সামাজিক বনায়নের গুরুত্ব by শাহনাজ সিদ্দিকী নিম্মু

আজ ১৫ মার্চ বিশ্ব বন দিবস। পরিবেশ রক্ষায় গাছপালা, বন-বনানীর ভূমিকার কথা স্বীকার করে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এ দিবসটি যথাযথ মর্যাদার সঙ্গে পালন করা হলেও আমাদের দেশে দিবসটিতে তেমন কোনো কর্মসূচি গ্রহণ করা হয় না। বর্তমান বিশ্বে জলবায়ু পরিবর্তনে সামাজিক বনায়নের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। কেননা সামাজিক বনায়ন (ঈড়সসঁহরঃু ঋড়ত্বংঃত্ু) হলো এমন ব্যবস্থাপন/কর্মকাণ্ড, যার সঙ্গে পল্লীবাসী ওতপ্রোতভাবে জড়িত এবং নিবিড় সম্পর্কযুক্ত।

ঐতিহ্যগত বন ব্যবস্থাপনা পদ্ধতিতে এটাই প্রমাণিত হয় যে বনায়নে স্থানীয় সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ ছাড়া বন সংরক্ষণ দুরূহ কাজ। যে বনায়ন কার্যক্রমে সাধারণ মানুষের চাহিদা ও আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটে না, তা কখনওই সফলতা লাভ করতে পারে না। সুতরাং বনায়ন কার্যক্রমে স্থানীয় জনসাধারণকে জড়িত করা অবশ্যই করণীয় হয়ে উঠেছে। সামাজিক বনায়ন কার্যক্রমে স্থানীয় ভূমিহীন কৃষি শ্রমিক ও দরিদ্র বেকার যুবক সম্প্রদায়কে কাজে লাগানো প্রয়োজন। তাদের বন থেকে প্রাপ্ত সুফল ভোগ করতে দিলে এ কার্যক্রম সক্রিয়ভাবে বাস্তবায়িত হবে। সামাজিক বনায়ন এমন একটি ভূমি ব্যবহারের কারিগরি ও আর্থ-সামাজিক প্রক্রিয়া, যা বর্তমান বিশ্বে তথা বিশ্বের দেশগুলোর অপরিসীম গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচিত হয়েছে। ভারত, নেপাল, ফিলিপাইন, কেনিয়া, সুদান, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া ও জাপানে এরই মধ্যে এ কর্মসূচি সাফল্য লাভ করেছে। সামাজিক বনায়নের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে পরিবেশ উন্নয়নের পাশাপাশি আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়ন করা। সামাজিক বনায়নের উদ্দেশ্যগুলো নিম্নে প্রদান করা হলো : ১. ভোক্তা পর্যায়ে নিত্যব্যবহার্য উদ্ভিদ পণ্যের সহজ জোগান সৃষ্টি, ২. বৃক্ষ রোপণ কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে গ্রামীণ দারিদ্র্য দূরীকরণ, ৩. জমির উর্বরতা শক্তি বৃদ্ধিকরণ, ৪. সবুজ গাছপালার মাধ্যমে প্রাকৃতিক ভারসাম্য বজায় রাখা. ৬. ঘূর্ণিঝড় এবং বন্যার হাত থেকে জনজীবনকে রক্ষা করা, ৭. বর্তমানে যে বনাঞ্চল রয়েছে তার অতিরিক্ত বনাঞ্চল সৃষ্টির মাধ্যমে একটি বাফার জোন তৈরি করা। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা এবং উন্নয়ন কার্যক্রমকে এগিয়ে নিতে দেশের বিভিন্ন স্থানে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে সামাজিক বনায়ন কার্যক্রম চলছে। দ্বিতীয়ত, পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনাকে প্রথম সামাজিক বনায়ন কর্মসূচির অন্তর্ভুক্ত করা হয়। প্রথমে উত্তরাঞ্চলে সামাজিক বনায়ন কর্মসূচি চালানোর উদ্যোগ নেয়া হয়। সরকারের বন বিভাগসহ সড়ক ও জনপথ বিভাগ, কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ এবং বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা (এনজিও) সামাজিক বনায়ন কার্যক্রমে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করায় পর্যায়ক্রমে এ কার্যক্রমটি সামাজিক আন্দোলনে পরিণত হয়েছে। বর্তমান সরকার জলবায়ু পরিবর্তনে সবুজায়নে জনগণকে উদ্বুদ্ধকরণে বনায়ন সম্প্রসারণ কার্যক্রমকে একটি সামাজিক আন্দোলনে রূপদানের লক্ষ্যে চলতি বছর ১০ কোটি চারাগাছ উত্পাদনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। উত্পাদিত চারা গাছ থেকে প্রত্যেক সংসদ সদস্যকে ২৫ হাজার করে চারা গাছ দেবে। তাদের