প্রাথমিক শিক্ষকরা তটস্থ কখন সচিব আসেন by অভিজিৎ ভট্টাচার্য্য

প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা এখন তটস্থ। কখন এসে পড়েন সচিব। সম্প্রতি দেখা গেছে, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব এম এম নিয়াজ উদ্দিন নিয়মিত বিভিন্ন বিদ্যালয় পরিদর্শনে যাচ্ছেন এবং যেখানে যাচ্ছেন সেখানেই তিনি নানা অনিয়মের অভিযোগে কোনো না কোনো শিক্ষক বা শিক্ষা কর্মকর্তাকে বরখাস্ত করে আসছেন।


প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মানসম্মত শিক্ষার অভাব এবং শিক্ষক-কর্মকর্তাদের নিয়মিত উপস্থিত না হওয়ার কারণে এসব ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। শুধু তাই নয়, দেশজুড়ে মনিটরিং কমিটি গঠন করে সব জেলার প্রাথমিক বিদ্যালয়কে পর্যবেক্ষণের আওতায় আনা হয়েছে। পাশাপাশি জেলা প্রশাসক (ডিসি) এবং উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের (টিএনও) চিঠি দিয়ে বিদ্যালয় পরিদর্শনের জন্যও বলা হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এ পর্যন্ত সচিব সাতটি জেলার এক ডজন বিদ্যালয় পরিদর্শন করেছেন। পরিদর্শনের সময় নিয়মিত উপস্থিত না হওয়া এবং মানসম্মত শিক্ষা দিতে না পারার অভিযোগে এসব বিদ্যালয়ের প্রায় ৫০ জন শিক্ষক-শিক্ষিকাকে তিনি বরখাস্ত করেন। আর নিয়মিত মনিটরিং না করার অভিযোগে ১০ জন শিক্ষা কর্মকর্তাকেও বরখাস্ত করেন তিনি। বরখাস্ত হওয়া শিক্ষক ও কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে এখন বিভাগীয় মামলা হবে।
মাঠপর্যায়ে এসব শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীকে বরখাস্তের পর মন্ত্রণালয় থেকে ২৩ কর্মকর্তার সমন্বয়ে মনিটরিং কমিটি গঠন করে দেন সচিব। প্রাথমিক মন্ত্রণালয়ে নিয়োজিত কর্মকর্তারা সারা দেশের বিদ্যালয় পর্যবেক্ষণ করে শিশু ভর্তির হার বাড়ানো, ঝরে পড়া রোধ, শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিদ্যালয় ও অফিসে নিয়মিত উপস্থিতিসহ শিক্ষার গুণগত মানোন্নয়ন নিশ্চিত করতে নিয়মিত পরিদর্শন করবেন। এ ছাড়া শিক্ষকরা ঠিক সময়ে বিদ্যালয়ে যাচ্ছেন কি না তা দেখার জন্য মাঠপর্যায়ে জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে চিঠি পাঠিয়ে দায়িত্ব দিয়েছেন তিনি।
কয়েকজন শিক্ষক জানিয়েছেন, প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষায় পাসের হার শত ভাগ হওয়া সত্ত্বেও সচিব মানসম্মত শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে না বলে শিক্ষকদের অভিযুক্ত করেছেন। পাশাপাশি অনেক শিক্ষক নিয়মিত বিদ্যালয়ে যান না বলেও অভিযোগ করেছেন সচিব। এসব অপরাধে গত জুন ও জুলাই মাসে বেশ কয়েকজন শিক্ষক এবং শিক্ষা কর্মকর্তাকে তিনি বরখাস্ত করেন।
সচিব এম এম নিয়াজ উদ্দিন এ বিষয়ে কালের কণ্ঠকে বলেন, 'শিক্ষকদের কাজ হচ্ছে তাঁরা নিয়মিত স্কুলে যাবেন এবং শিশুদের পড়াবেন। কিন্তু শিক্ষকরা ঠিকমতো দায়িত্ব পালন করেন না। বিভিন্ন বিদ্যালয় পরিদর্শনে গিয়ে নিজে এমন চিত্র দেখে আমি হতভম্ব হয়ে গেছি। বিদ্যালয় পরিদর্শনের পর আমার মনে হয়েছে, স্বাধীনতার ৪০ বছর পরও আমরা মানসম্মত শিক্ষা দিতে পারিনি।' তিনি আরো বলেন, শিক্ষকদেরকে সরকার সবই দিচ্ছে। তাহলে শিক্ষকরা কেন দায়িত্ব পালন করবেন না? তিনি প্রশ্ন রাখেন, তৃতীয় শ্রেণীর একজন শিক্ষার্থী কেন 'থ্রি' শব্দটি ইংরেজিতে লিখতে পারবে না? অথচ তাঁরা (শিক্ষকরা) বলেন, সমাপনীতে পাসের হার শত ভাগ। এসব কিভাবে সম্ভব?
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পঞ্চগড়ের বরখাস্ত হওয়া একজন শিক্ষক কালের কণ্ঠকে বলেন, 'সচিব স্যার এসে তৃতীয় শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের 'থ্রি' শব্দটি ইংরেজিতে লিখতে বলেন। কয়েকজন তা লিখতে পারেনি। এ কারণে স্যার আমাকে বরখাস্ত করে দিয়েছেন।'
