বন্ধুসভার এবারের সংখ্যা গ্রাম নিয়ে। আমাদের গ্রাম। বন্ধুদের লেখায় উঠে এসেছে গ্রামের সরল-সহজ সজীবতা। আমাদের গ্রাম

ফসলের রঙে বদলায় ইমরুল কায়েস ছোটবেলায় মনে হতো বাংলাদেশটাই হয়তো আমার গ্রামের মতো। এখন শহুরে জীবনের ভিড়ে ধারণা অনেকটাই পাল্টে গেছে। বাস্তবতার সঙ্গে তাল মিলিয়ে পাল্টেছে আমার গ্রামের রূপও। কিন্তু এখনো ঘুঘুদিয়ায় পাওয়া যায় সেই স্বাদ, যেখানে সম্ভব বৈশাখ মাসে ধানের খেতে মহিষের গাড়িতে চড়ে ঘুরে
বেড়ানো। আমগাছের মগডাল থেকে সবার আগে আম পেড়ে খাওয়া।
বর্ষায় ভেলা ভাসিয়ে ঢেউয়ের তালে দোল দেওয়া।
শরতে নদীতীরে গিয়ে কাশফুলের শুভ্রতায় নিজেকে সাজানো।
শীতের সকালে ঘাসের ওপর শিশিরভেজা পায়ে হাঁটতে হাঁটতে কুয়াশার অন্ধকারে হারিয়ে যাওয়া।
বসন্তে গাছের ডালে কোকিলের সুরে পিছু হাঁটা।
প্রায় দেড় কিলোমিটার দীর্ঘ ঘুঘুদিয়ার পাশ দিয়ে চিরবহমান বংশাই নদী এঁকেবেঁকে চলেছে অসীমের পানে। নদীপারে জেলেপাড়ার জেলেদের দলবেঁধে মাছ শিকারের সঙ্গে ভাটিয়ালি গান আজও শোনা যায়। শিশু-কিশোরেরা নদীর বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে সাঁতার কাটে। কৃষিপ্রধান এই গ্রামের রূপ আবাদি ফসলের রঙে বদলায় প্রতিটি ঋতুতে। গ্রামের ঘরগুলোতে আজও পাওয়া যায় মাটির গন্ধ। মেঠোপথ ধরে হাঁটার ইচ্ছা হলে চলে আসুন এখানে। নিয়ে যাব বিস্তীর্ণ সবুজের বুকে সাদা রেখায় আঁকা দীর্ঘ পথে। গ্রামের অধিকাংশ লোকই অতিথিপরায়ণ। অসাম্প্রদায়িকতার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত ঘুঘুদিয়া। হিন্দু-মুসলমানদের একসঙ্গে সব অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়া এখানে যেন সংস্কৃতি হয়ে উঠেছে। আধুনিকতার ভিড়ে পালাপার্বণের এই বাংলাদেশে আমার গ্রামে আজও পাই সেই বিশুদ্ধ সৌন্দর্য।
 সদস্য, বন্ধুসভা জাতীয় পরিচালনা পর্ষদ

