সাভারে হলমার্ক গ্রুপের নৈরাজ্য-টিভি সাংবাদিকদের ওপর হামলা, ক্যামেরা লুট

সোনালী ব্যাংকসহ দেশের আরো কয়েকটি ব্যাংকের কর্মকর্তাদের হাত করে দুই হাজার কোটি টাকা ঋণ নেওয়া হলমার্ক গ্রুপ এখন সাভারে পেটোয়া বাহিনী ও সন্ত্রাসী দ্বারা পরিবেষ্টিত। এমনকি গণমাধ্যমকর্মীরাও তথ্যের জন্য গিয়ে এ বাহিনীর মারধরের শিকার হচ্ছেন।


গতকাল মঙ্গলবার বৈশাখী টেলিভিশনের সিনিয়ার রিপোর্টার দিপু সারোয়ার, সাভার প্রতিনিধি আবদুল হালিম, ক্যামেরাম্যান মো. বেলাল হোসেন ও গাড়ির চালক আনোয়ার হোসেনের ওপর এ ধরনের হামলা হয় বলে বেসরকারি এই টিভির সাংবাদিকরা জানিয়েছেন।
বৈশাখী টিভির সাভার প্রতিনিধি আবদুল হালিম ও ক্যামেরাম্যান মো. বেলাল হোসেন কালের কণ্ঠকে জানান, দিপু সারোয়ারাসহ তাঁরা মোট চারজন গতকাল দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে হেমায়েতপুরে হলমার্ক গ্রুপের অফিসে যান সংবাদ সংগ্রহ করতে। গেটে বাধা দেওয়া হলে দিপু সারোয়ার প্রতিষ্ঠানটির জেনারেল ম্যানেজার শামীম আল মামুনের সঙ্গে মোবাইলে কথা বলেন। এরপর তাঁদের গেটে অপেক্ষা করতে বলা হয়। দুপুর পৌনে ১টার দিকে ওয়্যারলেস সেটধারী ২০-২৫ জন লোকসহ শতাধিক লোক লাঠিসোঁটা নিয়ে তাঁদের ওপর হামলা করে। তারা দিপু সারোয়ার, আবদুল হালিম ও ক্যামেরাম্যান মো. বেলাল হোসেনকে মারধর করে এবং ক্যামেরাম্যান মো. বেলাল হোসেনের হাতে থাকা আনুমানিক ১০ লাখ টাকা মূলের একটি ক্যামেরা, লোগোসহ লক্ষাধিক টাকার একটি মাইক্রোফোন ও অন্যদের কাছ থেকে দুটি দামি মোবাইল ফোনসেট ছিনিয়ে নিয়ে যায়। আবদুল হালিম কালের কণ্ঠকে বলেন, সন্ত্রাসীরা তাঁদের মেরে ফেলে গুম করার হুমকি দেয়। একপর্যায়ে তাঁরা কোনো রকমে প্রাণ নিয়ে ফিরে আসেন এবং সাভার মডেল থানায় অভিযোগ করেন। পরে পুলিশ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে।
ক্যামেরাম্যান বেলাল হোসেন মিরন বলেন, এ ঘটনার পর তিনি সাভার মডেল থানায় একটি লিখিত অভিযোগ দিলেও থানায় কর্তব্যরত কর্মকর্তা তাঁর অভিযোগটি আমলে না নিয়ে সন্ধ্যায় আসতে বলেন। যোগাযোগ করা হলে সাভার মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ মো. আসাদুজ্জামান বলেন, অভিযোগ করার সময় তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে দায়িত্ব পালন করছিলেন। সন্ধ্যায় থানায় ফিরে হলমার্ক নিয়ে সাংবাদিকদের বিষয়টি দেখবেন বলে জানান তিনি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অপর এক সাংবাদিক জানান, ঢাকার একটি পত্রিকার আলোকচিত্র সাংবাদিকসহ তিনি সম্প্রতি প্রতিষ্ঠানের দখল করা জমি ও ওই এলাকার ছবি তুলতে গেলে সন্ত্রাসীরা তাঁদের ধাওয়া করে। তাঁরা দ্রুত মোটরসাইকেল নিয়ে ওই এলাকা ছাড়তে বাধ্য হন।
অনুসন্ধানে জানা যায়, সাভারের তেঁতুলঝোড়া ইউনিয়নে অবস্থিত হলমার্ক গ্রুপ কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে বহু মানুষের জমি দখলের অভিযোগে থানায় গত এক বছরে দুটি মামলা ও ২৭টি জিডি করা হয়। এ ছাড়া পুলিশ আরো শতাধিক অভিযোগ আমলে নেয়নি বলেও এলাকাবাসী জানান।
