পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড-কার্যকর পুনর্গঠনই কাম্য

প্রতিষ্ঠার প্রায় সাড়ে তিন দশক পরে হলেও পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (রুরাল ইলেকট্রিফিকেশন বোর্ড) পুনর্গঠনের যে পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে_ প্রথমত এ বিষয়টিই আমাদের কাছে ইতিবাচক মনে হয়। কারণ আমরা গভীর উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ্য করে এসেছি, দেশের বৃহত্তম বিদ্যুৎ বিতরণ নেটওয়ার্কটি অদক্ষতা, অনিয়ম ও গ্রাহক হয়রানির প্লাবনে ডুবতে
বসলেও উদ্ধারের উদ্যোগ ছিল না। ৭০টি পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির মধ্যে ৬৫টিই লোকসানী_ বোর্ডটির অবস্থা কতখানি বেহাল, তা বোঝানোর জন্য এই পরিসংখ্যানই যথেষ্ট। সেবাও তথৈবচ। লোডশেডিংয়ে অতিষ্ঠ গ্রাহকরা মিছিল নিয়ে রাস্তায় নেমেছে, বৈদ্যুতিক স্থাপনায় ভাংচুর চালিয়েছে; নীতিনির্ধারকরা নির্বিকার থাকার কৌশলই অবলম্বন করে এসেছেন। রোববার সমকালে প্রকাশিত এ সংক্রান্ত প্রতিবেদনে অবশ্য দাবি করা হয়েছে যে, সাম্প্রতিককালে গ্রামাঞ্চলে বিদ্যুতের আসা-যাওয়া সহনীয় পর্যায়ে নেমে এসেছে। সরকার বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধিতে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছে; ফলে সামনের দিনগুলোতে লোডশেডিং আরও নিয়ন্ত্রণে আসবে বলে আমরা আশা করতে পারি। কিন্তু অনিয়ম দূর করা না গেলে পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য অধরাই থেকে যাবে। পুনর্গঠন পরিকল্পনায় সেদিকে কতটা নজর দেওয়া হচ্ছে? যতদূর জানা যাচ্ছে আট সদস্যের বোর্ডে আরও দু'জন পরিচালক বাইরে থেকে অন্তর্ভুক্ত করা হবে। সদর দফতরে প্রধান প্রকৌশলীর পদ একটি বাড়িয়ে দুটি করা হবে। সারাদেশকে আটটি অঞ্চলে ভাগ করে স্থাপিত আঞ্চলিক কার্যালয়ে আটজন অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলীকে দায়িত্ব দেওয়া হবে। প্রশ্ন হচ্ছে, পল্লী বিদ্যুৎ বিতরণ নেটওয়ার্কজুড়ে তিন দশক ধরে অনিয়মের যে ঘুণপোকা বাসা বেঁধেছে, কয়েকটি আঞ্চলিক কার্যালয় স্থাপন ও পদের সংখ্যা বাড়িয়ে কি তা দূর করা যাবে? এ ধরনের 'পুনর্গঠন' আমাদের কাছে বরং দুর্নীতি ও হয়রানির বিশাল মহীরুহটির গোড়ায় রোগ রেখে আগায় ওষুধ ছিটানোর মতোই মনে হয়। লোডশেডিং নিয়ন্ত্রণে আসার পর এখন অগ্রাধিকার হবে যথাসম্ভব গ্রাহক হয়রানি দূর করা। বিতরণ ব্যবস্থাটিতে দুর্নীতির যেসব অভিযোগ শোনা যায়, তার বড় অংশই কিন্তু বোর্ড-গ্রাহক সম্পর্ক সংশ্লিষ্ট। যেমন নতুন সংযোগ দেওয়ার ক্ষেত্রে ঘুষ ছাড়া কাজ হয় না; মিটার রিডারদের ম্যানেজ করতে না পারলে ভুতুড়ে বিল এসে কড়া নাড়ে। এসব ওপেনসিক্রেট। ট্রান্সফরমার নষ্ট হলে তার খরচ গ্রাহকের কাছ থেকে আদায় করার নজিরও বিশ্বের আর কোথাও আছে কি-না, আমরা জানি না। পরিচালক কিংবা প্রকৌশলীর সংখ্যা বাড়িয়ে কি তৃণমূল পর্যায়ে গ্রাহক হয়রানি দূর করা যাবে? পুনর্গঠন পরিকল্পনায় অবশ্য নতুন সংযোগের আবেদন অনলাইনে গ্রহণের চিন্তা-ভাবনা চলছে। বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের একটি দেশে গ্রামীণ জনপদের জন্য নির্ধারিত বিদ্যুৎ বিতরণ নেটওয়ার্কে এমন উদ্যোগ কতখানি বাস্তবসম্মত? কথিত বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে পল্লী বিদ্যুৎ সমিতিগুলোতে অস্বাভাবিক ব্যয় ও ভর্তুকি কমানো না বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে তা সময়ই বলে দেবে। বিদ্যুতের দামের ক্ষেত্রে শহরাঞ্চলের সঙ্গে পল্লী বিদ্যুতের যে বৈষম্য রয়েছে, তা দূরীকরণের প্রতিশ্রুতিও পুনর্গঠন পরিকল্পনায় থাকবে বলে আমরা বিশ্বাস করি। আয় বিবেচনায় গ্রামাঞ্চলে সরবরাহকৃত বিদ্যুতের দামই কম হওয়া সঙ্গত। দুর্ভাগ্যবশত আমরা তিন দশক ধরে বিপরীত পথে হেঁটেছি। তবে গোটা প্রক্রিয়ার দ্বিতীয় ইতিবাচক দিক হচ্ছে, বিশ্বব্যাংকের মতো প্রভাবশালী প্রতিষ্ঠানের প্রস্তাব এড়িয়ে পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড নিজেই একটি পুনর্গঠন পরিকল্পনা করেছে। এখন এর কার্যকর বাস্তবায়নের মাধ্যমে পল্লী বিদ্যুৎ ব্যবস্থায় নিয়ম-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা ও গ্রাহক সেবার মান বৃদ্ধি করা গেলেই প্রতিষ্ঠানটি যথার্থ সাধুবাদ পাবে। পুনর্গঠনের বিড়াল সাদা না কালো, তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে এটি অনিয়ম ও দুঃসেবার ইঁদুর ধরতে সক্ষম কি-না।

No comments

Powered by Blogger.