ঝিঁঝির ঘুঙুর
শাহেদুল ইসলাম
শহর থেকে একটু বাইরে আমার গ্রাম। প্রকৃত গ্রামের চেহারা নেই বললেই চলে। না-শহর না-গ্রাম হতে পারার গোপন এক দুঃখ স্পর্শ করে আমার গ্রামকে। সেই দুঃখের বাতাস ছুঁয়ে যায় আমাকেও। সেই বাতাসে দুঃখ থাকলেও আরেকটা জিনিস আছে, সেটা হলো ঘ্রাণ! আমার গ্রামের নিজস্ব ঘ্রাণ। আমার মনে হয়, প্রতিটি গ্রামেরই বোধ হয় নিজস্ব ঘ্রাণ থাকে। কেউ সেটা বোঝে আর কেউ বুঝতে পারে না। আমি বুঝতে পারার দলে।
আমি প্রাণভরে আমার গ্রামের ঘ্রাণ শুঁকি। সে ঘ্রাণের মধ্যে যেন শক্তি পাই। যখনই ঘরে ফিরব বলে বাড়ির পথে পা বাড়াই, গাড়ি এসে থামে আমার গ্রামে, তখন আমি চোখ বন্ধ করে হেঁটে যেতে পারি; এতই নিখুঁতভাবে আমি চিনেছি আমার গ্রামকে। এত চেনার পরও গ্রামের প্রতি আমার মুগ্ধতা কমে না, কেবল বাড়তেই থাকে। পূর্ণিমা রাতে জোছনা যখন সবকিছু ভাসিয়ে নিয়ে যায়, তখন আমার গ্রাম যেন আরও পবিত্র হয়ে উঠে। এর দিকে তখন চেয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। গ্রামটি যখন অর্ধেক ঘুমে, ঝিঁঝিরা তখন মুখর করে রাখে পুরো গ্রাম, তখন বুকের গভীরে ভালো লাগার অনুভূতি ছড়ায়। আমার হঠাৎ হঠাৎ মনে হয়, ঝিঁঝিরা কি ঘুঙুর পরে নাচছে? এত সুন্দর করে একসঙ্গে ডাকে কী করে? শুধু ঝিঁঝিরা ডাকবে কেন? বসন্তে কোকিলও ডাকে। দূরে কোথাও যখন থাকি, তখন আমার মন আকুল হয়ে থাকে, কখন ফিরব গ্রামে।
 মৌলভীবাজার বন্ধুসভা

খোঁজখবর
জিয়াউর রহমান
আমার বাড়ি সুনামগঞ্জ জেলার পাথারিয়া গ্রামে। সেখানেই জন্ম আমার। শৈশব ও কৈশোরের লাল-নীল স্বপ্ন চোখে নিয়ে সেখানেই বেড়ে ওঠা। তখনকার সময় গ্রাম বলতে যা বোঝাত, তার সবই ছিল ওই গ্রামে। কাঁচা রাস্তা, কুঁড়েঘর, হাতেগোনা কয়েকটি টিনের বাড়ি প্রভৃতি। সবুজ গাছপালায় ঘেরা গ্রামের চারপাশ। বিদ্যুতের ছোঁয়া কিংবা শহুরে বাতাস তখনো স্পর্শ করেনি আমার গ্রামকে। সহজ-সরল মানুষের কী সুন্দর জীবনযাপন!
তারপর সময়ের হাত ধরে একদিন স্বপ্নচারী মন নিয়ে হঠাৎ পাড়ি জমাই সুদূর ইংল্যান্ডে। কত দিন চলে যায়! কত কিছুই বদলে যায় কত সহজে। এখানে পশ্চিমা বিশ্বের জীবনধারায় জীবনকে খাপ খাইয়ে নিই ইচ্ছা-অনিচ্ছায়।
কত দিন স্বজনহীন। মাকে দেখা হয়নি কত কাল; তেমনই আত্মীয়স্বজন ও আপনজনের মতো মায়ায় ঘেরা গ্রামটিও! মায়ের সঙ্গে রীতিমতো কথা হয় মুঠোফোনে। আবেগী মন কত কিছু জানতে চায়, কত কিছুর খবর নিতে চায়, এর কোনো ইয়ত্তা নেই। শুনেছি, গ্রামের চেহারাসুরত নাকি অনেকটাই পাল্টে গেছে। গ্রামের পাশের বাজারটি নাকি অনেক বড়! কত দোকানপাট, ব্যাংক, অফিস-আদালত, স্কুল, মসজিদ, পাকা রাস্তা, বিদ্যুতের আলোঝলমলে বাতি...অনেকটা নাকি শহুরে শহুরে ভাব!
 ব্রাইটন, ইংল্যান্ড

