আজহারের জামিন আবেদন খারিজ-আলবদর বাহিনীর প্রধান ছিলেন নিজামী : মিজবাহুর

জামায়াতে ইসলামীর ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল এ টি এম আজহারুল ইসলামের জামিন আবেদন খারিজ করেছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১। তাঁর বিরুদ্ধে আগামী ১৪ অক্টোবর তদন্তের অগ্রগতি প্রতিবেদন দাখিল করতে তদন্ত কর্মকর্তাকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।


এদিকে বাংলাদেশ ইসলামী ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান মিজবাহুর রহমান চৌধুরী ট্রাইব্যুনাল-১-এ জামায়াতে ইসলামীর আমির মতিউর রহমান নিজামীর বিরুদ্ধে প্রথম সাক্ষী হিসেবে সাক্ষ্য দিয়েছেন। তিনি নিজেকে ইসলামী ছাত্রসংঘের সাবেক সদস্য উল্লেখ করে বলেছেন, একাত্তরে স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় আলবদর বাহিনী ছিল জামায়াতে ইসলামীর রেজিমেন্টাল ফোর্স। জামায়াতে ইসলামীর ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘের সদস্যদের নিয়ে গঠন করা এই আলবদর বাহিনীর সদস্যরা সে সময় বুদ্ধিজীবীদের তালিকা তৈরি করে হত্যা করেছে এবং করিয়েছে। এই আলবদর বাহিনীর প্রধান ছিলেন মতিউর রহমান নিজামী। দ্বিতীয় ব্যক্তি ছিলেন আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ।
বিচারপতি নিজামুল হকের নেতৃত্বে ট্রাইব্যুনাল-১-এ সাক্ষী দেন মিজবাহুর রহমান। একই ট্রাইব্যুনালে এ টি এম আজহারুল ইসলামের বিরুদ্ধে আদেশ দেন।
নিজামীর বিরুদ্ধে সাক্ষী : মিজবাহুর রহমান বলেন, আলবদর বাহিনীর প্রত্যেক সদস্য পাকিস্তান সেনাবাহিনী দ্বারা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ছিল। রাজাকার, আল শামস বাহিনী যেভাবে গঠিত হয়েছে, আলবদর বাহিনী সেভাবে গঠিত হয়নি। রাজাকারসহ অন্য সহযোগী বাহিনীগুলোর ওপরে ছিল আলবদর বাহিনী। আলবদর বাহিনীর সদস্যরা ছাত্র হওয়ার কারণে অন্য বাহিনীগুলোর ওপর খবরদারি করত। এ বাহিনী পাকিস্তান সেনাদের পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষভাবে সহযোগিতা করত। মুক্তিযুদ্ধের সমর্থক ব্যক্তি, দল ও প্রতিষ্ঠানগুলোর খবর পাকিস্তান সেনাদের সরবরাহ করত আলবদর বাহিনীর সদস্যরা।
মিজবাহুর রহমান জবানবন্দিতে নিজের শিক্ষাজীবনেরও বর্ণনা দেন। তিনি বলেন, মৌলভীবাজারে একটি স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণী থেকে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত পড়ার সময় তিনি ইসলামী ছাত্র সংঘের সদস্য হন। তিনি মৌলভীবাজার ছাত্রসংঘের সভাপতি সিরাজুল ইসলামের আহ্বানে শাহিন ফৌজ নামে একটি শিশু-কিশোর সংগঠনে যোগ দেন। এরপর তিনি ছাত্রসংঘের সদস্য পদ নেন। তিনি বলেন, একাত্তরের আগ পর্যন্ত ইসলামী ছাত্রসংঘ একটি নিয়মতান্ত্রিক ছাত্র সংগঠন ছিল। সংগঠনটিতে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা ছিল। সংগঠনের কর্মীদের মাওলানা মওদুদীর বই পড়তে হতো।
