্যের বন্ধনে আবদ্ধ হন। সতেরো দিনের প্রতিদ্বন্দ্বিতা ভুলে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে খেলোয়াড়রা মার্চপাস্টে অংশ নেন। এবার কেউ কোন দেশের প্রতিনিধি হিসেবে নয়, সবাই আসেন এক সঙ্গে বৃহৎ এক জাতির অংশ হিসেবে। ভিন্ন দেশ, ভিন্ন সংস্কৃতি এখানে হয়ে যায় মিলেমিশে একাকার। সব খেলোয়াড়ের চোখেমুখে ছিল অর্জনের আনন্দ; ছিল একে অন্যকে ছেড়ে যাওয়ার বেদনা। ১৯৫৬ সালের মেলবোর্ন অলিম্পিক থেকে এই রীতি চলে আসছে।
চার বছর আগে বেজিং অলিম্পিকে স্বাগতিক চীনের কাছে শ্রেষ্ঠত্ব হারিয়েছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এবার লন্ডন অলিম্পিকে তাই শীর্ষস্থান ফিরে পাওয়ার চ্যালেঞ্জে এসেছিলেন মার্কিন এ্যাথলেটরা। সতেরো দিনের ময়দানী লড়াইয়ে অবশেষে চীনকে টপকে সাম্রাজ্য পুনরুদ্ধার করেছে যুক্তরাষ্ট্র। রবিবার শেষ হওয়া লন্ডন অলিম্পিকে ৪৬ স্বর্ণ এবং ২৯টি করে রৌপ্য ও ব্রোঞ্জসহ মোট ১০৪টি পদক পেয়ে সবার সেরা হয়েছে অলিম্পিকের ইতিহাসে সেরা সাফল্যের দেশ যুক্তরাষ্ট্র। ৩৮ স্বর্ণ, ২৭ রৌপ্য, ২৩ ব্রোঞ্জসহ মোট ৮৮টি পদক পেয়ে দ্বিতীয় স্থান নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে বেজিংয়ের সেরা চীনকে। তৃতীয় স্থান পেয়েছে স্বাগতিক গ্রেট ব্রিটেন। নিজেদের অলিম্পিক ইতিহাসে ১০৪ বছরের সেরা সাফল্য দেখিয়েছে ব্রিটিশরা। ২৯ স্বর্ণ, ১৭ রৌপ্য, ১৯ ব্রোঞ্জসহ গ্রেট ব্রিটেনের ঝুলিতে জমা পড়েছে ৬৫টি পদক। তবে দুর্ভাগা বলতে হবে রাশিয়াকে। মোট ৮২টি পদক জিতেও তাদের সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে চতুর্থ স্থান নিয়ে। এর কারণ সোনা, রুপার চেয়ে তারা বেশি জিতেছে ব্রোঞ্জপদক। ২৪টি স্বর্ণের বিপরীতে রাশিয়া জিতেছে ২৫টি রৌপ্য ও ৩৩টি ব্রোঞ্জপদক। পদক তালিকার সেরা দশে চীন ছাড়া জায়গা পেয়েছে আর মাত্র একটি এশিয়ান দেশÑ দক্ষিণ কোরিয়া। ১৩ স্বর্ণ, ৮ রৌপ্য, ৭ ব্রোঞ্জসহ ২৮টি পদক নিয়ে তাদের অবস্থান পঞ্চম। এছাড়া পদক তালিকার ষষ্ঠ থেকে দশম স্থান পাওয়া দেশগুলো হলোÑ জার্মানি, ফ্রান্স, ইতালি, হাঙ্গেরি ও অস্ট্রেলিয়া। এশিয়ার আরেক দেশ জাপান অল্পের জন্য সেরা দশের বাইরে চলে গেছে। জার্মানি ১১ স্বর্ণ, ১৯ রৌপ্য ও ১৪ ব্রোঞ্জসহ জয় করে মোট ৪৪টি পদক। সপ্তম স্থান পাওয়া ফ্রান্স ১১টি করে স্বর্ণ ও রৌপ্য এবং ১২টি ব্রোঞ্জসহ মোট ৩৪টি পদক জয় করে। ৮ স্বর্ণ, ৯ রৌপ্য ও ১১ ব্রোঞ্জসহ মোট ২৮টি পদক জিতেছে অষ্টমস্থানে ইতালি। ৮ স্বর্ণ, ৪ রৌপ্য ও ৫ ব্রোঞ্জসহ মোট ১৭টি পদক পেয়েছে নবম স্থান পাওয়া হাঙ্গেরি। সাঁতারে রাজত্ব খুইয়ে এবার দশমস্থান নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে অস্ট্রেলিয়াকে।
চীনের বেজিংয়ে অনুষ্ঠিত ২০০৮ সালের অলিম্পিকে মার্কিন সাম্রাজ্য গুঁড়িয়ে দিয়ে প্রথমবারের মতো শ্রেষ্ঠত্ব নিজেদের করে নিয়েছিল এশিয়ার গর্বের প্রতীক চীন। সেবার ৫১ স্বর্ণসহ ১০০টি পদক জিতে সবার সেরা হয়েছিল বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশটি। মোট ১১০টি পদক জিতলেও স্বর্ণসংখ্যা (৩৬) কম হওয়ায় দ্বিতীয় হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। চার বছর পর এবার মুকুট ধরে রাখার মিশনে এসেছিল চীনারা। আর মার্কিনীদের লক্ষ্য ছিল হারানো সাম্রাজ্য পুনরুদ্ধার। এ লড়াইয়ে যুক্তরাষ্ট্র সফল হলেও সাম্রাজ্য হাতছাড়া হয়েছে চীনের। বেজিংয়ে যুক্তরাষ্ট্র ৩৬ স্বর্ণ জিতলেও এবার পেয়েছে ৪৬টি স্বর্ণ। তবে সার্বিকভাবে তাদের পদকের সংখ্যা কমেছে। গতবার যুক্তরাষ্ট্র মোট পদক জিতেছিল ১১০টি, এবার সে সংখ্যা ১০৪টি। তবে মোট পদকের সংখ্যা কমলেও এবার আগের আসরের চেয়ে ১০টি স্বর্ণ বেশি পাওয়ায় সিংহাসন ফিরে পেয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। চীনের শীর্ষস্থান হাতছাড়া হওয়ার মূল কারণ বেজিংয়ে পাওয়া সাফল্য ধরে রাখতে না পারা। আগেরবার চীন স্বর্ণ জিতেছিল ৫১টি। লন্ডনে সে সংখ্যা ৩৮টি। অর্থাৎ ১৩টি স্বর্ণ কমে গেছে চীনাদের। মজার ব্যাপার হচ্ছে, বেজিংয়ের চেয়ে এই ১৩টি পদকই এবার কম পেয়েছে চীন।
ব্যক্তিগত সাফল্যের বিচারে মার্কিন এ্যাথলেটদের কাছে কেউ পাত্তাই পায়নি।

No comments

Powered by Blogger.