সময়ের প্রতিধ্বনি-বিএনপিকে বাদ দিয়ে নির্বাচনের ভাবনা কেন? by মোস্তফা কামাল

জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের দিল্লি সফরের পর থেকে দেশের রাজনীতিতে নতুন মেরুকরণ শুরু হয়েছে। এই মেরুকরণের সঙ্গে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক শক্তির হাত রয়েছে বলে কোনো কোনো মহল থেকে বলা হচ্ছে।


এ কথা সবাই স্বীকার করবেন যে বাংলাদেশের রাজনীতিতে আমেরিকা ও ভারত একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। এরশাদ ভারত সফরে গিয়ে সে দেশের রাষ্ট্রপতিসহ সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন। ভারত সরকার এরশাদের সফরটিকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করেছে। সফরের ধরন দেখে সেটাই প্রতীয়মান হয়।
ভারতের কাছ থেকে এরশাদ সাহেব কী বার্তা পেয়েছেন তা আমরা জানি না। তিনি নিজেও এ বিষয়ে মুখ খোলেননি। তবে তিনি দিল্লি থেকে দেশে ফেরার পরই রাজনীতির হাওয়া যেন ভিন্নখাতে বইতে শুরু করে। এরশাদ বেশ জোরেশোরেই মহাজোট ছাড়ার বিষয়ে কথা বলছেন। পার্টির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে তিনি এ বিষয়ে মতবিনিময় শুরু করেছেন। ৩০০ আসনে নির্বাচনের প্রস্তুতি নেওয়ার বিষয়টিও আলোচনায় আসছে। এর মধ্যেই পত্রিকায় খবর বেরিয়েছে, ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ বিএনপিকে বাদ দিয়েই আগামী জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা ভাবছে। সে ক্ষেত্রে এরশাদ মহাজোট থেকে বেরিয়ে এককভাবে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবেন। এরশাদ নিজেও দলীয় নীতিনির্ধারণী সভায় এ রকম আভাস দিয়েছেন। বিএনপিকে নির্বাচন থেকে দূরে রাখতে পারলে এরশাদ বিরোধীদলীয় নেতা হতে পারেন। বিএনপি সংসদে না থাকলে রাজনৈতিকভাবেও কোণঠাসা হয়ে পড়বে। এতে সুবিধাজনক অবস্থানে থাকবে জাতীয় পার্টি। মিডিয়ার ফোকাসও জাতীয় পার্টির ওপর বেশি থাকবে। এ-প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে প্রয়োজনে তিনি জাতীয় পার্টির অন্য গ্রুপগুলোকেও সঙ্গে নিতে জোর প্রচেষ্টা চালাবেন।
বাস্তবসম্মত না হলেও আবার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় যাওয়ার স্বপ্ন দেখছেন এরশাদ। সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সেই 'মাইনাস টু থিওরি' নতুন করে উত্থাপন করেন এরশাদ। তিনি বলেছেন, শেখ হাসিনা ও বেগম খালেদা জিয়াকে রাজনীতি থেকে বাদ দিলে দেশে গণতন্ত্র (এরশাদীয় গণতন্ত্র!) প্রতিষ্ঠিত হবে। এর পর পরই সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন 'মাইনাস টু থিওরি'র পক্ষে বক্তব্য দেন। একই সময়ে দুজনের বক্তব্য মিডিয়ায় ফলাও করে প্রকাশের পর বিষয়টি আবার আলোচনার টেবিলে সরগরম হয়ে ওঠে।
ধারণা করা হচ্ছে, এখন এরশাদের টার্গেট হচ্ছে বিএনপি। বিএনপিকে নির্বাচনের বাইরে রাখতে পারলেই এরশাদ বিরোধীদলীয় নেতার আসনে বসতে পারেন। আবার আওয়ামী লীগের টার্গেটও বিএনপি। তাই বিএনপিকে যতটা সম্ভব খাদে ফেলার চেষ্টা করবে আওয়ামী লীগ। এর অংশ হিসেবে ইতিমধ্যেই বিএনপিসহ জোটের অন্য নেতাদের নামে মামলা দেওয়া হয়েছে। মামলাটি উচ্চ আদালতে বিচারাধীন। তাঁদের নানাভাবে হেনস্তা করা হবে বলেও আশঙ্কা করা হচ্ছে। বিরোধী দলের আন্দোলন দমন করতেই এসব করা হচ্ছে। একই সঙ্গে বিএনপিকে নির্বাচনের বাইরে রাখার চেষ্টা চলছে। কিন্তু দেশের প্রধান একটি রাজনৈতিক দলকে নির্বাচনের বাইরে রাখা হলে সেই নির্বাচন কি গ্রহণযোগ্যতা পাবে? সেই সরকারের প্রতি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন থাকবে? বিষয়টি নিয়ে ভাবার অবকাশ রয়েছে। যে রাজনৈতিক দলের জনভিত্তি রয়েছে, সে রাজনৈতিক দলকে ইচ্ছা করলেই নিঃশেষ করা যায় না। তাতে হিতে বিপরীত হতে পারে।