মিজবাহুর রহমান বলেন, '১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি বাহিনী বাঙালিদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। তখন আমার বিশ্বাস ছিল ইসলামী সংগঠন হিসেবে জামায়াত ও ছাত্রসংঘের নেতারা এর বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়বে। কিন্তু তারা তা করেনি। জামায়াত ও ছাত্রসংঘের নেতা-কর্মীরা ওই সময় পাকিস্তানি বাহিনীর সহযোগী বিভিন্ন বাহিনী গঠন করে মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়।' তিনি বলেন, '১৯৭১-এর আগস্টে মৌলভীবাজার ইসলামী ছাত্রসংঘের তৎকালীন সভাপতি সিরাজুল ইসলাম মতলিব আমার বাড়িতে আসেন। তিনি আমাকে বাড়িতে না পেয়ে তাঁর হাতে লেখা একটি চিঠি রেখে যান। ওই চিঠিতে ১০ আগস্ট '৭১-এর মধ্যে আমাকে আলবদর বাহিনীতে যোগদানের কথা বলেন। চিঠিতে বলা হয়, আমি যদি আলবদর বাহিনীতে যোগদান করি নিজামী সাহেব (ছাত্রসংঘের তৎকালীন সভাপতি) ব্যক্তিগতভাবে খুশি হবেন। ভারতের দালালদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা আল্লাহর পথের সৈনিকদের কর্তব্য। যারা আলবদর বাহিনীতে যোগ দেবে না তারা ছাত্রসংঘের কর্মী থাকবে না বলেও ওই চিঠিতে উল্লেখ করা হয়। ওই চিঠি পাওয়ার পর আমি তা আমার বাবাকে দেখাই। চিঠি দেখে তিনি অসন্তোষ প্রকাশ করে আমাকে প্রথমে ঢাকা ও পরে লন্ডন পাঠিয়ে দেন।'
মিজবাহুর রহমান আরো বলেন, 'লন্ডনে থাকা অবস্থায় মুসলিম স্টুডেন্ট মুভমেন্টের সঙ্গে যোগ দিই। পরে ইয়ং মুসলিম অর্গানাইজেশন নামে সংগঠন গড়ে তুলি। লন্ডনে থাকাকালীন ১৯৭৪ সালে সৌদি বাদশাহ ফয়সলের আমন্ত্রণে সৌদি আরব সফরে যাই। ওই সফরে সৌদি বাদশাহর সঙ্গে সাক্ষাৎকালে অধ্যাপক গোলাম আযমসহ কয়েকজনকে দেখি। ওই সময় গোলাম আযম বাংলাদেশবিরোধী বিভিন্ন অপপ্রচার চালায়। আমি এর প্রতিবাদ করি।'
ইসলামী ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান বলেন, '১৯৪১ সালে হায়দরাবাদে জামায়াতে ইসলামীর জন্ম। দলটি মানবতাবিরোধী, স্বাধীনতাবিরোধী ফ্যাসিস্ট দল। ১৯৪১ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত এর কার্যকলাপ গবেষণা করেছি। এ দলটি ধর্মের ছদ্মাবরণে কুৎসিত কাজ করে। তাদের বিরোধিতাকারীদের দমন করতে মিথ্যাচার, অত্যাচার, গুম, হত্যার পথ বেছে নেয়। তারা ধর্মের নামে বিভিন্ন দেশ থেকে অর্থ সংগ্রহ করে তা ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য ব্যয় করে।' তাঁর জবানবন্দি শেষ হলে আসামিপক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট মিজানুল ইসলাম জেরা শুরু করেন। জেরা অসমাপ্ত অবস্থায় আগামী ৩ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মামলার কার্যক্রম মুলতবি করা হয়।
আজহারের জামিন নয় : মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে গ্রেপ্তার হওয়া জামায়াতে ইসলামীর ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল এ টি এম আজহারুল ইসলামের জামিন আবেদন খারিজ করেছেন ট্রাইব্যুনাল-১। গতকাল সকালে ট্রাইব্যুনাল-১ আজহারের উপস্থিতিতে এ আদেশ দেন। তবে আসামির চিকিৎসায় কোনো ধরনের গাফিলতি না করতে কারা কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আদেশে