জানা যায়, একের পর এক জমি দখল ও জলাশয় ভরাটের অভিযোগ ওঠায় সরজমিন তদন্তে গিয়ে পরিবেশ অধিদপ্তর হলমার্ক গ্রুপকে ৪০ লাখ টাকা জরিমানা করে। গত ৯ জুন হলমার্ক গ্রুপের জেনারেল ম্যানেজার তুষার আহমেদ পরিবেশ অধিদপ্তরে দেওয়া এক অঙ্গীকারপত্রে সাভারের হেমায়েতপুরে ১০০ একর জমি ভরাট করার কথা স্বীকার করে মুচলেকা দিয়েছিলেন। এ অপরাধে তাদের বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫ (সংশোধিত ২০১০)-এর ৭ ধারা মোতাবেক ৪০ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। পর দিন প্রতিষ্ঠানটি একটি পে-অর্ডারের মাধ্যমে জরিমানার ৪০ লাখ টাকা পরিবেশ অধিদপ্তরে জমাও দেয়। কিন্তু মন্ত্রণালয়ের হস্তক্ষেপে তা বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা দেওয়া যায়নি। এক সপ্তাহ পরই হলমার্ক গ্রুপ মন্ত্রণালয়ের ঢাকা অঞ্চলের আপিল আদালতে ওই জরিমানার ব্যাপারে সংক্ষুব্ধতার কথা জানিয়ে আপিল করে। শুনানি শেষে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (পরিবেশ) অপরূপ চৌধুরী ৪০ লাখ টাকার জরিমানা কমিয়ে চার লাখ টাকা করে দেন এবং হলমার্ক গ্রুপকে পরিবেশ ছাড়পত্র দিতে পরিবেশ অধিদপ্তরকে নির্দেশ দেন। এ নির্দেশের পর হলমার্ক গ্রুপ ৪০ লাখ টাকার চেক ফেরত নিয়ে চার লাখ টাকা জমা দেয়।
পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক (এনফোর্সমেন্ট) মোহাম্মদ মুনীর চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, হলমার্ক গ্রুপের অবৈধ কাজ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। তারা আপিল করে এবং উচ্চ আদালতে গিয়ে অনুমতি নিয়েছে। তিনি বলেন, এখনো পুরো বিষয়টি পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে।
জনতা হাউজিংয়ের প্লট মালিক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী মহিদুল হক খানের অভিযোগ, হলমার্ক গ্রুপের দখলদারি থেকে বাঁচতে 'জনতা হাউজিং প্লট মালিক সমিতি' গঠন করা হয়েছে। সমিতির নেতারা আইনি লড়াই করছেন। তিনি বলেন, হলমার্কের লোকজন তাঁর চারটি প্লটের ২২ কাঠা জমির বাউন্ডারি রাতের অন্ধকারে ভেঙে ফেলেছে। এ ব্যাপারে সাভার মডেল থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করা হয়েছে। হলমার্কের বিরুদ্ধ ভুক্তভোগীরা সাভার থানায় এ পর্যন্ত দুটি মামলা ও ২৭টি জিডি করেছেন। কিন্তু প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। পুলিশ মামলা তো নেয়ইনি, বরং একটি জিডি করতে গেলে দু-তিন দিন সময় লাগে। তিনি বলেন, এদের বিরুদ্ধে ঢাকায় সংবাদ সম্মেলন করেও প্রতিকার মেলেনি। প্লট মালিক সমিতির সভাপতি আকরাম হোসেন, আলী হোসেন, নাজমা বেগম, শহিদুল্লাহ মিয়া, শাহ আলমগীর, হারুনুর রশীদসহ অনেকের জমিই এখন হলমার্কের পেটে চলে গেছে। এসব মালিকের অনেকেই প্রবাসী হওয়ায় দখলকারীরা সুযোগ নিচ্ছে।
