বেহাল রাজনীতি ও অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ by জেড এ খান

দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে অশনিসংকেত শুনতে পাচ্ছি। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিতে ক্রমবর্ধমান অস্থিরতা, দৈনন্দিন পণ্যসামগ্রীর মূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতি, উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমঝোতার অভাব ও সরকারের দেশের প্রধান সমস্যা সমাধানের ব্যাপারে দৃশ্যত নিষ্ক্রিয়তা, শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি ও আওয়ামী লীগের


নেতা-কর্মীদের ক্ষমতার অপব্যবহারের প্রতি সরকারের নির্লিপ্ততা- এ সবই এই অশনিসংকেতের প্রধান উপাদান বলে বিবেচিত হচ্ছে। জনগণের নিশ্চিত ধারণা হচ্ছে, আমাদের দেশ একটি কঠিন সংকটের দিকে দ্রুত ধাবিত হচ্ছে। জনগণের স্বস্তি, শান্তি ও ধৈর্যের মাত্রা এখন প্রায় শূন্যের কোঠায় এসে দাঁড়িয়েছে। এর পাশাপাশি ব্যক্তিনিরাপত্তা নিয়েও তারা শঙ্কিত। এর কারণ জানতে চাইলে তারা উদীয়মান রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও সাবেক সংসদ সদস্য ইলিয়াস আলীর কথা বলছে। হত্যা, গুম, সংক্ষিপ্ত বিচারের মাধ্যমে জেল ও সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু আমাদের জীবনে নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য জনগণ হা-হুতাশ করছে।
আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সরকারের ব্যর্থতার কারণে জনজীবনেও তাদের প্রত্যাশায় বিরাট ফাটল ধরেছে। তিস্তা নিয়ে ভারতের সঙ্গে সমঝোতা করতে ব্যর্থতা, পদ্মা সেতু নির্মাণে বিশ্বব্যাংকের সহযোগিতা জোগাড় করতে না পারা, টিপাইমুখে ভারতের বাঁধ নির্মাণের একতরফা পরিকল্পনা বাস্তবায়নকে রোধ করতে না পারা- এসবই সরকারের অপরিপক্ব পদক্ষেপ নেওয়ার কারণে হচ্ছে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন। দেশের ৮০ শতাংশ মেহনতি মানুষ আজ দৈনন্দিন পণ্যসামগ্রীর মূল্যের বেপরোয়া বৃদ্ধিতে একেবারে দিশেহারা হয়ে পড়েছে। কোথায় গেলে তারা একটু আশার আলো দেখতে পাবে সেই অন্বেষণে তারা ছুটছে। '৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে আত্মবলিদান দিতে কোটি জনতার ঢল নেমে ছিল যুদ্ধাঙ্গনে। কী ছিল তাদের প্রেষণা? ওরা ভেবেছিল পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকে যে বঞ্চনা ও প্রতারণার শিকার হয়েছিল তা থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে, সর্বজনীন গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে, মায়ের ভাষায় দুঃখ-দুর্দশার কথা বলা যাবে আর মুক্ত স্বাধীন ও প্রবঞ্চনাবিহীন জীবন যাপন করা যাবে। আমাদের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তিতে যে সাগর দূরত্বের ব্যবধান ঘটবে তা কেউ ভাবতে পারেনি। ওরা ভেবেছিল, পাকিস্তানের সময়কালের ২৯টি পরিবারের সম্পদ লুণ্ঠনের ঘোড়দৌড় স্বাধীন বাংলাদেশে আর দেখা যাবে না। জীবন বাজি রেখে স্বাধীন করা বাংলাদেশের বয়স এখন চার দশকের ঊধর্ে্ব। কিন্তু আজ অবধি আমাদের মেহনতি জনতা সুখের স্পর্শটুকুও পায়নি। এখনো তারা অভাবে জর্জরিত।
