পদ্মা সেতুতে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নের কোন সুখবর নেই- প্রয়োজনে দশবার পদত্যাগ করতে রাজি আছি ॥ ড. মসিউর by হামিদ-উজ-জামান মামুন

নানা উদ্যোগ সত্ত্বেও পদ্মা সেতুতে অর্থায়নে বিশ্বব্যাংকের মন গলাতে পারছে না সরকার। শেষ পর্যন্ত ঋণ চুক্তি বাতিলের সিদ্ধান্ত থেকে সংস্থাটি সরছে না বলে একাধিক সূত্রে জানা গেছে। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের একটি সূত্র জানায়, সরকারের পক্ষ থেকে সব শর্ত মেনে নেয়ার কথা বলা হলেও এখনও কোন ইতিবাচক সাড়া মেলেনি


বিশ্বব্যাংকের পক্ষ থেকে বরং অন্য দাতাদের অর্থায়নের সম্ভাবনাও দিন দিন ফুরিয়ে আসছে। অন্যদিকে গত কয়েকদিন থেকে অর্থ উপদেষ্টার পদত্যাগ নিয়ে যে সরব আলোচনা চলছিল সে বিষয়ে রবিবার সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেছেন ড. মসিউর রহমান। তিনি বলেন, বিশ্বব্যাংক অর্থায়ন করলে একবার নয় প্রয়োজনে দশবার পদত্যাগ করতে রাজি আছি।
রবিবার বিকেলে রাজধানীর হেয়ার রোডে অবস্থিত অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের বাসায় তাঁর সঙ্গে সাক্ষাত শেষে বের হয়ে যাওয়ার সময় ড.মসিউর রহমান সাংবাদিকদের আরও বলেন, বিশ্বব্যাংকের চাপে নয় দেশের স্বার্থেই প্রধানমন্ত্রী চাইলে পদত্যাগে রাজি আছি। কিন্তু আমার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ আনা হয়েছে তার প্রমাণ দিতে হবে। তবে আত্মপক্ষ সমথর্নেরও সুযোগ চেয়েছেন তিনি।
অন্যদিকে পদ্মা সেতু প্রকল্পের অন্যতম দুই দাতা সংস্থা এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) এবং জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থার (জাইকা) অর্থায়নের সম্ভাবনা কমে আসছে। কেননা এ দুই সংস্থার ঋণ কার্যকারিতার বর্ধিত শেষ এক মাস মেয়াদ শেষ হচ্ছে আগামী শুক্রবার (৩১ আগস্ট)। এ নিয়ে তৃতীয়বার সময় বাড়িয়েছে এডিবি ও জাইকা। এর পর কী হবে সে বিষয়ে কিছুই বলতে পারছে না ইআরডির দায়িত্বশীলরা।
এ বিষয়ে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের বাংলাদেশ অফিসের দায়িত্বশীল একটি সূত্র জনকণ্ঠকে জানায়, আগামী ৩০ আগস্টের মধ্যে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে চলমান বিষয়টির কোন অগ্রগতি না হলে সে ক্ষেত্রে এডিবির কিছুই করার থাকবে না। তখন সরাসরি ঋণ বাতিলের ঘোষণাও আসতে পারে। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে আবার সময় বাড়ানোর আবেদন করলে কোন লাভ নাও হতে পারে বলে আভাস দেয়া হয়েছে। সংস্থাটি মনে করে এক মাস সময় বাড়ানো শুধুই বিষয়টির একটি আশানুরূপ পরিণতির দিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য। কিন্তু কিছুই তো হলো না। সে ক্ষেত্রে আর কত সময় বাড়াবে? এডিবি ও জাইকার ঋণ চুক্তির মেয়াদ গত ৩১ জুলাই শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু এ দুই দাতা সংস্থার মেয়াদ এক মাস বাড়ানোয় ৩১ আগস্ট মেয়াদ শেষ হচ্ছে।