বিগত বিএনপি সরকারের আমলেও আওয়ামী লীগকে বাদ রেখে নির্বাচন অনুষ্ঠানের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু বিএনপির কী পরিণতি হয়েছিল তা আমরা সবাই জানি। বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতা হচ্ছে, ১৯৯০ সালে স্বৈরশাসক এরশাদের পতনের পর থেকে দেশে দুটি রাজনৈতিক ধারা সৃষ্টি হয়েছে। এর একটি ধারার নেতৃত্ব দিচ্ছে আওয়ামী লীগ এবং অপরটি বিএনপির নেতৃত্বে আওয়ামীবিরোধী ধারা। এ দুটি ধারার পক্ষের ছোট রাজনৈতিক দলগুলো আওয়ামী লীগ-বিএনপির নেতৃত্বে জোটবদ্ধ হয়েছে। শুধু রাজনীতিই দুটি ধারায় বিভক্ত হয়নি; বিগত দুই দশকে পর্যায়ক্রমে প্রশাসন, বিচার বিভাগ, পুলিশ প্রশাসন, শিক্ষাঙ্গনসহ সর্বক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ ও বিএনপিপন্থী দুটি ধারা বেশ শক্তিশালী অবস্থান নিয়েছে। এই ধারা দুটি আরো কত দিন তাদের শক্তিশালী অবস্থান ধরে রাখতে পারবে, তা এখনই বলা কঠিন।
প্রসঙ্গত, এরশাদের জাতীয় পার্টির নীতি-আদর্শ বিএনপি ঘরানার হলেও বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় রাজনীতির মেরুকরণ পাল্টে যায়। নানা হিসাব-নিকাশে জাতীয় পার্টি আওয়ামী লীগের সঙ্গে যুক্ত হয়ে মহাজোট গঠন করে। যাই যাই করেও জাতীয় পার্টি এখনো মহাজোটেই আছে।
বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে আওয়ামী লীগ-বিএনপির বাইরে গিয়ে তৃতীয় কোনো রাজনৈতিক শক্তির ক্ষমতায় যাওয়ার আশা দুরাশায় পরিণত হবে- এটা নিশ্চিত করে বলা যায়। আর তৃতীয় শক্তির উদ্ভব ঘটলেও তাতে জাতীয় পার্টির ভাগ্য খোলার আদৌ কোনো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। যদি কোনো অরাজনৈতিক তৃতীয় শক্তির উদ্ভব ঘটে তাহলে ভিন্ন কথা।
জাতীয় পার্টি হয়তো ভাবছে, বিএনপি নির্বাচনে না গেলে তাদের ভোট জাতীয় পার্টি পাবে। এটা ভাবা হলে বোকার স্বর্গে বাস করার শামিল হবে। কারণ বিএনপির কর্মী-সমর্থকদের অবস্থা এখন আওয়ামী লীগের কর্মী-সমর্থকদের মতোই। দল যদি নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্ত নেয়, তাহলে তাদের কর্মী-সমর্থকরাও তা বর্জন করবে। তাতে নির্বাচন বিশ্বাসযোগ্যতা হারাবে। কারণ উভয় দলেরই ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ 'রিজার্ভ' ভোট রয়েছে। কাজেই কোনো একটি পক্ষ নির্বাচন বর্জন করলে সেই নির্বাচন নিঃসন্দেহে ভাবমূর্তি সংকটে পড়বে। আমাদের দৃঢ়বিশ্বাস, কোনো পক্ষই সেই ভুল সিদ্ধান্ত নিতে যাবে না।
আমাদের নিশ্চয়ই স্মরণে আছে ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের কথা! তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তনের দাবিতে আওয়ামী লীগ তখন রাজপথে। আর বিএনপি সরকারে। খালেদা জিয়া কিছুতেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করতে রাজি নন। তিনি তখন বলেছিলেন, শিশু ও পাগল ছাড়া কেউ-ই নিরপেক্ষ নয়। সেই পরিস্থিতিতে বিএনপি সমমনা দলগুলোকে সঙ্গে নিয়ে নির্বাচন করল। তারপর সরকারও গঠন করা হলো। কিন্তু আওয়ামী লীগের বর্জনের কারণে সেই নির্বাচন জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে বিশ্বাসযোগ্যতা পেল না। সরকারও একঘরে হয়ে পড়ল। অবস্থা বেগতিক দেখে বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করল। ওই বছরই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে যে নির্বাচন হলো, সেই নির্বাচনে বিএনপির পরাজয় হলো। সেই ১৯৯৬ সালের দৃশ্যপটই আবার আমরা দেখতে পাচ্ছি।
বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে, বিএনপিকে বাদ রেখেই নির্বাচনে যাওয়ার একটা উদ্যোগ আছে ক্ষমতাসীন দলের মধ্যে। বিষয়টি নিয়ে আলাপ-আলোচনা চলছে। আওয়ামী লীগ ঘরানার বুদ্ধিজীবী ও সুহৃদদের পরামর্শ নেওয়া হচ্ছে। একই সঙ্গে আমেরিকা ও ভারতকে বোঝানোর চেষ্টা চলছে। এই দুই দেশকে রাজি করাতে পারলে হয়তো বিএনপি ছাড়াই নির্বাচন হবে। এ ক্ষেত্রে জাতীয় পার্টি হবে আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিপক্ষ। এ কারণেই এরশাদ কখনো কখনো সরকারের সমালোচনায় মুখর হয়ে ওঠেন। আবার কখনো ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে দূরত্ব বজায় রেখে চলেন। কারো কারো ধারণা, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বোঝাপড়া করেই তিনি এসব কাজ করে থাকেন। জাতীয় পার্টি মহাজোট থেকে বেরিয়ে গেলেও শেখ হাসিনার সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতেই তা করবে। তবে এরশাদ সাহেবকে এত বিশ্বাস করার কিছু নেই। তিনি নিজের স্বার্থে যেকোনো মুহূর্তে বিএনপির সঙ্গেও জোট বাঁধতে পারেন। আর সেটা হলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। এদিকে ক্ষমতাসীন জোটের রাজনৈতিক মারপ্যাঁচে কিছুটা কোণঠাসা হয়ে পড়া বিএনপিও নিজেদের সংগঠিত করার উদ্যোগ নিয়েছে। দলের সাংগঠনিক শক্তি বৃদ্ধির পাশাপাশি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করতে নানা তৎপরতা চালাচ্ছে। দলীয় চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া বিভিন্ন জেলায় সাংগঠনিক সফরের পাশাপাশি চীন ও ভারত সফরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। খালেদা জিয়ার ভারত ও চীন সফরের পর দেশের রাজনীতিতে যদি নতুন কোনো মেরুকরণ হয়, তাতেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। কারণ বিএনপিও খুব সহজে রাজনীতির মাঠ ছেড়ে দেবে না। যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির যে ঐক্য তা আদৌ ভাঙার কোনো সম্ভাবনা নেই। এতে বিএনপি মডারেট ভোটারদের সমর্থন না পেলেও বিএনপি-জামায়াত সমর্থকদের ভোট নিশ্চিতভাবেই পাবে। ওই ভোট জাতীয় পার্টি কিংবা আওয়ামী লীগের বাক্সে যাবে না। এসব হিসাব-নিকাশ মাথায় রেখেই ক্ষমতাসীন জোটের অগ্রসর হওয়া উচিত।
আমার তো মনে হয়, বিএনপিকে বাদ দেওয়ার কূটকৌশল না করে মহাজোটের ঐক্য ধরে রাখা বুদ্ধিমানের কাজ হবে। ভোটের হিসাব তা-ই বলে। বিএনপিকে ভোটের মাধ্যমেই মোকাবিলা করতে হবে। অন্য কোনো পথে সুবিধা করা যাবে না। দেশের মানুষকে বোকা ভাবার কিছু নেই। তাদের সুশাসন দিলে, জীবনযাত্রার উন্নয়ন ঘটাতে পারলে তারা অবশ্যই তার প্রতিদান দেবে। ক্ষমতাসীনরা এ বিষয়টি মাথায় রেখে কাজ করলে বোধ করি ভালো করবে।
লেখক : কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক
mostofakamalbd@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.