আজ লাঙ্গলবন্দের মহাস্নান by তারাপদ আচার্য্য

আদিকালে জলের মধ্যেই ঘটেছিল প্রথম প্রাণের সঞ্চার। জলচর প্রাণীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ তত্কালীন প্রাণিজগতে ঈশ্বরের উপস্থিতি তাই মত্স্যরূপেই ছিল স্বাভাবিক। ক্রমে ক্রমে স্থলভাগেও প্রাণীর অস্তিত্ব প্রসারিত হলো। সৃষ্টি হলো উভয়চর প্রাণীর। ঈশ্বর পৃথিবীতে এলেন কুর্ম হয়ে। প্রাণিজগতে জলের তুলনায় স্থলভাগের প্রাধান্য ও বৈচিত্র্য বাড়তে লাগল। ঈশ্বর এলেন স্থলচর প্রাণী বরাহ হয়ে।

স্থলচর প্রাণিকুলে পশুত্ব ভেদ করে ধীরে ধীরে ঘটতে থাকল মনুষ্যত্বের স্ফুরণ। সৃষ্টির এই অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে স্রষ্টা তখন নৃসিংহ। অর্ধেক নর অর্ধেক পশু। তারপর এলো ক্ষুদে মানুষের যুগ। বামন অবতার জানিয়ে দিলেন ত্রিভুবনে মানুষের পদস্পর্শ ঘটার দিন আগত। এভাবেই বিবর্তনের পঞ্চম ধারা অতিক্রম করে বিষ্ণু এলেন পূর্ণাঙ্গ মানুষরূপে। তিনিই পরশুরাম। এরই মধ্যে প্রাণিজগতে স্বাভাবিক মানুষের আবির্ভাবই শুধু ঘটেনি, মানবজাতি সত্যযুগ অতিক্রম করে এসেছে। ঘর বেঁধেছে, সংসার করতে শিখেছে, শিখেছে সমাজ গড়তে, রাজ্য চালাতে, আত্মরক্ষা করতে এবং আক্রমণ চালাতে। পরশুরামের হাতে তাই হরধনু। হবেই তো। যিনি হর তিনিই তো হরি। ত্রেতাযুগে আবির্ভূত পরশুরাম বিষ্ণুর ষষ্ঠ অবতার এ কথা যেমন সত্য, তিনি পূর্ণাঙ্গ মানুষরূপে বিষ্ণুর প্রথম অবতার এ কথাও সমান সত্য। এই মানবরূপী ঈশ্বর মানুষের পাপ মোচনের জন্য স্থান নির্ধারণ করলেন লাঙ্গলবন্দে। ধন্য মহাতীর্থ লাঙ্গলবন্দ, ধন্য বাংলাদেশের মানুষ, ধন্য আমার বাংলাদেশ। ত্রেতাযুগ থেকে নিরবচ্ছিন্ন ধারায় পাপ মোচনের নীরব সাক্ষী হয়ে লাঙ্গলবন্দের অবস্থান আজও অম্লান। অশোকাষ্টমী তিথিতে এই মহাতীর্থে স্নানরত মানুষ হয়ে ওঠে দেবতা। দেবত্বের স্ফুরণের মধ্য দিয়ে প্রকাশ ঘটে আলোকিত মনুষ্যত্বের। সব পাপ পঙ্কিলতা ধুয়ে-মুছে সাফ হয়ে যায়।
পৌরাণিক কাহিনী থেকে জানা যায়, ত্রেতাযুগের সূচনাকালে মগধ রাজ্যে ভাগীরথীর উপনদী কৌশিকীর তীর ঘেঁষে এক সমৃদ্ধ নগরী ছিল, যার নাম ভোজকোট। এই নগরীতে গাধি নামে চন্দ্রবংশীয় একজন রাজা ছিলেন। গাধির ছিল এক ছেলে ও এক মেয়ে। গাধিপুত্র বিশ্বামিত্র পরবর্তী সময়ে সাধনা বলে মহর্ষি হয়ে জগত আলোকিত করেন। ক্ষত্রীয়কুলে জন্ম হলেও মহর্ষির স্বীকৃতিলাভের জন্য বশিষ্ঠ মুনির সঙ্গে বিশ্বামিত্রের দ্বন্দ্ব পৌরাণিক কাহিনীর এক চমত্কার সংযোজন। সেই দ্বন্দ্বে বশিষ্ঠ মুনি ছিলেন অটল এবং নির্বিকার। দ্বন্দ্ব চলাকালীন ধীরে ধীরে বিশ্বামিত্রের মধ্যে ক্ষত্রীয় সুলভ ক্রোধের প্রশমন এবং ব্রহ্মতেজের স্ফুরণ ঘটে। বিশ্বামিত্রের বোন সত্যবতী ছিলেন অসামান্য রূপসী। সত্যবতী বয়ঃপ্রাপ্ত হলে ভৃগুবংশীয় এক ব্রাহ্মণ সন্তান রিচিকের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। পরে রিচিক মুনির ঔরসে সত্যবতীর গর্ভে জমদগ্নি নামে এক পুত্রের জন্ম হয়। এই ঋষি জমদগ্নিই হচ্ছেন পরশুরামের বাবা। ঋষি জমদগ্নির পাঁচ পুত্রসন্তানদের মধ্যে প্রথম সন্তানের নাম রুষন্নন্ত, দ্বিতীয় পুত্রের নাম সুষেণ, তৃতীয় পুত্রের নাম বসু, চতুর্থ পুত্রের নাম বিশ্বাসুর, পরশুরাম ছিলেন সবার ছোট; অর্থাত্ পঞ্চম পুত্র।