তত্ত্বাবধানে জনগণকে সবুজায়নে আগ্রহী করতে স্থানীয় উপজেলা চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান ও ইউপি সদস্যরা প্রত্যেক স্কুল-কলেজ, মাদ্রাসা ও রাস্তার পাশে এসব চারা গাছ লাগাবে। বলাবাহুল্য জলবায়ু ও মাটির গুণে প্রাচীনকাল থেকেই বাংলাদেশ সবুজের সমারোহের জন্য সুপ্রসিদ্ধ। আর এ সমারোহ শুধু গাছের সংখ্যাধিক্যে সীমাবদ্ধ ছিল না, প্রজাতির বৈচিত্র্যেও সমৃদ্ধ ছিল। পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষার্থে একটি দেশের আয়তনের শতকরা ২৫ ভাগ এলাকায় বনভূমি থাকা একান্ত প্রয়োজন বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। কিন্তু বাংলাদেশের আয়তনের তুলনায় বনাচ্ছাদিত এলাকার পরিমাণ মাত্র ৭.৭ ভাগ এবং ভূমি এলাকার ১৪ শতাংশ বনাঞ্চল। প্রাকৃতিক ও পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষায় বনভূমির যেমন বিরাট ভূমিকা রয়েছে, তেমনি সুষম অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রেও এর গুরুত্ব অপরিসীম। গাছপালা বিশেষ করে শহরাঞ্চলে সম্পত্তির মূল্য বাড়িয়ে দেয় এবং এলাকার শোভা বাড়িয়ে ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটাতে সাহায্য করে। যে রাস্তার পাশে প্রচুর গাছ আছে সে রাস্তার দোকানে ক্রেতাদের ভিড় অনেক বেশি। ব্যাপক হারে গাছ লাগিয়ে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে পর্যটন ব্যবসার প্রসার ঘটানো সম্ভব। গাছ দিয়ে প্রাকৃতিক দেয়াল সৃষ্টি করা সম্ভব। গ্রামাঞ্চলে ক্ষেতের সীমানায় মাদার, ভেরেন্ডা, জিয়ল ইত্যাদি গাছ দিয়ে সীমানা বেড়া নির্মাণ করা হয়। বাংলাদেশ বন গবেষণা ইনস্টিটিউট পরীক্ষার পর বেড়ার জন্য কাঁটাযুক্ত মাদার ও বিভিন্ন কাঁটাযুক্ত বেতের সমন্বয় জীবন্ত বেড়ার মডেল তৈরি করেছে। এসব জীবন্ত বেড়া একবার সৃষ্টি হলে পরে আর মেরামতের প্রয়োজন হবে না এবং সব সময়ই শক্ত ও মজবুত থাকবে। জীবন্ত বেড়া শুধু বেড়ার কাজই করে না—একদিকে আয়ের উত্স সৃষ্টি করে এবং অন্যদিকে পরিবেশ সংরক্ষণে সহায়তা করে। গাছ ছায়া দিয়ে গ্রীষ্মে তাপমাত্রা হ্রাস করে এবং বাড়িঘরের পরিবেশ শীতল রাখে। একইভাবে শেকড় থেকে যে পানি গাছের উপরাংশে উঠে আসে তা বাষ্পে পরিণত হয়ে পারিপার্শ্বের অনেক তাপ শুষে নেয়। যখন পানির প্রাপ্তি এবং তাপমাত্রা বেশি থাকে তখন একটি বড় গাছ এক দিনে ৪০০ গ্যালন পর্যন্ত পানি বাষ্পে পরিণত করতে পারে। এর ফলে বিশেষ করে শহরাঞ্চলের ঘরবাড়ি, অফিস-আদালত, শিল্পকারখানা ইত্যাদি ঠাণ্ডা রাখার জন্য বিদ্যুত্ খরচের অনেকখানি সাশ্রয় হতে পারে। ব্যাপকভাবে বৃক্ষনিধনের ফলে পরিবেশ বিপর্যয়ের বিষয়টি আজ সর্বজনস্বীকৃত। সব ধ্বংসের এ আত্মঘাতী প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকলে দেশ মরুভূমিতে পরিণত হবে। বিভিন্নভাবে বনভূমি হ্রাস পাওয়ার কারণে প্রকৃতি ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছে। ভূমিক্ষয় ত্বরান্বিত হচ্ছে। নদীর ভাঙন বৃদ্ধি পাচ্ছে। ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে। বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল কমে যাওয়ায় অনেক বন্যপ্রাণী বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। ফলে আমাদের অর্থনৈতিক জীবনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিচ্ছে। বিরাজমান অবস্থায় পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার্থে উন্নয়ন প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখার লক্ষ্যে বিদ্যমান গাছপালা সংরক্ষণ ছাড়াও নতুন করে বন সৃষ্টি, গাছপালা লাগানো আমাদের অপরিহার্য দায়িত্ব ও কর্তব্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.