দোকান বরাদ্দে ডিএসসিসির মহাদুর্নীতি-প্রতি বর্গফুট ২০ টাকা! by অমিতোষ পাল

যে জায়গার প্রতি বর্গফুটের দাম চার হাজার ৫০০ টাকা, সেই জায়গা মাত্র ২০ টাকা বর্গফুট হিসাবে বরাদ্দ দিয়েছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)। এভাবে সংস্থাটি এক লাখ ৩৬ হাজার বর্গফুট জায়গা বরাদ্দ দিয়েছে অন্তত ৬০ কোটি টাকা কমে।


জানা গেছে, এই বরাদ্দের মাধ্যমে ডিএসসিসির কিছু অসাধু কর্মকর্তার পকেট ভারী হয়েছে। তাঁরা বরাদ্দপ্রাপ্তদের কাছ থেকে অন্তত পাঁচ কোটি টাকা উৎকোচ নিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
ঢাকা সিটি করপোরেশনের (ডিসিসি) তিনটি মার্কেটের স্পেস এভাবে সম্পূর্ণ অনিয়মতান্ত্রিক উপায়ে বরাদ্দ দেওয়ার এই ঘটনায় পুরো নগর ভবনে চলছে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা। খোদ সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তারাই বলছেন, তাঁরা এ পর্যন্ত এ সংস্থায় অনেক দুর্নীতির কাহিনী শুনেছেন। কিন্তু এই ঘটনার কাছে অন্যগুলো নগণ্য হয়ে গেছে।
ডিএসসিসির প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা মনিরুজ্জামান কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমাদের না জানিয়ে সম্পত্তি বিভাগ এই বরাদ্দের ঘটনা ঘটিয়েছে। আমরা এই বরাদ্দের খবর যখনই শুনেছি তখনই লিখিতভাবে প্রতিবাদ জানিয়েছি। বলেছি, এই বরাদ্দ বাতিল করতে হবে।'
এ প্রসঙ্গে ডিএসসিসির প্রশাসক জিল্লার রহমানের বক্তব্য নেওয়ার চেষ্টা করেও তা সম্ভব হয়নি, তিনি ফোন ধরেননি। তবে প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সুলতানুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমার কাছেও এ ব্যাপারে একাধিক অভিযোগ এসেছে। আমিও খোঁজ নিয়ে দেখেছি। তবে এটুকু বলতে পারি, নিয়ম না মেনে বরাদ্দ দিলে সেই বরাদ্দ অবশ্যই বাতিল করা হবে। এখন সেই প্রক্রিয়াই চলছে।'
জানা গেছে, নগর ভবনের দক্ষিণে রাস্তার পাশেই সার বেঁধে ডিসিসির ফুলবাড়িয়া সুপার মার্কেট-২ নামে বিশাল আকৃতির তিনটি মার্কেট দাঁড়িয়ে আছে। ১৯৮৮ সালে সিটি প্লাজা (এ ব্লক), নগর প্লাজা (বি ব্লক) ও জাকের মার্কেট (সি ব্লক) নামের এই তিনটি মার্কেট তৈরি করে ডিসিসি। প্রথম দুটিতে তিন তলা ও তৃতীয়টিতে চতুর্থ তলা পর্যন্ত তুলে সেখানে দোকান বানিয়ে ফুলবাড়িয়ার ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের বরাদ্দ দেওয়া হয়। কিন্তু প্রতিটি ভবনেরই বিশাল ছাদগুলো ছিল ফাঁকা। ভবিষ্যতে আরো যাতে তলার সংখ্যা বাড়ানো যায়, সে ব্যবস্থাও রাখা ছিল। কয়েক মাস আগে দেলোয়ার হোসেন দেলু নামের এক ব্যক্তি ওই ছাদ বরাদ্দ পেতে ডিএসসিসিতে আবেদন করেন। নিজ উদ্যোগে ভবনগুলোর ওপরে ফ্লোর তৈরি করে নেওয়ার শর্তে গত ২৯ এপ্রিল ডিএসসিসি বরাদ্দ দিয়ে দেয়। প্রতি বর্গফুটের দাম ধরা হয় মাত্র ২০ টাকা। অতি গোপনে এই বরাদ্দকাজ সম্পন্ন করা হয়। সম্প্রতি সেখানে ফ্লোর বাড়ানোর জন্য নির্মাণকাজ শুরু হলে বিষয়টি সবার দৃষ্টিতে আসে। তখনই ফাঁস হয়ে যায় ঘটনা।