পাকিস্তানের ২৯ পরিবারের জায়গায় প্রায় ২৯০ পরিবার একটি বঞ্চনার নীলনকশা প্রণয়ন করে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এখন আমাদের বঞ্চিত করছে। দিন দিন ধনীরা আরো ধনাঢ্য হচ্ছে, দরিদ্ররা হচ্ছে দরিদ্রতর। একেই বুঝি বলে অদৃষ্টের পরিহাস। আর কতকাল ওরা এই রাজনৈতিক চক্রের বেড়াজালে আবদ্ধ থাকবে? মনে হয়, বাঁধভাঙা স্রোতের মতো হঠাৎই জনগণ অসহনীয় শোষণ থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য মাঠে নামবে। তাই আমি সবাইকে আহ্বান জানাচ্ছি, জনকল্যাণের পরিকল্পনা প্রণয়ন বাস্তবায়ন করতে সরকারকে বাধ্য করতে প্রস্তুত হোন। কেবল ব্যক্তিস্বার্থে বা রাজনৈতিক স্বার্থে জনগণ যেন একতরফা আর ব্যবহৃত না হোন সেই বিষয়ে উদ্যোগ নিন। কেউ কেউ দুঃখ করে বলে, রাজনৈতিক নেতৃত্বের বন্ধ্যাত্বের কারণে আজ আমরা দিশেহারা। আমি এ ধরনের উপসংহারের ঘোরবিরোধী। আমার বিশ্বাস, কিছুসংখ্যক উচ্চাভিলাষী ও অপরিণামদর্শী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব আমাদের প্রথম সোপানের রাজনৈতিক নেতাদের জনগণ থেকে দূরে রেখে ব্যক্তিস্বার্থ উদ্ধারের প্রবণতাই আমাদের নৈরাশ্যের প্রধান কারণ।
আমি আশাবাদী, আমার বিবেচনায় নিচের কয়েকটি পদক্ষেপ নিলে আমরা উন্নয়নমুখী, কল্যাণবান্ধব ও শোষণমুক্ত রাজনৈতিক পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারি :
* সংসদকে সব সরকারের নীতিনির্ধারণের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে গণ্য করতে হবে।
* সংসদ ছায়া সরকারের ভূমিকা রাখার ব্যাপারে সরকারকে আন্তরিক হতে বাধ্য করতে হবে।
* সরকারের সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতার কারণে বিরোধী দলকে অবহেলা করা চলবে না। সংসদে আসনের ভিত্তিতে আনুপাতিক হারে উভয় দলকেই তাদের বক্তব্য উপস্থাপন করার সুযোগ দিতে হবে। প্রয়োজনে তাদের বক্তব্য রাখার কোটা বাড়াতে হবে।
* জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যম নিয়ে যে বিতর্ক চলছে তা উভয় পক্ষের মধ্যে সমঝোতার ভিত্তিতে কর্মপন্থা নির্ধারণ করতে হবে। এ জন্য বর্তমান সরকারকে অগ্রণী ভূমিকা নিতে হবে। উচ্চ আদালতের দুই টার্মের জন্য সমঝোতার ভিত্তিতে নির্বাচনের মাধ্যম নির্ণয় করা যাবে- এই আদেশের সুযোগ নিয়ে আগামী নির্বাচন যেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের তত্ত্বাবধানে অনুষ্ঠিত হয় এই সিদ্ধান্ত অবশ্যই নিতে হবে।
* সরকারি দলের সদস্যদের সংসদে বিরোধী দলের বক্তব্য যথাযোগ্য সম্ভ্রম ও শ্রদ্ধার সঙ্গে গ্রহণ করতে হবে।
* আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে দলীয় স্বার্থে অযাচিত ভূমিকায় যেন না নামানো যায় সংসদে সেই ধরনের আইন প্রণয়ন করতে হবে।
* সরকারি কর্মকর্তারা যেন দলীয় স্বার্থে ব্যবহৃত না হন, সেদিকে সরকারকে অবশ্যই সচেতন থাকতে হবে।
* ক্যাডারভিত্তিক রাজনীতি পরিহার করতে হবে। বর্তমান সরকারের অঙ্গদলগুলোর সদস্যরা যে লাগামহীন অনাচার ও ব্যভিচার করে আসছে, তা রোধ করার জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য নির্দেশ দিতে হবে এবং তাদের কর্মকাণ্ডে কেউ যদি হস্তক্ষেপ করে তাকেও জননিরাপত্তা আইনের (যা গত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিলুপ্ত করার অঙ্গীকার করেও আজ অবধি বলবৎ রেখেছে) আওতায় এনে সংক্ষিপ্ত আদালতের মাধ্যমে বিচার করে প্রাপ্য সাজা দিতে হবে।
* নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের ঊর্ধ্বগতি রোধকল্পে সরকারকে গণযাতায়াত ব্যবস্থার মান উন্নয়ন করতে হবে। এসব দ্রব্য উদ্বৃত্ত এলাকা থেকে বিভিন্ন এলাকায় নেওয়ার সময় সরকারি দলের ক্যাডাররা যে লাগামহীন চাঁদাবাজি করছে তা রোধের জন্য দৃষ্টান্তমূলক সাজা দিতে হবে; তা না হলে যাতায়াতের খরচের কারণে এর মূল্য অনেক বৃদ্ধি পাবে।
* মজুদকারী সিন্ডিকেটকে (বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সরকারি দল মদদপুষ্ট) জনগণের শত্রু হিসেবে ঘোষণা দিতে হবে এবং সংক্ষিপ্ত আদালতের মাধ্যমে তাদের বিচার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে।
* দেশ ও জনগণের স্বার্থের বিরুদ্ধে কাজ করছে বলে যারা প্রমাণিত হয়েছে তাদের বিচার করতে হবে। কেননা তারা আর যা-ই হোক, দেশপ্রেমিক অবশ্যই নয়। পদ্মা সেতু নির্মাণের যে বেহাল দশা হয়েছে এর জন্য দোষী হিসেবে যারা চিহ্নিত হয়েছে ত্বরিত গতিতে তাদের বিচার হওয়া আশু প্রয়োজন।
* বিশ্ব সমাদৃত গ্রামীণ ব্যাংক গ্রামবাংলার অবহেলিত নারীসমাজের স্বামীর আয়ের ওপর নির্ভরতা থেকে মুক্তি এবং পারিবারিক অর্থ জোগানের মাধ্যমে সচ্ছল জীবনধারণের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীক। নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত এই ব্যাংক বর্তমান সরকারের নানাবিধ গণবিমুখ পদক্ষেপের কারণে ধ্বংসের প্রায় শেষ সোপানে এসে দাঁড়িয়েছে। এর স্বায়ত্তশাসিত ব্যবস্থাপনায় হস্তক্ষেপ করা থেকে সরকারকে অবশ্যই বিরত থাকতে হবে।
* ভারতের কৌটিল্য দ্বারা প্রভাবিত রাজনীতি ও বৈদেশিক নীতির প্রভাব-বলয় থেকে আমাদের দেশকে মুক্ত রাখতে হবে। ভারত আশাব্যঞ্জক প্রতিশ্রুতির ভাঁওতা দিয়ে বর্তমান সরকার থেকে অনেক ফায়দা লুটছে অথচ আমাদের ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত করেছে। এই বৃহৎ প্রতিবেশীকে পাশ কাটিয়ে পৃথিবীর অন্যান্য প্রভাব-বলয়ের সঙ্গে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক গড়তে হবে। আমাদের দেশের কৌশলগত ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে পৃথিবীর অনেক দেশই আমাদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়তে চায়। আমাদের এই সুযোগ নিতে হবে, যাতে ভারত বুঝতে পারে আমরা বন্ধুহীন নই। উল্লিখিত পানিবণ্টন সমস্যা, টিপাইমুখে বাঁধের সমস্যা, তিস্তার ওপর বাঁধের পরিকল্পনা, আমাদের ছিটমহলগুলো ফেরত না দেওয়া, পণ্য আমদানিতে ভারতের পক্ষে ভারসাম্য রক্ষা করা, স্থল ও জলপথে ট্রানজিট দেওয়া সত্ত্বেও আমাদের প্রতি ভারতের অঙ্গীকার পালনে নির্লিপ্ততা- এ সবই ভারতের সঙ্গে আমাদের দূরত্ব বাড়ার কারণ। এ ব্যাপারে আমাদের বৈদেশিক নীতি আরো স্বদেশবান্ধব হওয়া অবশ্যই প্রয়োজন। বর্তমান সরকার এ ব্যাপারে তেমন কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নিচ্ছে বলে পরিলক্ষিত হচ্ছে না।
ঘুষ গ্রহণ, দুর্নীতি ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষার ব্যাপারে শাক দিয়ে মাছ ঢাকার আওয়ামী লীগ সরকারের প্রবণতা, অনিয়ন্ত্রিত ক্যাম্পাস ভায়োলেন্স ও ভারত তোষণ নীতি দেশকে নৈরাজ্য ও অস্থিরতার দিকে ধাবিত করছে। কালক্ষেপণ না করে সরকারের এসব সমস্যা সমাধানের জন্য উদ্যোগ নেওয়া উচিত, নতুবা একটা সংঘাতপূর্ণ উপসংহার যে অনিবার্য তা আমরা দিব্য দৃষ্টিতে দেখতে পাচ্ছি।
লেখক : রাজনীতিবিদ

No comments

Powered by Blogger.