বড় মানিকা
তপন দেবনাথ
ভোলার বোরহানউদ্দিন থানার বড় মানিকা গ্রামে আমার জন্ম। ভোলা-চরফ্যাশন সড়কের পাশেই এর অবস্থান। কথিত আছে, বড় মানিক, পেট মানিক ও ছোট মানিক নামক তিন ভাইয়ের নামানুসারে তিনটি গ্রামের নামকরণ করা হয়। উচ্চমাধ্যমিক পাস করা পর্যন্ত এ গ্রামেই ছিলাম। ১৯৮৯ সালে ঢাকায় যাই। তখন থেকে গ্রামটি আমার কাছ থেকে আস্তে আস্তে পর হতে থাকে। ২০০০ সাল পর্যন্ত বছরে দুই-তিনবার গ্রামের বাড়ি গিয়েছি এবং দুই-চার দিন করে থেকেছি। ২০০১ সালে আমেরিকা চলে আসার পর দীর্ঘ প্রায় পাঁচ বছর বাংলাদেশেই যাওয়া হয়নি, গ্রামে আর যাই কী করে? ২০০৬ সালে দেশে গিয়ে যখন গ্রামের বাড়ি যাই, তখন সবকিছু কেমন যেন অচেনা লাগতে থাকে আমার কাছে। গাছগাছালিতে সব ভরে গেছে। আস্তে আস্তে সব ঠিক হয়ে যায়। নতুন নতুন ঘরবাড়ি উঠেছে। ঘরে ঘরে এখন বিজলি বাতি জ্বলে। প্রায় প্রতি বাড়িতে মুঠোফোন। রাস্তাঘাটগুলোও অনেকাংশে পাকা হয়েছে।
গত ১১ বছরের বেশি সময় ধরে লস অ্যাঞ্জেলেসে আছি। এখানে গ্রাম বলতে কিছু নেই। বাংলাদেশে এখন শরৎকাল। আকাশে শরতের সাদা মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে, অথচ এখানে এখন গ্রীষ্মকাল। আমাদের গ্রামের মতো ছায়াঢাকা-পাখিডাকা সকাল এখানে নেই। খুব মিস করছি আমার গ্রামকে।
 লস অ্যাঞ্জেলেস, যুক্তরাষ্ট্র

জোনাকির আলো
মনিরা রহমান
অধিকাংশ মানুষের শিকড় রয়েছে গ্রামে। কিন্তু যাঁরা নদীর তীরবর্তী মানুষ, তাঁরা জানেন সেই শিকড় কতটা দোদুল্যমান, অর্কিডের মতো। গ্রাম আমাকে ভীষণ টানে আরও অনেকের মতো। যে গ্রামটি সেই ছেলেবেলা থেকে চোখে লেগে আছে। সেখানে স্কুল-কলেজ ছিল, ছিল ডাকঘরও। তার কিছু দূরেই ছিল যমুনা নদী। গাছপালা আর বাঁশঝাড়ে সন্ধ্যায় নেমে আসত ভীষণ অন্ধকার। সেই অন্ধকারে অজস্র ঝিঁঝির কোরাস আর দীপ জ্বালাতে ছিল অজস্র জোনাকি। প্রতিটি নক্ষত্রের যে আলাদা আলো, তা লক্ষ করেছিলাম সেই গ্রামেই প্রথম। মানুষগুলোও এমন সরল ছিল।
আমরা যখন আমাদের বাড়ি পৌঁছাতাম, তখন তারা ভিড় করে আমাদের দেখতে আসত। নিজেদের বেশ রাজকন্যা মনে হতো। তারপর তাদের সঙ্গেই দলবেঁধে গাছে চড়া, গোল্লাছুট বা ডাংগুলি খেলা। সারা গাঁয়ে অজস্র ধুলো কিংবা পা-ভর্তি কাদা মেখে সন্ধ্যায় ঘরে ফিরলে দাদি নলকূপের ক্যাচর ক্যাচর শব্দ তুলে পানি তুলতেন। আর আদুরে বকুনি দিয়ে আমাদের পরিষ্কার করতেন। রাতে ঘুমের ভেতরে দাদির হাতের পাখা আমাদের হাওয়া দিয়ে যেত।
সকালে ঘুম ভেঙে দেখতাম উঠোনে ঝরে পড়েছে কামরাঙার কত বেগুনি ফুল!
যমুনার করাল গ্রাসে কোথায় তলিয়ে গেছে সেই গ্রাম। যার নাম ছিল ‘টেংলাহাটা’। মসজিদের পাশেই দাদির কবর। কোথায় ঠাঁই নিয়েছে সেদিনের সব মানুষ! বর্ষার থইথই পানিতে হাঁসগুলো যেমন নিজের ঘর খুঁজে পেত না, আমরা এখন শহরে থেকেই মানুষের ভিড়ে নিজেদের শিকড় আর খুঁজে পাই না।
 বন্ধু, রাজশাহী বন্ধুসভা