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, রবিবার পর্যন্ত বিশ্বব্যাংকের পক্ষ থেকে কোন সুখবর আসেনি। উপরন্তু আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে সংস্থাটি তার পূর্বের অবস্থানেই অনড় রয়েছে। পদ্মা সেতুতে অর্থায়নে বিশ্বব্যাংকের আর কোন আগ্রহ নেই। তবে ওই সূত্রটি জানায়, সরকার সময় থাকতে কার্যকর কোন উদ্যোগই নেয়নি। এখন যত চেষ্টাই করা হোক না কেন প্রধান ঋণ দাতা এ সংস্থাটির মন গলবে না। এ ক্ষেত্রে অবস্থাটি এমন দাঁড়িয়েছে যে, সময়ের এক ফোঁড় আর অসময়ের দশ ফোঁড়। তাতেও কাজ হচ্ছে না।
সূত্র জানায়, পদ্মা সেতুতে অর্থায়নের বিষয়ে একে একে সব শর্তই মেনে নিচ্ছে সরকার। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। পদ্মা সেতুতে অর্থায়নের বিষয়ে বিশ্বব্যাংক সরকারকে চারটি শর্ত দিয়ে একটি প্রস্তাব পাঠিয়েছিল। এগুলো হচ্ছে, প্রথমত দুর্নীতি দমন কমিশনকে একটি বিশেষ যৌথ তদন্ত ও বিচারিক টিম গঠনের প্রস্তাব। দ্বিতীয়ত: সরকার একটি বিকল্প প্রকল্প বাস্তবায়ন ব্যবস্থায় সম্মত হয়েছিল যেখানে সহযোগী অর্থায়নকারীদের জন্য স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় অধিকতর তদারকির সুযোগ ছিল। তৃতীয়ত দুদককে বিশ্বব্যাংকের তত্ত্বাবধানে একটি বাইরের প্যানেলের কাছে তথ্য দেয়ার এবং প্যানেলকে তদন্ত প্রক্রিয়ার পর্যাপ্ততা মূল্যায়নের সুযোগ দেয়ার প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল। সবশেষে সরকার বাংলাদেশী আইনের আওতায় থাকা সত্ত্বেও তদন্ত চলাকালে সরকারী দায়িত্ব পালন থেকে সরকারী ব্যক্তিবর্গকে (আমলা ও রাজনৈতিকভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত) ছুটি দিতে হবে। এসব শর্তের সবই প্রায় মেনে নেয়া হয়েছে। এখন শুধু অর্থ উপদেষ্টা এবং পদ্মা সেতু প্রকল্পের ইন্টিগ্রেটি এ্যাডভাইজার হিসেবে দায়িত্বরত ড. মসিউর রহমানের পদত্যাগ যে কোন মুহূর্তে হতে পারে বলেও ধারণা করা হচ্ছে।
সূত্র জানায়, পদ্মা সেতু প্রকল্পের মূল সেতু ও তদারকি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগের দরপত্রে সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ করেছিল বিশ্বব্যাংক। সংস্থার পক্ষ থেকে পদ্মা সেতু প্রকল্প নিয়ে করা একটি তদন্ত প্রতিবেদন গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসে অর্থমন্ত্রীকে দেয়া হয়েছিল। সেখানে বিশ্বব্যাংকের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে পদ্মা সেতু প্রকল্পের বিভিন্ন কাজ পাইয়ে দেয়ার জন্য ঘুষ বা কমিশন চেয়েছিল সৈয়দ আবুল হোসেনের মালিকানাধীন সাকো ইন্টারন্যাশনালের প্রতিনিধিরা। যোগাযোগমন্ত্রীর নাম ব্যবহার করে অর্থ চাওয়া হয়েছে। কমিশন পেলে সৈয়দ আবুল হোসেন নিজেই কাজ পাইয়ে দেয়ার বিষয়ে সহায়তা করবেন বলে আশ্বাস দেয়া হয়েছে। এসব অভিযোগের প্রেক্ষিতে অবশেষে সৈয়দ আবুল হোসেনকে সরিয়ে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেয়া হয় ওবায়দুল কাদেরকে।
এরপর বিভিন্ন পর্যাযের আলাপ-আলোচনার পরও অবশেষে গত ২৯ জুন বিশ্বব্যাংক আকস্মিকভাবে পদ্মা সেতুর ঋণচুক্তি বাতিল করে দেয়।

No comments

Powered by Blogger.