জানা গেছে, সিটি প্লাজা ও নগর প্লাজায় বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে চার, পাঁচ ও ছয় তলা। অর্থাৎ তৃতীয় তলার ওপর আরো তিনটি তলা নির্মাণ করতে পারবেন বরাদ্দপ্রাপ্তরা। একইভাবে জাকের মার্কেটের বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে পাঁচ ও ছয় তলা। ডিএসসিসি জানিয়েছে, প্রতিটি মার্কেটের একেকটি তলার ফ্লোর স্পেস ১৭ হাজার বর্গফুট। এ হিসাবে তিনটি ভবনের ওপর তৈরি হবে আটটি তলা। এই আট তলায় মোট ফ্লোর স্পেসের পরিমাণ এক লাখ ৩৬ হাজার বর্গফুট।
এ-সংক্রান্ত নথিপত্রে দেখা গেছে, বরাদ্দপত্রে ডিএসসিসির সম্পত্তি বিভাগের কর্মকর্তাদের স্বাক্ষর রয়েছে। এই বরাদ্দের ক্ষেত্রে প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা তাজুল ইসলাম প্রধান, সম্পত্তি কর্মকর্তা দিদারুল আলম, বেলাল হোসেন ও কানুনগো মোহাম্মদ আলীই মূল ভূমিকা রেখেছেন বলে অভিযোগ আছে। আর পুরো কাজটি নির্বিঘ্ন করতে শীর্ষ পর্যায়েরও কিছু কর্মকর্তাকে তাঁরা হাত করেছেন।
অবশ্য প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা তাজুল ইসলাম প্রধান তাঁর বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগ অস্বীকার করে কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমি ছুটিতে থাকার সময় এ বরাদ্দের ঘটনা ঘটেছে। কাজেই আমি কিছু জানি না। সম্পত্তি কর্মকর্তা ও কানুনগোরা এই ঘটনা ঘটিয়েছে। আর আমি চাইলেই তো ইচ্ছেমতো কাউকে বরাদ্দ দিতে পারি না। এখন সব কিছুই হয় পলিটিক্যালি। পলিটিক্যাল ইনভল্বমেন্ট ছাড়া এত বড় ঘটনা ঘটতে পারে না।' কিন্তু জড়িত সেই পলিটিক্যাল ব্যক্তি কারা, তা তিনি জানাতে পারেননি।
অনিয়মতান্ত্রিকভাবে বরাদ্দ দেওয়া প্রসঙ্গে তাজুল ইসলাম বলেন, অনিয়ম হয়েছে বলা যাবে না। যদি স্থায়ীভাবে বরাদ্দ দেওয়া হতো, তাহলে সেটা অনিয়ম হতো। এটা অস্থায়ী বরাদ্দ। এর আগেও এ রকম অস্থায়ী বরাদ্দের ঘটনা ঘটেছে।
তবে ডিএসসিসির এক কর্মকর্তা বলেন, অস্থায়ী বরাদ্দ এমন স্থানে দেওয়া যায়, যাতে সেটা সহজেই ভেঙে ফেলা যায়। কিন্তু এ ক্ষেত্রে এমনভাবে বহুতল ভবন করা হচ্ছে, যা ভাঙা হবে খুবই কঠিন। এটা টিনশেড বা কাঁচা মার্কেট না। আর বহুতলবিশিষ্ট পাকা ভবন তৈরি হয়ে গেলে সেটা ভাঙাও অনেক জটিল বিষয়। এসব বিষয় চিন্তা করেই চক্রটি এ ঘটনা ঘটিয়েছে।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, প্রায় ৩০ বিঘা জমির ওপর নির্মিত ওই মার্কেটগুলোর ওপরে খোলা আরসিসি পিলারের রডগুলো বের করে নতুন করে রড বসিয়ে তলা বাড়ানোর কাজ শুরু হয়েছে। শ্রমিকরা পাথর-সিমেন্টের ঢালাই দিয়ে পিলার তৈরির উপযোগী করছেন। বরাদ্দপ্রাপ্ত দেলোয়ার হোসেন দেলুর তত্ত্বাবধানেই নির্মাণকাজ চলছে বলে শ্রমিকরা জানান।