কাঁঠাল পাতার সজীবতা
বিপাশা হোসাইন
গ্রামের নাম রামনগর। মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইরে। রামের নগর কি না—এ প্রশ্ন উদয় হয় অনেকেরই মনে। রামের নগর না হলেও রামভক্তদের নগর ছিল এটা। একসময় পালবংশীয় জমিদারদের দাপটে সরগরম ছিল এই ছোট গ্রামটি। গ্রামের মানুষের কেবলই খেয়েপরে বেঁচে থাকার সংগ্রাম। প্রায় ৯০০ লোকের বসতি এই গ্রামে। আশপাশে কোনো স্কুল নেই, সুযোগ নেই কোনো পড়াশোনার। অশিক্ষিত দরিদ্র এই মানুষেরাও উপলব্ধি করল শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা। ১৯৭৯ সালে নিজেদের উদ্যোগে তারা প্রতিষ্ঠা করল রামনগর বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। রাজধানীর খুব কাছের এই গ্রামটি এখনো কোনো শিল্পপ্রতিষ্ঠানের অন্তর্গত হয়নি। গ্রামটি এখনো কৃষকদের। যাদের দুবেলা দুমুঠো ভাত আর পরনে মোটা কাপড় ছাড়া আর কিছুই চাওয়ার নেই। তারাও জীবিকার তাগিদে বিদেশে পাড়ি জমাতে গিয়ে শিকার হয় আদম ব্যবসায়ীদের প্রতারণার। গ্রামটি এখন পর্যন্ত সব আধুনিক সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত। ইলেকট্রিসিটি এখনো হাতের নাগালের বাইরে। বর্ষায় কাদামাখা পথ। কাঁঠালপাতার সজীবতা—সব মিলিয়ে ছবির মতো গ্রাম। এখানে আধুনিকতার কোনো স্পর্শই নেই। সন্ধ্যাবেলায়ই রাজ্যের সব অন্ধকার গ্রামে নেমে আসে। কিন্তু গ্রামের মানুষের স্বপ্ন থেমে থাকেনি। আজ তাই তাদেরই দুজন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। সবুজ গ্রামটি চিরকাল সবুজ থাকুক।

