বিদেশে চাকরির পথ বন্ধ হচ্ছেঃ এবার ঝেড়ে কাশুন

বেহাত হয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশের জনশক্তি রফতানির প্রধান প্রধান বাজার। কোনো কোনো দেশের বাজার বন্ধ হয়েছে স্থায়ীভাবে। কোথাও আবার বন্ধ হওয়ার আশঙ্কার মুখে আছে। আশ্বাসে বিশ্বাস করে শেষ পর্যন্ত কোনো ইতিবাচক ফল হয়নি। ক্রমেই বিদেশ থেকে বাংলাদেশীদের ফেরত আসার সংখ্যা বাড়ছে। নানা ধরনের জটিলতা ও দীর্ঘদিনের অবহেলার কারণে দেখা দিয়েছে এই দুঃখজনক পরিণতি।

এ অবস্থায় বর্তমান সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে কূটনৈতিক তত্পরতা লাগসই না হওয়ায় বিদেশে শ্রমবাজার খুলছে না, কমছে না নতুন করে বন্ধ হওয়ার ঝুঁকিও। সেই অপারগতার প্রায়শ্চিত্ত করতে হচ্ছে শ্রমজীবী মানুষদের। জনশক্তি রফতানি বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের অন্যতম প্রধান খাত। এখাতে এ ধরনের দুর্দশা নেমে আসা মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘায়ের শামিল। জানা গেছে, জনশক্তি রফতানির প্রধান বাজার সৌদি আরব, মালয়েশিয়া, কুয়েত, কাতার, ওমান স্থায়ীভাবে বন্ধ হতে চলেছে। ক্রমান্বয়ে বন্ধ হতে থাকা এসব বাজার আবার চালু হওয়ার কথা থাকলেও সরকারি ব্যর্থতার কারণে শেষ পর্যন্ত তা হয়নি। এসব দেশে জনশক্তি রফতানির দিক থেকে বাংলাদেশ শীর্ষে থাকলেও এখন তারা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। সঙ্কট উত্তরণে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় কার্যকর কিছু করতে পারছে না। সংশ্লিষ্ট দেশের দূতাবাসগুলোতে চিঠি চালাচালি পর্যন্তই উদ্যোগ সীমাবদ্ধ রয়েছে। এদিকে জনশক্তি রফতানিকারকদের সংগঠন বায়রা এ নিয়ে সরকারের সঙ্গে বৈঠক করার আবেদন করেও সাড়া পাচ্ছে না। অভিজ্ঞ ব্যবসায়ীরা মনে করছেন, গত বছরের তুলনায় এ বছর জনশক্তি রফতানি নেমে যাবে অর্ধেকেরও নিচে। এতে সংশ্লিষ্ট সবাই মারাত্মক অর্থনৈতিক ক্ষয়ক্ষতি সম্মুখীন হবেন। বায়রা সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে ৮৫ শতাংশ ব্যবসায়ী বেকার। বেতন দিতে না পারায় অফিসে যেতে পারছেন না কর্মকর্তারা।
এক হিসাব মতে, ২০০৯ সালে যেখানে প্রতি মাসে গড়ে ৩০ হাজার লোক চাকরি নিয়ে বিদেশে গিয়েছে, সেখানে চলতি বছর ফেব্রুয়ারিতে গিয়েছে মাত্র ২৭ হাজার, যা গত তিন বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। ব্যবসায়ীদের মতে, এখন বেশিরভাগ যাচ্ছেন পুরনো কার্যাদেশ ও ব্যক্তিগত সম্পর্কের ভিত্তিতে। আরেকটি অংশ যাচ্ছে ইরাক, মালয়েশিয়াসহ কয়েকটি ঝুঁকিপূর্ণ দেশে ট্যুরিস্ট বা ভুয়া ভিসায়। এদের পরিণতি নিঃসন্দেহে অনিশ্চিত। এর মধ্যে ভুয়া ভিসার মাধ্যমে মালয়েশিয়া লোক পাচার করছে একশ্রেণীর ব্যবসায়ী। এদের বেশিরভাগ সেখানে গিয়ে মানবেতর জীবন কাটাচ্ছে, কেউ জেল খাটছে। এই পাচার কাজের সঙ্গে ইমিগ্রেশনের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের যোগসাজশ রয়েছে বলে অভিযোগ আছে। ইরাক, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ডের বেলায়ও এ ধরনের ঘটনা ঘটছে। কিন্তু প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় এ নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে বলে মনে হয় না। এদিকে বিদেশে লোক যাওয়া কমে যাওয়ায় সরকারের ভ্রমণ কর আদায়ও কমে গেছে।
এত সবের পরও কোনো আশার কথা শোনাতে পারছে না সরকার। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর কুয়েত সফরের পরও সেখানকার শ্রমবাজার খুলে দেয়ার ব্যাপারে আশাপ্রদ কোনো খবর পাওয়া যায়নি। কুয়েত-বাংলাদেশ চুক্তিতেও বন্ধ শ্রমবাজার খোলার ব্যাপারে কোনো উল্লেখ ছিল না। সৌদি আরবে প্রায় দু’বছর জনশক্তি রফতানি বন্ধ। সেখানেও প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী সফরে গিয়েছিলেন, কিন্তু ফলাফল সুখপ্রদ নয়। এদিকে প্রধানমন্ত্রী মালয়েশিয়া সফরে যাবেন বলে শোনা যাচ্ছে। এবার কিছু একটা হবে বলে আশা করছেন অনেকে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বেশিরভাগ বাংলাদেশী প্রবাসী থাকেন সৌদি আরব, কুয়েত ও মালয়েশিয়ায়। অন্তত এই তিন দেশের বাজার চালু না করতে পারলে জনশক্তি রফতানি খাতে ধস নামতে বাধ্য।
এদিকে জনশক্তি রফতানির সঙ্গে জড়িত চিহ্নিত কিছু দালাল, কিছু রফতানিকারক সংস্থা, মন্ত্রণালয়ের আশীর্বাদপুষ্ট দুর্নীতিবাজ কিছু লোক শ্রমিক প্রতারণার মাধ্যমে কোটি কোটি টাকার মালিক বনেছেন। সরকার তাদের টিকিটিও ছুঁয়ে দেখেনি। তদন্ত করতে গিয়ে তদন্তকারী দল এবং টাস্কফোর্সের সদস্যরাও জড়িয়েছেন মোটা টাকার দুর্নীতিতে। শিয়ালের কাছে মুরগি বর্গা দিলে যা হয়! ফলে দেশে ফিরে আসছে সর্বস্বান্ত শ্রমিক, কেউ ডাস্টবিন থেকে উচ্ছিষ্ট খাচ্ছেন বিদেশে, আত্মহত্যা করেছেন অনেকে, মারা গেছেন হার্ট অ্যাটাকে। সব জেনেশুনেও সরকারের টনক নড়ছে না। সার্বিক পরিস্থিতি নিজেদের অনুকূলে আনার জন্য কার্যকর তত্পরতার কোনো আলামত নেই। আশ্চর্যের বিষয়, এখনও ওমানে রাষ্ট্রদূতের পদটি খালি রয়েছে। সেখানে প্রাথমিক কূটনৈতিক তত্পরতা পর্যন্ত চালানো যাচ্ছে না। অথচ এই অতি প্রয়োজনীয় খাতটিকে চাঙ্গা করার জন্য এযাবত সরকার পক্ষ থেকে বিস্তর বুলি কপচানো হয়েছে। আর কত? এবার ঝেড়ে কাশুন।

No comments

Powered by Blogger.