আল বিদা মাহে রমজান by অধ্যাপক মনিরুল ইসলাম রফিক

দেখতে না দেখতেই কিভাবে যেন মাহে রমজান ও এর ইফতার-সাহরী ও তারাবির আনন্দ নিঃশেষিত হতে চলেছে। আজ পবিত্র জুমা, জুমাতুল বিদা! মাহে রমজানুল মোবারককে আনুষ্ঠানিক বিদায় জানানোর হৃদয়ভাঙ্গা দিবস। ২/১দিন পরই ঈদ-উল-ফিতর। একদিকে সিয়ামের পরিবেশ হারানোর বেদনা।


অন্যদিকে রমজান মাসে অনেক মধুময় বিষয় ও স্মৃতি আয়ত্ত করার আনন্দ বা ঈদ। দুটো যেন আজ একাকার। এর মাধ্যমে সত্যিকারের সাধকরা সত্যি সত্যি ইসলামের সঠিক সুন্দর হিদায়াতের পথপ্রাপ্ত হন।
হযরত রাসূলে কারীম (স.) বলেছেন : সর্বোত্তম দিন হলো জুমার দিন। এ দিনে হযরত আদমকে (আ) সৃষ্টি করা হয়েছে। এ দিনে তাঁকে জান্নাতে দাখিল করা হয়েছে, এ দিনে হযরত আদমকে (আ) জান্নাত থেকে দুনিয়ায় পাঠানো হয়েছে এবং এ দিনেই কিয়ামত সংঘটিত হবে। -(মুসলিম শরীফ ১ম খ-)। জ্বিন এবং ইনসান ব্যতীত সকল প্রাণী শুক্রবার দিন সুবহে সাদিক থেকে সূর্যোদয় পর্যন্ত, কিয়ামত সংঘটিত হওয়ার ভয়ে সন্ত্রস্ত হয়ে অপেক্ষমাণ থাকে। এ শুক্রবার দিন এমন একটি সময় আছে, যে সময় কোন মুসলিম বান্দা নামাজ আদায়রত অবস্থায় আল্লাহর কাছে যে কোন জিনিসের প্রার্থনা করবে আল্লাহ্ তাকে তা দান করবেন। হযরত সালমান ফারসী (রাদি) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (স.) বলেছেন : যে ব্যক্তি জুমার দিন যথাযথভাবে গোসল ও পবিত্রতা অর্জন করে এবং নিজের কেশরাজিতে তৈল মেখে অথবা সুগন্ধি ব্যবহার করে নামাজের জন্য মসজিদের উদ্দেশে রওনা হয় এবং মসজিদে এসে দুই ব্যক্তির মাঝে ফাঁক করে না, তারপর যে পরিমাণ নফল নামাজ তার জিম্মায় নির্ধারিত তা আদায় করে, এরপর ইমাম সাহেবের খুৎবা পাঠ করার সময় চুপ করে বসে খুৎবা শ্রবণ করে, আল্লাহ তায়ালা তার বিগত জুমা থেকে বর্তমান জুমা পর্যন্ত যাবতীয় গুনাহ মাফ করে দিবেন।- (বুখারী)।
মাহে রমজানের জুমা অন্য এগারো মাসের জুমা থেকে আরও বেশি ফজিলত ও বরকতের তা বলাই বাহুল্য। কেননা এ মাসের প্রত্যেক ফরজ ইবাদতের সাওয়াব ৭০ গুণ বেশি। আর ‘জুমাতুল বিদা’ মানে পবিত্র রমজান মাসের বিদায়ের বার্তাবাহী জুমা। মু’মিন মুসলমানগণ পরম আহ্লাদ ও বিশেষ মর্যাদায় পালন করে থাকেন এ দিবসটি। রমজানুল মুবারক ক্রমাগত শেষ হয়ে এলে ২টি দিবসের প্রতি তারা বিশেষ আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে থাকে। একটি হলো পবিত্র শব-ই- কদর, অপরটি হলো জুমাতুল বিদা। আজ পবিত্র জুমাতুল বিদার ফজিলত প্রাপ্তির সময়।
