ক্যাম্পাসের প্রিয় মুখ- গানই আমার প্রাণ by সুচিত্রা সরকার

শীতের কুয়াশায় ঢাকা ভোর। ছোট্ট মেয়েটির গায়ে শীতপোশাক। যাত্রা করেছে ভোলা সদরের উদ্দেশে। লালমোহন থেকে পৌঁছাতে ঘণ্টা খানেক লেগেই যায়। ছুটছে মায়ের সঙ্গে গান শিখতে।এমনই এক সুরময় শৈশবের বর্ণনা দেয় দেবযানী দে। পরিবারে ওর নাম অবশ্য পূজা।


তারপর আপন মনেই দেবযানী বলে চলে, ‘ভোরবেলায় আমার ঘুম ভাঙার জন্য তিনটা ঘড়িতে অ্যালার্ম দিয়ে রাখতেন মা। বয়স কত আর হবে। সবে স্কুলে ভর্তি হয়েছি। তখন থেকেই গান শিখতে শুরু করি আমি। সপরিবারে থাকতাম লালমোহনে। আমার গান শেখায় অসুবিধা হচ্ছিল, তাই চলে এলাম ভোলা সদরে।’
জানতে চাইলাম, কার প্রেরণায় গান শেখা শুরু? খানিকটা সুরের ছোয়া কণ্ঠে নিয়েই জানায়, ‘আমার মা। মায়ের উদ্যোগেই আমার গান শেখার শুরু। মা বলতেন, “আমি বড় শিল্পী হতে চেয়েছিলাম। পারিনি। তোমাকে পারতেই হবে।” তাই স্বপ্ন পূরণ করতেই তাঁর যত আয়োজন।’
কী রকম অয়োজন সেটা?
হেসে জবাব দেয়, ‘মা আমার গান শেখার জন্য কী-ই না করেছেন! শান্তিনিকেতনে গিয়ে ভর্তির ব্যাপারে কথাও বলে এসেছিলেন।’
তারপর কোলের ওপর রাখা তানপুরার বোলটা ছুঁয়ে বলে, ‘এই তানপুরাটা মা ঢাকা থেকে কিনে এনেছিলেন। আমি সে সময় ভেবেছিলাম, এটা বড় কোনো গিটার। তুলতে গিয়ে ভেঙে ফেলেছিলাম। ভয়ে সেকী কান্না! রেওয়াজ করার সময় মা পাশে বসে এই তানপুরাটা বাজাতেন।’
এবার যেন করুণ সুরের আভাস দিল দেবযানী, ‘মা মারা গেলেন ২০০৫ সালে। এ জন্য হয়তো শান্তিনিকেতনে আর পড়া হয়নি। তবু মায়ের স্বপ্নটাকে থেমে যেতে দিইনি। সাধ্যমতো চেষ্টা করছি।’
প্রকৃত অর্থেই দেবযানীর সুরের মূর্ছনা থেমে থাকেনি। ২০০৩ সাল থেকে ‘জাতীয় শিশু পুরস্কার’ প্রতিযোগিতায় বরিশাল বিভাগে অংশ নিয়েছে নিয়মিতভাবে। প্রথমবারেই চমকে দিয়েছিল সবাইকে, ২০০৩ সালে নজরুলগীতিতে হয়েছিল প্রথম। এরপর ২০০৫ সালে উচ্চাঙ্গ ও নজরুলগীতিতে প্রথম এবং ২০০৯ সালে উচ্চাঙ্গ ও নজরুলগীতিতে বিভাগীয় পর্যায়ে প্রথম হয়ে জাতীয় পর্যায়ে অংশ নিয়েছে।
রাগপ্রধান গানকেই কেন বেছে নিলে?
হেসে জবাব দেয়, ‘আসলে শৈশব থেকেই এই ধরনের গান করি।’
গানে গানে কতটা পথ পাড়ি দেবে, প্রশ্নটা শুনেই গীতিময় স্বপ্নের কথা বলে।
‘সহযোগিতা পেলে শান্তিনিকেতনে গিয়ে গান শিখব। আরেকটা ইচ্ছা আছে, ঢাকায় গিয়ে ছায়ানটে গান শিখব।’
আর পড়ালেখা?
মিষ্টি হেসে জবাব দেয়, ‘সহপাঠীদের দেখেছি, তাদের কাছে আগে পড়ালেখা তারপর অন্য কিছু। আর আমার কাছে আগে গান, তারপর পড়ালেখা। তাই এইচএসসি শেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সংগীত বিভাগে পড়ার ইচ্ছা আছে।’
শুধু গানই নয়, পড়াশোনায়ও যথেষ্ট সিরিয়াস দেবযানী। ইতিমধ্যে তার প্রমাণও দিয়েছে। এসএসসিতে পেয়েছিলেন জিপিএ-৫। বর্তমানে ভোলার ওবায়দুল হক মহাবিদ্যালয়ে দ্বাদশ শ্রেণীতে পড়ছে। বাবা রবীন চন্দ্র দে। মা মীনাক্ষী রানী দে। দুই ভাইবোনের মধ্যে দেবযানী ছোট।
পরিবারের সহযোগিতা কতটুকু জিজ্ঞাসা করেছিলাম।
উত্তর দিল বেশ গর্বের সঙ্গে, ‘আমার গানের জন্য আমার পরিবার, সহপাঠী, শিক্ষকেরাও অকাতরে সাহায্য করেন।’
তাই যেকোনো সময়, যখন-তখন দেবযানী গলা ছেড়ে গেয়ে ওঠে স্বপ্নসাধ বাঁচিয়ে রাখার গান।

No comments

Powered by Blogger.