একসঙ্গে মিলেমিশে
মুন্সী আবদুল কাদির
চুয়াডাঙ্গা জেলার আলমডাঙ্গায় সবুজে ঢাকা ছায়াসুনিবিড় একটি গ্রাম, নাম বন্ডবিল। এ গ্রামেই আমার জন্ম। ছোটবেলা বেড়ে ওঠা, ধানখেতে ঘুরে বেড়ানো, সবুজ মাঠে ঘুড়ি ওড়ানো, দুরন্ত বালকদের সঙ্গে এক হয়ে পুকুরে ঝাঁপিয়ে পড়া—আরও কত কী।
অসম্ভব সুন্দর আমার গ্রামটি। এ গ্রাম নিয়ে আমার অনেক গর্ব। আমার গ্রামে রয়েছে স্বতন্ত্র কিছু বৈশিষ্ট্য। তার মধ্যে সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হলো গ্রামবাসীর একাত্মতা। যদিও প্রায় পাঁচ হাজার লোকের বাস গ্রামটিতে, ঈদ পার্বণে সবাই এক হয়ে মেতে উঠি আনন্দ উৎসবে। এক ঈদগায় মিলিত হয়ে আমরা ঈদের নামাজ আদায় করি, একসঙ্গে আয়োজন করা হয় পূজা-অর্চনার। গ্রামটির মানুষের প্রধান জীবিকা কৃষিকাজ। সারা বছরই কৃষকেরা ব্যস্ত সময় কাটান তাঁদের ফসলের খেতে। মোটামুটি সবারই কিছু-না কিছু আবাদি জমি আছে। আর একটি বৈশিষ্ট্যের কথা বলা যায়, তা হলো, গ্রামটিতে কোনো ভিক্ষুক নেই, সবাই স্বাবলম্বী।
 জাবি বন্ধুসভা

চুনমাখা পান
আসাদ সরকার
টিন আর খড়ের তৈরি বাড়িগুলোর কয়েকটা বাঁক পরপরই জমে ওঠে আসর। সত্য পীরের পালা, থোরকা ডাঙার গান, পাঁচ ফকিরের পালা কিংবা নছিমনের গানকে কেন্দ্র করে জমে ওঠে আসর। আসর ঘিরে যে মানুষগুলো থাকে, তাদের মধ্যে নারী-পুরুষ কোনো পার্থক্য থাকে না। পারিবারিক পরিবেশে আসরে বসে একটু শ্রান্তির আশায়। এই গ্রামের একটা বিশেষ পার্থক্য হলো, গ্রামে ফসলের খেতে নারী-পুরুষ একসঙ্গে কাজ করেন।
সত্য পীরের কিংবা পাঁচ ফকিরের পালার কাহিনিতে তাই অঝোর ধারায় চোখের জল ঝরে তাদের। বারবার দেখা পালা নিয়েও মেতে ওঠে এমন আলোচনায় যেন সেবারেই প্রথম পালা দেখল সে। আসর জমিয়ে তুলতে বাড়ির গৃহিণীরা উপস্থিত হন পানের বাটা হাতে। চুনমাখা পান-সুপারিতে মুহূর্তেই সবার ঠোঁট হয়ে ওঠে রাঙা।
পালা এবং পালা নিয়ে এ আলোচনা চলে মধ্যরাত পর্যন্ত। পরের দিন ভোরে যখন সবাই ছুটতে থাকে ফসলের মাঠের দিকে, তখনো তাদের গলায় থাকে আগের রাতে শোনা গান। গলা ছেড়ে তারা গাইতে থাকে।
রোজ দিনের এমন চিত্রের এ গ্রামটি মরুয়াদহ বিলের পাশে গড়ে উঠেছে বলেই হয়তো এর নাম মরুয়াদহ গ্রাম। অনেকে বলে মরুয়াপাড়। জেলা শহর গাইবান্ধা থেকে সুন্দরগঞ্জের পথে শোভাগঞ্জ বাজারের কোল ঘেঁষে এ গ্রামের অস্তিত্ব। জন্মভূমি আমার এ গ্রামের ব্যাপারে নিশ্চিত করে বলতে পারি, এই গ্রামের মানুষের সরলতা যে কাউকেই আকৃষ্ট করবে।