অন্যদিকে বাংলাদেশ প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির মহাসচিব বি এম আসাদুল্লাহ এ বিষয়ে কালের কণ্ঠকে বলেন, 'সরকারি কর্মচারীদের বিরুদ্ধে এভাবে সরাসরি অ্যাকশন নেওয়া যায় না। অভিযুক্তকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দিতে হয়। সচিব তা দেননি। আমরা সচিবের এমন কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদ জানাচ্ছি।'
এম এম নিয়াজ উদ্দিন দুই মাস আগে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব হিসেবে যোগ দেওয়ার পর এ পর্যন্ত সাতটি জেলা সফর করেছেন। জেলাগুলো হচ্ছে গাজীপুর, চট্টগ্রাম, রংপুর, পঞ্চগড়, বরিশাল, মাদারীপুর ও কক্সবাজার। এসব জেলার বিভিন্ন প্রাথমিক বিদ্যালয় পরিদর্শন করে তিনি নানা অভিযোগে কমপক্ষে ৫০ জন শিক্ষককে বরখাস্ত করেন। বরখাস্ত করেছেন বেশ কয়েকজন প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তাকেও।
সচিব বলছেন, এসব বিদ্যালয়ে ঠিকমতো পড়াশুনা হয় কি না তা দেখার দায়িত্ব কর্মকর্তাদের। কিন্তু কর্মকর্তারা বিদ্যালয় পরিদর্শন করেন না। এ কারণে তাঁদেরও বরখাস্ত করা হয়েছে। তিনি বলেন, মাঠপর্যায়ের প্রাথমিক শিক্ষার এ অবস্থা দেখে মনিটরিং বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। মনিটরিং কমিটির মাধ্যমে সারা দেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অবস্থা খতিয়ে দেখা হবে। এরপর মানসম্মত শিক্ষার ক্ষেত্রে ঘাটতি কোথায় তা খুঁজে বের করে 'দাওয়াই' দেওয়া হবে। সচিব বলেন, যুগ্ম সচিব পর্যায়ের কর্মকর্তারা মাসে একবার কমপক্ষে তিনটি এবং উপসচিব পর্যায়ের কর্মকর্তারা মাসে দুইবারে কমপক্ষে পাঁচটি সরকারি ও বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং মাঠপর্যায়ের প্রাথমিক শিক্ষা অফিস পরিদর্শন করবেন।
জেলাওয়ারি মনিটরিংয়ের দায়িত্ব পাওয়া কর্মকর্তারা হলেন- যুগ্ম সচিবদের মধ্যে রূপন কান্তি শীল চট্টগ্রাম, লক্ষ্মীপুর ও ঢাকা; জামাল এ নাসের চৌধুরী কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও খাগড়াছড়ি; আখতার আলী সরকার রংপুর, লালমনিরহাট ও রাজশাহী; হারুনুর রশীদ কুষ্টিয়া, চাঁদপুর ও চুয়াডাঙ্গা এবং গিয়াস উদ্দিন আহমেদ বরিশাল, গাজীপুর ও ভোলা। উপসচিবদের মধ্যে ফাইজুল কবীর সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ ও রাঙামাটি; আবু তাজ মো. জাকির হোসেন কক্সবাজার, কুড়িগ্রাম ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ; আবুল কাশেম ভূঁইয়া কিশোরগঞ্জ, বান্দরবান ও জামালপুর; নুজহাত ইয়াসমীন ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা ও মানিকগঞ্জ; আবুল কালাম খুলনা, নরসিংদী ও সিরাজগঞ্জ; জ্যোতির্ময় বর্মণ সিলেট, জয়পুরহাট ও পঞ্চগড়; উপপ্রধান দিলরুবা ইয়াসমীন পাবনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরা; সচিবের একান্ত সচিব সৈয়দ আলী আহসান যশোর ও নড়াইল। সিনিয়র সহকারী সচিবদের মধ্যে এ এইচ এম গোলাম কিবরিয়া মৌলভীবাজার, নোয়াখালী ও মাদারীপুর; রেবেকা সুলতানা নওগাঁ, ফরিদপুর ও টাঙ্গাইল; জাজরিন নাহার মুন্সীগঞ্জ, পিরোজপুর ও শরীয়তপুর; মো. আলাউদ্দিন শেরপুর, গাইবান্ধা ও নাটোর; সিনিয়র সহকারী প্রধান ইমতিয়াজ মাহমুদ নারায়ণগঞ্জ, মাগুড়া ও ঝিনাইদহ; মো. জাকির হোসেন চৌধুরী রাজবাড়ী, নীলফামারী ও দিনাজপুর; পরিসংখ্যান কর্মকর্তা মো. নাসির উদ্দিন খান বরগুনা ও পটুয়াখালী; প্রোগ্রামার মো. সিরাজুল ইসলাম মেহেরপুর ও ঠাকুরগাঁও; লাইব্রেরিয়ান খোদেজা আক্তার বগুড়া ও ফেনী; হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা মো. জাকির হোসেন ঝালকাঠি ও গোপালগঞ্জ জেলার সরকারি ও বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং মাঠপর্যায়ের প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কার্যালয় পরিদর্শন করবেন।

No comments

Powered by Blogger.