জুমাতুল বিদার খুৎবায় থাকে মাহে রমজানের বিদায়বার্তা। মসজিদের ঈমাম বা খতিব যখন অত্যন্ত হৃদয়গ্রাহী ভাষায় তা বর্ণনা করেন তখন দিকে দিকে করুণ ও কাতর দৃশ্যের উদ্ভব হয়। রমজানের বিদায়ী সানাই শোনে মুসল্লিগণ হতবিহ্বল হয়ে পড়েন। এ সময় মুসল্লিগণ তাওবায় অংশ নেন। কায়মনোবাক্যে অতীতের ভুলত্রুটির জন্য অনুশোচনা ব্যক্ত করেন। নিজের জন্য ও ময়-মুরব্বি আওলাদ ফরজন্দ, সর্বোপরি দেশ-জাতির মঙ্গল কামনায় সকলে অভিন্ন কণ্ঠে ফরিয়াদ করেন। তাই জুমাতুল বিদা বস্তুতই ইবাদত বন্দেগীর, তাওবা, ইস্তিগফারের, মাহে রমজানের বিদায় বেলায় আনুষ্ঠানিক আত্মোপলব্ধির ও বিশেষ মুনাজাতের। আমরা যেন পূর্ণ মর্যাদা ও ভাবগম্ভীর পরিবেশে তা উদযাপন করি।
একইভাবে দীর্ঘ এক মাস সিয়াম সাধনার পর এখন পবিত্র ঈদ-উল-ফিতর অত্যাসন্ন। ঈদ-উল-ফিতর মানে রোজা ভাঙ্গার উৎসব। গত একমাস ধরে সিয়াম সাধনার মধ্যে দিয়ে রোজাদার যে কঠিন পরীক্ষায় অবতীর্ণ হয়েছে, আজ তা থেকে উত্তীর্ণের সময় ক্রমেই ঘনিয়ে এসেছে। চতুর্দিকে তাই আজ ঈদের আমেজ সুস্পষ্ট। মুসলিম সমাজ জীবনে ঈদ-উল-ফিতরের অবারিত আনন্দধারার তুলনা চলেনা। কারণ, প্রথমত এ আনন্দ- উৎসবের আমেজ গরিবের পর্ণ কুটির হতে ধনীর বালাখানা পর্যন্ত সমানভাবে মুখরিত। শহর নগর গ্রাম গঞ্জ সর্বত্র এর ঢেউ বি¯ৃÍত। দ্বিতীয়ত এ আনন্দ অতি পবিত্র ও নির্মল। এখানে বাড়াবাড়ি নেই, অতিরঞ্জিতের কোন স্থান নেই। আছে আত্মত্যাগ, অন্যকে কাছে টানার ও ইবাদতের মাধ্যমে আল্লাহ্ তা’য়ালার নৈকট্য লাভের সমন্বিত কর্মসূচী।
বস্তুত রমজান যেমন সাধনার মাস এতে সিয়াম, কিয়ামসহ কঠিন ইবাদতসমূহের মাঝামাঝি রয়েছে ইফতার সাহরীর আনন্দদায়ক মুহূর্তগুলো, তেমনি ঈদ-আনন্দও কিছু বিধিনিষেধে পরিপূর্ণ যা অনিয়মতান্ত্রিকতাকে নিরুৎসাহিত করে এক সুশৃঙ্খল ও ধারাবাহিক দায়িত্ব কর্তব্য স্মরণ করিয়ে দেয়। যেমন : ঈদের নামাজের প্রাক্কালে কিছু মুস্তাহাব কাজ করার বিধান রয়েছে। তন্মধ্যে- ১. ঈদগাহে গমনের পূর্বে ফজরের পর কোন মিষ্টি জাতীয় খাবার গ্রহণ, ২. গোসল করা, ৩. মিসওয়াক করা, ৪. খুশবু ব্যবহার করা, ৫. উত্তম কাপড় চোপড় পরিধান করা ৬. ঈদের নামাজে গমনের পূর্বে সাদকাতুল ফিতর আদায় করা ৭. প্রত্যুষে বিছানা ত্যাগ করা, ৮. সকাল সকাল ঈদগাহে উপস্থিত হওয়া, ৯. হেঁটে হেঁটে ঈদগাহ অভিমুখে গমন করা, ১০. চলতে পথে নিচু কণ্ঠে তাকবির বলে যাওয়া (তাকবীর ‘আল্লাহু আকবর, আল্লাহু আকবর, লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু আল্লাহু আকবর ওয়ালিল্লাহিল হামদ্)। ১১. এক পথে যাওয়া, ভিন্ন পথে আসা, ১২. সাজগোছ করা, ১৩. উন্মুক্ত আকাশের নিচে খোলা ময়দানে ঈদের নামাজ আদায় করা।
ঈদের আনন্দে যেন আমরা ঈদের পালনীয় আহকামগুলো ভুলে না যাই, সে দিকে আগে থেকে সতর্ক থাকতে হবে।

No comments

Powered by Blogger.