এ প্রসঙ্গে বক্তব্য জানার জন্য দেলোয়ার হোসেন দেলুর সঙ্গে ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাঁকে পাওয়া যায়নি। তবে বরাদ্দের সঙ্গে যুক্ত থাকা ডিএসসিসির কানুনগো মোহাম্মদ আলী বলেন, 'এই বরাদ্দের সঙ্গে সরকারদলীয় এমপি-মন্ত্রীরা যুক্ত আছেন। তাঁদের নির্দেশেই বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। আমার মতো লোকের তো বরাদ্দ দেওয়ার ক্ষমতা নেই।' কিন্তু সেই মন্ত্রী-এমপি কারা, তা তিনিও জানাতে পারেননি।
জানা গেছে, মার্কেটগুলোর ওপর ফ্লোর বাড়িয়ে নতুন দোকান করে সেই দোকানগুলো ফুলবাড়িয়া সুপার মার্কেট তৈরির সময়কার ক্ষতিগ্রস্ত ৩৯৯ জন ব্যবসায়ীকে বরাদ্দ দেওয়ার জন্য গত বছর বিজ্ঞপ্তি দিয়েছিল ডিসিসির বাজার শাখা। সে সময় ক্ষতিগ্রস্তরা প্রাথমিকভাবে এক লাখ ৭৫ হাজার টাকা করে জমা দিয়ে আবেদন করেন। তখন ডিসিসি প্রতি বর্গফুটের দাম নির্ধারণ করে দেয় চার হাজার ৫০০ টাকা। গত বছরের অক্টোবরে ওই সব ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তির কাছ থেকে ডিসিসি মোট সাত কোটি টাকা আদায় করে। এর পরপরই অতিরিক্ত তলা নির্মাণের জন্য প্রকৌশল বিভাগকে চিঠি দেয় রাজস্ব শাখা (বাজার সার্কেল)। কয়েকটি টেবিল হয়ে প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার দপ্তরে ফাইল গিয়ে ফেরত আসে। তখন রাজস্ব ও বাজার শাখার কর্মকর্তারা অবৈধ বরাদ্দের ঘটনা জানতে পারেন। বিষয়টি ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের কানে গেলে তাঁরাও ক্ষোভে ফেটে পড়েন। তাঁরা আদালতে রিট আবেদন করলে আদালত গত ১১ জুন ফ্লোর বৃদ্ধির নির্মাণকাজের ওপর স্থগিতাদেশ জারি করেন। কিন্তু আদালতের নিষেধাজ্ঞা অবজ্ঞা করেও বর্তমানে নির্মাণকাজ চলছে।
অন্যদিকে ফুলবাড়িয়ার ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের সংগঠনের তরফ থেকে ইতিমধ্যে এই অবৈধ বরাদ্দের প্রতিবাদ জানিয়ে লিখিতভাবে দুর্নীতি দমন কমিশন, ডিএসসিসির প্রশাসকসহ বিভিন্ন দপ্তরে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে। ফুলবাড়িয়া ব্যবসায়ী বহুমুখী সমবায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক ফরিদ আহমেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, 'ডিএসসিসির সম্পত্তি বিভাগের কর্মকর্তারা দুর্নীতি করে এই বরাদ্দ দিয়েছেন। এই বরাদ্দের আড়ালে পাঁচ থেকে ১০ কোটি টাকার অবৈধ লেনদেন হয়েছে। আমরা এর সঠিক তদন্ত দাবি করছি।' তিনি বলেন, 'ডিএসসিসির প্রশাসকের সঙ্গেও দেখা করে বিষয়টি জানিয়েছি। প্রশাসক সাহেব বলেছেন, দুর্নীতির মাধ্যমে সম্পন্ন হওয়া বরাদ্দ অবশ্যই বাতিল করা হবে।'

No comments

Powered by Blogger.