লাঙ্গলবন্দের ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখতে পাই—
একদিন পরশুরামের মা রেণুকাদেবী জল আনতে গঙ্গার তীরে যান। সেখানে পদ্মমালী (মতান্তরে চিত্ররথ) নামক গন্ধর্বরাজ স্ত্রীসহ জলবিহার করছিলেন (মতান্তরে অপ্সরীগণসহ)। পদ্মমালীর রূপ এবং তাদের সমবেত জলবিহারের দৃশ্য রেণুকাদেবীকে এমনভাবে মোহিত করে যে, তিনি তন্ময় হয়ে সেদিকে তাকিয়ে থাকেন। অন্যদিকে ঋষি জমদগ্নির হোমবেলা পেরিয়ে যাচ্ছে সেদিকে তার মোটেও খেয়াল নেই। সম্বিত ফিরে রেণুকাদেবী কলস ভরে ঋষি জমদগ্নির সামনে হাত জোড় করে দাঁড়ান। তপোবলে ঋষি জমদগ্নি সবকিছু জানতে পেরে রেগে গিয়ে ছেলেদের মাতৃহত্যার আদেশ দেন। প্রথম চার ছেলে মাকে হত্যা করতে অস্বীকৃতি জানান। কিন্তু পরশুরাম পিতার আদেশে মা এবং আদেশ পালন না করা ভাইদের কুঠার দিয়ে হত্যা করেন। পরবর্তীকালে পিতা খুশি হয়ে বর দিতে চাইলে তিনি মা এবং ভাইদের প্রাণ ফিরে চান। তাতেই রাজি হন ঋষি জমদগ্নি। কিন্তু মাতৃহত্যার পাপে পরশুরামের হাতে কুঠার লেগেই রইল। শত চেষ্টা করেও সে কুঠার খসাতে পারলেন না তিনি। পিতার কাছে জিজ্ঞাসা করলেন তার পাপ মুক্তির উপায়ের কথা। পিতা বললেন, তুমি মাতৃহত্যা ও স্ত্রীলোক হত্যা—এই দুই পাপে আক্রান্ত হয়েছ, তাই তোমাকে তীর্থে তীর্থে ঘুরতে হবে, যে তীর্থের জলের স্পর্শে তোমার হাতের কুঠার খসে যাবে; মনে রাখবে সেই তীর্থই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম তীর্থস্থান। পিতার কথা মতো পরশুরাম তীর্থে তীর্থে ঘুরতে লাগলেন। শেষে ভারতবর্ষের সব তীর্থ ঘুরে ব্রহ্মকুণ্ডের পুণ্য জলে স্নান করে তাঁর হাতের কুঠার খসে গেল।
পরশুরাম মনে মনে ভাবলেন, এই পুণ্য বারিধারা সাধারণ মানুষের জন্য উন্মুক্ত করে দিলে মানুষ খুব উপকৃত হবে। তাই তিনি হাতের খসে যাওয়া কুঠারকে লাঙ্গলে রূপান্তর করে পাথর কেটে হিমালয়ের পাদদেশ থেকে মর্ত্যলোকের সমভূমিতে সেই জলধারা নিয়ে আসেন। লাঙ্গল দিয়ে সমভূমির বুক চিরে দক্ষিণ দিকে অগ্রসর হন তিনি। ক্রমাগত ভূমি কর্ষণজনিত শ্রমে পরশুরাম ক্লান্ত হয়ে পড়েন এবং বর্তমান নারায়ণগঞ্জ জেলার বন্দর থানার অন্তর্গত সোনারগাঁওয়ে এসে তিনি লাঙ্গল চালানো বন্ধ করেন। এ জন্য এ স্থানের নাম হয় লাঙ্গলবন্দ। এরপর এ জলধারা কোমল মাটির বুকচিরে ধলেশ্বরী নদীর সঙ্গে মিশেছে। পরবর্তীকালে এই মিলিত ধারা বঙ্গোপসাগরে গিয়ে পড়েছে।