হেমায়েতপুর এলাকার সত্তরোর্ধ্ব বৃদ্ধ মিনহাজ উদ্দিন বলেন, এলাকার কান্দিবলিয়ারপুর মৌজার ৩৫ শতাংশ জমি ক্রয় সূত্রে প্রায় ৩৫ বছর ধরে ভোগদখল করে আসছেন তিনি। সম্প্রতি এ জমি নামমাত্র মূল্যে ক্রয়ের উদ্দেশ্যে তানভীর মাহমুদের লালিত বাহিনী মিনহাজ উদ্দিনের ওপর চাপ প্রয়োগ করে। অন্যথায় অন্য জমির মালিকদের জমির মতো তাঁর জমিও দখল করে নেওয়া হবে বলে জানিয়ে দেওয়া হয়। এমতাবস্থায় উপায়ান্তর না দেখে আইনের আশ্রয় নেন মিনহাজ উদ্দিন। থানায় মামলা করতে গেলে থানা মামলা নিতে অস্বীকৃতি জানালে একটি সাধারণ ডায়েরি (নং-১০৩৮) করেই থামতে হয় তাঁকে। তাতেও কাজ না হলে আদালতের শরণাপন্ন হন বৃদ্ধ মিনহাজ উদ্দিন ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা। দায়ের করেন পিটিশন মামলা। কিন্তু আদালতের নির্দেশ উপেক্ষা করেই মিনহাজ উদ্দিনের জমিতে নির্মাণকাজ অব্যাহত রাখে হলমার্ক গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তানভীর মাহমুদ ও তাঁর বাহিনীর সদস্যরা।
জমির মালিক বৃদ্ধ মিনহাজ উদ্দিন বলেন, 'আমার মতো এ রকম শত শত জমির মালিকের জমি রাতের আঁধারে এভাবেই জোরপূর্বক দখল করে নিয়ে গেছে হলমার্ক গ্রুপ।
অভিযোগ রয়েছে, হলমার্ক কর্তৃপক্ষ জনতা হাউজিংয়ে প্রবেশের সব কয়টি রাস্তা দখল করে এবং সরকারি রাস্তায় গেট তৈরি করে সাধারণ মানুষ ও প্লট মালিকদের চলাচল বন্ধ করে দিয়েছে। এ নিয়ে জনসাধারণের অভিযোগের পর সরকারি রাস্তা চলাচলের জন্য খুলে দিতে সাভার উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) সম্প্রতি সরেজমিন গিয়ে গেট ভাঙার আদেশ দেয়। হলমার্কের শ্রমিকরা পুলিশ ও এসিল্যান্ডের ওপর চড়াও হয়ে গাড়ি ভাঙচুর করে। এ সময় এসিল্যান্ড জীবন রক্ষার্থে গুলি চালানোর নির্দেশ দেন। পরে পুলিশ বাদী হয়ে হলমার্কের কর্মকর্তাসহ সাত হাজার শ্রমিকের বিরুদ্ধে মামলা করলেও কেউ গ্রেপ্তার হয়নি। উল্টো এসিল্যান্ডকে অন্যত্র বদলি করা হয়েছে।
আরেক ভুক্তভোগী অ্যাডভোকেট মোশারফ হোসেন বলেন, তাঁর পাঁচ কাঠা জমির চারদিকের সীমানা প্রাচীর ও বাড়ি ভেঙে দখল করে নিয়েছে হলমার্ক গ্রুপ। এ ব্যাপারে সাভার থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করা হয়েছে। কিন্তু পুলিশ কিছুই করেনি।
এ ব্যাপারে সাভার মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) আসাদুজ্জামান জানান, হলমার্ক গ্রুপে আগে কী হয়েছে, তা তিনি জানেন না। তিনি সাভার মডেল থানায় যোগদানের পর সব বিষয় খতিয়ে দেখা হচ্ছে। তিনি বলেন, 'অভিযোগ পেলে পুলিশ ব্যবস্থা নেবে। আসলে থানায় অভিযোগ করার পর অনেকেই বেশি দাম পেয়ে তাঁর জমি বিক্রি করে চলে গেছেন। তাঁদের মধ্যে ব্যবসায়ী, চিকিৎসক, সেনা কর্মকর্তা ও আইনজ্ঞ রয়েছেন। হলমার্ক গ্রুপ এখন কোনো জমি দখল করছে না। তারা ব্যাংকের ঝামেলা নিয়ে এখন ব্যস্ত আছে।'
অভিযোগ প্রসঙ্গে হলমার্ক গ্রুপের জেনারেল ম্যানেজার (জিএম) শামীম আল মামুন বলেন, সব অভিযোগ মিথ্যা। তাঁরা কারো কোনো জমি দখল করেননি, সব জমি বৈধভাবে কেনা।

No comments

Powered by Blogger.