প্রতিবছর পাচার হচ্ছে ॥ হাজার কোটি টাকা- ০ জড়িত শীর্ষ ব্যবসায়ী আমলা রাজনীতিক দেশী ও বহুজাতিক কোম্পানি- ০ ট্রান্সফার প্রাইসিংয়ের মাধ্যমে বেশি অর্থ পাচার হচ্ছে- ০ শতাধিক মানিলন্ডারিংয়ের ঘটনা, ব্যাংকে সন্দেহজনক হিসাব হাজারের ওপরে -০ প্রতিরোধে আইনের খসড়া চূড়ান্ত by শাহ আলম খান

বিচিত্র উপায়ে দেশ থেকে অবৈধভাবে বিপুল পরিমাণ অর্থ বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে। ব্যক্তিপর্যায়ে শীর্ষ ব্যবসায়ী, আমলা, রাজনীতিবিদ, শিক্ষক এবং প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে একাধিক দেশী-বিদেশী ও বহুজাতিক কোম্পানি এ অর্থ পাচারের সঙ্গে জড়িত রয়েছে।


কখনও তল্পিতল্পা গুটিয়ে বিদেশে স্থায়ী বসবাসের উদ্দেশে পাড়ি জমানোর সময় অবৈধ উপায়ে বিদেশে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। কখনও ব্যক্তি কিংবা প্রতিষ্ঠানের আন্তর্জাতিক পর্যায়ে দ্বিপাক্ষিক লেনদেনে অর্থ পাচারের ঘটনা ঘটছে। এক্ষেত্রে লেনদেনকারী প্রতিষ্ঠান হয় প্রয়োজনীয় অর্থ পরিশোধের চেয়ে বেশি অর্থ পরিশোধের মাধ্যমে দেশের মূল্যবান অর্থ বিদেশে রেখে আসছে। অথবা বিদেশী ব্যবসায়িক পার্টনার কিংবা প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে প্রকৃত পাওনার চেয়ে কম অর্থ দেশে আনা হচ্ছে। এভাবে প্রকৃত মূল্য গোপন রেখে কারসাজির মাধ্যমে মূল্যবান অর্থ ডলার হয়ে বিদেশে চলে যাচ্ছে কিংবা পাচার করা হচ্ছে। খোদ জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) হিসাবেই প্রতিবছর এ জাতীয় ট্রান্সফার প্রাইসিংয়ের মাধ্যমে দেশ থেকে কমপক্ষে এক হাজার কোটি টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে বলে সংস্থাটির নির্ভরযোগ্য সূত্র নিশ্চিত করেছে। তবে অর্থ পাচারের ঘটনা এই কয়েক উপায়েই থেমে থাকছে না। সম্প্রতি এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে রাষ্ট্রকে ফাঁকি দিয়ে দেশের স্বার্থবিরোধী কাজে নিযুক্ত বিদেশী লবিস্ট ফার্মের ব্যয় নির্বাহে প্রয়োজনীয় অর্থের যোগান দেয়ার উদ্দেশ্যে অর্থ পাচারের মতো ঘটনা। বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর মাধ্যমে প্রতিবছর দেশ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকার অর্থ পাচারের ঘটনা কারও অজানা নয়। বর্তমানে বড় ধরনের শতাধিক মানিলন্ডারিংয়ের ঘটনা পৃথকভাবে এনবিআর, দুদক ও বাংলাদেশ ব্যাংকের পর্যবেক্ষণে রয়েছে। এ জাতীয় সন্দেহজনক হিসাব রয়েছে ছোটবড় মিলিয়ে হাজারের ওপরে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, বাংলাদেশ ব্যাংক ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এধরনের মানিলন্ডারিংয়ের বিষয়টি অবহিত রয়েছে। কিন্তু অভিযোগ রয়েছে বাণিজ্যিক ব্যাংকের কিংবা জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সংশ্লিষ্ট শাখার অসাধু কর্মকর্তাদের যোগসাজশেই এধরনের ঘটনা ঘটে আসছে। আবার সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা আন্তর্জাতিক মানের পর্যায়ে উন্নীত না হওয়ায়ও এধরনের অর্থ পাচারের ঘটনা গোচরে-অগোচরে প্রতিনিয়ত ঘটছে। তবে বাস্তবতা হচ্ছে কিছুতেই ঠেকানো যাচ্ছে বিদেশে অর্থ পাচারের প্রবণতা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সদস্য (আয়কর নীতি) সৈয়দ আমিনুল করিম ভূঁইয়া বলেন, বিভিন্ন সময় বিভিন্ন উপায়ে বিদেশে অর্থ পাচার হয়ে আসছে, এটা সত্য। তবে ট্রান্সফার প্রাইসিংয়ের মাধ্যমেই সবচেয়ে বেশি অর্থ পাচারের ঘটনা ঘটছে বলে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কাছে তথ্য রয়েছে। তাই ট্রান্সফার প্রাইসিং কিংবা অন্য যে কোন উপায়েই হোক অবৈধভাবে বিদেশে অর্থ পাচার ঠেকাতে এনবিআর কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে যাচ্ছে। এ লক্ষ্যে ট্রান্সফার প্রাইসিংকে আয়কর আইনে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। দেশ থেকে টাকা পাচার ও কর ফাঁকি প্রতিরোধে ট্রান্সফার প্রাইসিং আইন পাস হয়েছে।
আমিনুল করিম বলেন, ট্রান্সফার প্রাইসিংয়ের মাধ্যমে অর্থ পাচারের ঘটনা শনাক্ত করতে এনবিআরের একটি পৃথক ইউনিট ইতোমধ্যেই কাজ শুরু করে দিয়েছে। এই ইউনিটের সদস্যদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ করে তুলতে বিদেশ থেকে কনসালট্যান্ট আনার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। অতিসত্বর ইউনিটের সদস্যদের এই প্রশিক্ষণ কোর্স শুরু হবে। এসব কর্মকা-ের মধ্য দিয়ে ট্রান্সফার প্রাইসিং ইউনিটটি আরও শক্তিশালী ও অর্থবহ হয়ে উঠবে জানিয়ে তিনি বলেন, আশা করছি এনবিআরের গৃহীত এ জাতীয় উদ্যোগ আগামীতে অর্থ পাচারের ঘটনা শনাক্ত করার পাশাপাশি প্রতিরোধেও সক্ষম হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের নির্বাহী পরিচালক ম. মাহফুজুর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, মানিলন্ডারিং প্রতিরোধে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রচেষ্টার কোন কমতি নেই। আবার এটিও সত্য, এ জাতীয় ঘটনা বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ধরার কোন উপায়ও নেই। তবে এ জাতীয় ঘটনাগুলো যেহেতু কমার্শিয়াল ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে হয়ে থাকে, সেহেতু এ ঘটনা প্রতিরোধে লেনদেনকারী ব্যাংকগুলোকেই আরও সচেতন হতে হবে এবং দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে হবে।
জানা গেছে, ট্রান্সফার প্রাইসিং কার্যক্রমের মাধ্যমে প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার। একই সঙ্গে ফাঁকি দেয়া রাজস্বের বড় অঙ্ক পাচার হয়ে যাচ্ছে। এতদিন আইনী কাঠামো না থাকায় সন্দেহভাজন অপরাধীদের ধরা যাচ্ছিল না। এখন আইনটি কার্যকর হলে অভিযুক্তদের বিচারের আওতায় এনে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া যাবে।
সম্প্রতি দেশ থেকে অর্থ পাচারের ঘটনা বেড়ে গেছে। বিষয়টি সরকারের নীতিনির্ধারকদের নজরে এসেছে। সম্প্রতি ডলারের সৃষ্ট সঙ্কটের পেছনেও অর্থ পাচারকারীরা কাজ করছে বলে অভিযোগ উঠছে। তবে কারা এর সঙ্গে জড়িত সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট প্রমাণ কোন সংস্থার হাতে নেই। যে কারণে সন্দেহভাজন অভিযুক্তদের বিচারের কাঠগড়ায় আনা যাচ্ছে না।
এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট কর্তৃক প্রস্তুতকৃত নতুন আইনে মানিলন্ডারিং ও সন্ত্রাসী কার্যকলাপে অর্থায়ন প্রতিরোধে জাতীয় কৌশলপত্র প্রণয়ন করা হয়েছে। এই লক্ষ্যে এফআইইইউ ইতোমধ্যে ১১টি দেশের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করেছে। কার্যক্রম শুরুর পর থেকে এ পর্যন্ত ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ৭৫৮টি সন্দেহজনক লেনদেন প্রতিবেদন গ্রহণ করেছে।

No comments

Powered by Blogger.