লাঙ্গলবন্দ ছাড়াও এ নদের বিভিন্ন স্থানে পুণ্যার্থী ভক্তরা স্নান করে অশেষ পুণ্য লাভ করেন। আসামের কামরুপে কামাখ্যাদেবীর মন্দির থেকে আধামাইল দূরে ব্রহ্মপুত্রে স্নানের স্থান। এরই কাছে পাণ্ডুঘাট। পঞ্চপাণ্ডবের বাবা পাণ্ডু রাজা এ ঘাটে স্নান করেছিলেন কিনা তা পুরাণ গ্রন্থসমূহে স্পষ্ট নয়। তবে কথিত আছে পুরনো ব্রহ্মকুণ্ডের অবস্থান ছিল এখানেই। বর্তমানে কুণ্ডটি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। চৈত্র মাসের শুক্লাষ্টমী (অশোকাষ্টমী) তিথিতে ব্রহ্মপুত্রে পুণ্যস্নান শাস্ত্রোক্ত মতে নির্ধারিত। হিন্দু ঐতিহ্য অনুসারে এদিন ব্রহ্মার আদেশে পৃথিবীর সব তীর্থ এসে ব্রহ্মপুত্র নদের সঙ্গে মিলিত হয়। অশোকাষ্টমী তিথিতে নারায়ণগঞ্জ জেলার লাঙ্গলবন্দ ছাড়াও ময়মনসিংহ জেলার মঠখোলা গ্রামে ব্রহ্মপুত্র নদে স্নানোত্সব উপলক্ষে বহু মানুষের সমাগম এবং বিরাট মেলা হয়।
ওইদিন ব্রহ্মপুত্র পৃথিবীর সবচেয়ে বড় তীর্থে পরিণত হয়। পুণ্য তিথিতে স্নানমন্ত্র পাঠ করে নিজ নিজ ইচ্ছা অনুযায়ী ফুল, বেলপাতা, ধান, দুর্বা, হরীতকী, ডাব, আমের পল্লব প্রভৃতি দিয়ে তপর্ণপূর্বক ব্রহ্মপুত্র স্নানে সব পাপমুক্ত হয়ে আশাতীত পুণ্য অর্জন করা যায়। আর সে আশাতেই বাংলাদেশসহ নেপাল, ভারত, শ্রীলংকা থেকে আসবে হাজার হাজার পুণ্যার্থী। তারা হাজারো কষ্ট সহ্য করে থাকবে পুণ্য তিথিতে স্নানের অপেক্ষায়।
লাঙ্গলবন্দের ঐতিহাসিক গুরুত্ব অপরিসীম। আজ থেকে পাঁচশ’ বছর আগে শ্রী শ্রীচৈতন্যদেব লাঙ্গলবন্দে স্নান করতে এসেছিলেন। তাঁর নামে এখানে একটি মন্দির আছে। ১৯০১ সালে এসেছিলেন সনাতন ধর্মের বরপুত্র স্বামী বিবেকানন্দ। তিনি শিষ্য ও আত্মীয়সহ স্নান করেছিলেন রাজঘাটে। এ রাজঘাটে নেপালের রাজারা স্নান করতেন বলে লোকমুখে শোনা যায়। লাঙ্গলবন্দেই বিসর্জিত হয়েছে ভারতের জাতিরজনক মহাত্মা গান্ধীর চিতাভস্ম, ওই ঘাট গান্ধীঘাট নামে পরিচিত। স্নানের দিনে এখানে বিরাট মেলা বসে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে নানা জিনিস বিক্রির জন্য ব্যবসায়ীরা নিয়ে আসেন। স্নান উপলক্ষে পুণ্যার্থীদের সেবা প্রদানের জন্য বিভিন্ন সংগঠন ও সংঘ স্বেচ্ছায় অংশগ্রহণ করে থাকে। বর্তমানে এখানে বহু পুরনো প্রায় ধ্বংস হয়ে যাওয়া ১১টি মন্দির, জরাজীর্ণ ১৩টি স্লান ঘাট, অতিথিদের থাকার জন্য ভাঙাচোরা ৭টি আশ্রম এবং একই রকমের ৩টি আশ্রয় শিবির রয়েছে। প্রায় সাড়ে তিন কিলোমিটারব্যাপী এ তীর্থক্ষেত্রটি অস্তিত্ব রক্ষার অপারগতা প্রকাশ করছে প্রতিনিয়ত। গঠনমূলক কোনো ব্যবস্থা না থাকায় মন্দিরগুলো সংস্কার ও সংরক্ষণের অভাবে লুপ্ত প্রায়। প্রাচীন ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রাখতে এ ক্ষেত্রটি হতে পারে একটি পর্যটন কেন্দ্র।
লেখক : সাধারণ সম্পাদক, সাধু নাগ মহাশয় আশ্রম
নাগবাড়ি, নারায়ণগঞ্জ

No comments

Powered by Blogger.