ধানসিড়ি নদীর তীরে
রাব্বী আহমেদ
ছায়া সুনিবিড় শান্তির নীড় সমতুল্য আমার গ্রামের নাম শৌলজালিয়া। জীবনবাবুর ধানসিড়ি নদী বিষখালীর সঙ্গে মিশে যে মায়াময় প্রবাহ তৈরি করেছে, তারই তীর বেয়ে গড়ে উঠেছে এ গ্রাম। ঝালকাঠি জেলার কাঁঠালিয়া থানার অন্যতম প্রধান গ্রাম এটি। আমাদের গ্রাম অনেকটাই জীবনানন্দের কবিতার মতো—সবুজ ঘাস, অজস্র গাছপালা ও ধানখেত যেন গ্রামটিকে দিয়েছে নতুন এক মাত্রা। শৈশবের প্রায় সবটুকু সময় কেটেছে মায়াময় এই গ্রামে। গ্রামের প্রতিটি মানুষ, রাস্তাঘাট ও খালবিল আমার এতই আপন মনে হয় যে আজন্মকাল এরা আমার জীবনের সঙ্গে মিশে থাকবে। গ্রামের মানুষের বিচ্ছিন্ন আবেগ, ভাবনা ও ভালোবাসা—সবকিছুই অবিচ্ছিন্নভাবে ধারণ করে আমাদের গ্রাম। জীবনের সীমাহীন বাস্তবতায় গ্রাম থেকে যোজন যোজন দূরে থাকলেও মন ঠিকই পড়ে রয় গ্রামে। আর তাই বয়ে চলা সময়ের ফাঁকে একটু অবসর মিললেই ছুটে যাই গ্রামে। বুক ভরে নিই শান্তির নিঃশ্বাস। কিশোরীর ছোট্ট দেহের মতো ক্ষুদ্র এ গ্রামে সবকিছুই আছে। কখনো প্রবল জোছনায় ভেসে যায় আমাদের গ্রাম। কখনো প্রখর রোদে পথিক ছায়া খোঁজে বটতলায়।
 ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

আমার গ্রাম
শাহ আলম
চারদিকে সুনসান নীরবতা, নেই কোনো যান্ত্রিক কোলাহল, মাঝেমধ্যে অবাধ্য পাখির চিৎকার সব নীরবতার শৃঙ্খল ভেঙে প্রকৃতিকে মুখর করে তোলে। গোপালগঞ্জ জেলা শহর থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার পুবে কোটালীপাড়ায় আমাদের গ্রাম ‘লাখিরপাড়’। অন্যান্য প্রসিদ্ধ এলাকার মতো এখানে নেই কোনো পুরাকৃর্তি, জন্মগ্রহণ করেননি কোনো মহীয়সী ব্যক্তি। আছে সরলতা, অসাম্প্রদায়িক মেলবন্ধন।
গ্রামে ঢুকতেই কাঁচা রাস্তায় কাদামাটি পা জড়িয়ে অভিনন্দন জানাবে, দুই পাশের বনফুলের দল দেবে গার্ড অব অনার। ভোরবেলায় ঘর থেকে পা ফেললেই সামনের জলাশয়ের রাশিরাশি শাপলা ফুল মিষ্টি হেসে বলবে সুপ্রভাত। বর্ষাকালে পচা পাট আর কাদামাটির গন্ধে সারা গ্রাম ম-ম করে। গ্রামটির দুই পাশ দিয়ে নীরবে বয়ে গেছে মধুমতীর একটি শাখা নদী। যেটি স্থানীয়ভাবে বাবুর খাল নামে পরিচিত। এই খালে আশ্বিন মাসে নৌকাবাইচের আড়ং বসে। যেটির ঐতিহ্য ২০০ বছরেরও পুরোনো। হলফ করে বলতে পারি, আমাদের এই নৌকাবাইচ বাংলার সবচেয়ে সৌন্দর্যপূর্ণ ও দর্শনীয়। শীতকালে কুয়াশার চাদরে ঢাকা রাতে খেজুর রসের পায়েস-পিঠা খাওয়ার ধুম পড়ে যায়। গ্রামের ছোট্ট একটি বাজার, যেখানে চায়ের দোকানে ঝড় উঠে পারিবারিক কোলহল থেকে শুরু করে রাজনৈতিক আলোচনার।

No comments

Powered by Blogger.