আজহারের এমআরআই, সিটি স্ক্যানসহ প্রয়োজনীয় পরীক্ষা করে চিকিৎসা করার নির্দেশ দেওয়া হয়। ট্রাইব্যুনাল জামিন আবেদন খারিজ করে আরো বলেন, আজহারের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। ট্রাইব্যুনালের আইনে জামিনের বিধান নেই। ২২ আগস্ট মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে ট্রাইব্যুনাল পরোয়ানা জারি করলে ওই দিনই এ টি এম আজহারুল ইসলামকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে।
'জামায়াত নেতাদের আইনজীবী রাজ্জাক বদর সদস্য ছিলেন' : মানবতাবিরোধী অপরাধে বিচারের মুখোমুখি গোলাম আযম, মতিউর রহমান নিজামীসহ জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষস্থানীয় নেতাদের আইনজীবী ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় আলবদর বাহিনীর সক্রিয় সদস্য ছিলেন উল্লেখ করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দিয়েছেন মহাজোট সরকারের শরিক দল বাংলাদেশ ইসলামী ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান মিজবাহুর রহমান চৌধুরী।
গতকাল রবিবার বিচারপতি নিজামুল হকের নেতৃত্বে ট্রাইব্যুনাল-১-এ জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামীর বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে এসে জবানবন্দিতে তিনি এ অভিযোগ তোলেন। পরে এক বিবৃতিতে ব্যারিস্টার রাজ্জাক দাবি করেন, তাঁর বিরুদ্ধে তোলা অভিযোগ ভিত্তিহীন।
মিজবাহুর রহমান বলেন, 'লন্ডনে থাকাকালে ১৯৭৪ সালে আবদুর রাজ্জাক (ওই সময় ব্যারিস্টার ছিলেন না) আমাকে একটি বৈঠকে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানান। এরপর ইয়াং মুসলিম অর্গানাইজেশনের তৎকালীন সভাপতি এ জেড শাহকে (বর্তমানে ঢাবি অধ্যাপক) নিয়ে বৈঠকে যোগ দিই। ওই বৈঠকে গিয়ে দেখি, পাকিস্তান জামায়াতের আমির মিয়া তোফায়েল, গোলাম আযম, যুদ্ধাপরাধী চৌধুরী মাইনুদ্দিনসহ বেশ কয়েকজন উপস্থিত রয়েছেন। ওই বৈঠকে ব্যারিস্টার রাজ্জাক বক্তব্য দেন। তাঁর বক্তব্য থেকে জানতে পারি, তিনি মুক্তিযুদ্ধকালে আলবদর বাহিনীর সক্রিয় সদস্য ছিলেন। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সঙ্গে থেকে আলবদর বাহিনীর অর্পিত দায়িত্ব পালন করেছেন। দেশ স্বাধীনের পর রাজ্জাক ভারতে পালিয়ে যান। সেখান থেকে নেপাল হয়ে পাকিস্তানে যান। পরে পাকিস্তানি পাসপোর্ট নিয়ে লন্ডনে যান।'
এ বক্তব্যের পর প্রসিকিউটর জেয়াদ আল মালুম সাংবাদিকদের বলেন, মিজবাহুর রহমান চৌধুরী বলেছেন, ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক আলবদর বাহিনীর কমান্ডার ছিলেন।
এ বক্তব্যের পর ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক ট্রাইব্যুনালের সামনে সাংবাদিকদের বলেন, মিজবাহুর রহমানের বক্তব্য মিথ্যা ও ভিত্তিহীন। জামায়াত নেতাদের পক্ষে বিচারকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য এ অভিযোগ করা হয়েছে। পরে ব্যারিস্টার রাজ্জাক গণমাধ্যমের উদ্দেশ্যে পাঠানো একটি বিবৃতিও এ দাবি করেন।

No comments

Powered by Blogger.