নারীর প্রতি সহিংসতা বেড়েছেঃ আইন আছে প্রয়োগ শিথিল

দেশে আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে যাচ্ছে নারী নির্যাতন। ঘরে-বাইরে নতুন নতুন ধরনে নির্যাতনের নিরুপায় শিকার হচ্ছে নারী ও শিশু। পরিবার, কর্মক্ষেত্র, রাস্তাঘাট, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণেও নির্যাতিত হচ্ছেন নারীরা। গণমাধ্যমে প্রতিদিন প্রকাশ পাচ্ছে এসব খবর। বাস্তবে বেশিরভাগ শারীরিক-মানসিক নির্যাতনের ঘটনা থেকে যাচ্ছে লোকচক্ষুর আড়ালে।

অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, সমাজ ক্রমেই অন্ধকারের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। হত্যা, ধর্ষণ, ধর্ষণজনিত আত্মহত্যা, অপহরণ, অ্যাসিড নিক্ষেপ, স্কুল-কলেজগামী ছাত্রীদের উত্ত্যক্ত করা ইত্যাদি অপরাধের ক্রমবর্ধমান হার এক ভয়ঙ্কর পরিবেশের আশঙ্কাকেই ঘনীভূত করছে। অস্বীকার করার আর কোনো উপায় নেই যে, এই উদ্বেগজনক পরিস্থিতির জন্য প্রধানত দায়ী আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তথা পুলিশের কার্যকর উদ্যোগের অভাব। দেশের বিশিষ্ট নারী নেত্রী এবং মানবাধিকার সংগঠকরা বলছেন, সরকারিভাবে যথাযথ পদক্ষেপ না নেয়ায়, ক্ষেত্রবিশেষে আইনের অপপ্রয়োগ এবং পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি নারী নির্যাতন বেড়ে যাওয়ার প্রধান কারণ। এ অবস্থায় এখনই অপরাধপ্রবণ মানসিকতার পরিবর্তন এবং অপরাধীদের লাগাম টানা সম্ভব না হলে এ সমাজ অচিরেই বাসের অযোগ্য হয়ে উঠবে।
মানবাধিকার সংস্থা ‘অধিকার’-এর প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, ২০০৯ সালের পয়লা জানুয়ারি থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত এক বছরে ধর্ষণের পর হত্যার শিকার হয়েছেন ৯৭ জন নারী ও কন্যাশিশু। ধর্ষণের শিকার ৪৫৪ জন নারীর মধ্যে প্রাপ্তবয়স্ক নারী ২১১ জন এবং কন্যাশিশু ২৪৩ জন। গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৯৭ জন প্রাপ্তবয়স্ক নারী ও ৭৯ জন কন্যাশিশু। বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থার এক বছরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ১০৯ জন নারী হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন যৌতুকের কারণে। এ সংক্রান্ত একটি বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে ১৩ মার্চ, দৈনিক আমার দেশ-এ।
নারী নির্যাতন পরিস্থিতির এতটাই অবনতি ঘটেছে যে, সারা বিশ্ব যখন নারী অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস উদ্যাপনে ব্যস্ত, সেদিন লাঞ্ছিত হওয়ার বিচার না পেয়ে আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছে বগুড়ায় শেরপুরের জনৈক কলেজছাত্রী। এ ধরনের সম্ভ্রমহানির অনেক ঘটনা সামাজিক কারণে অনেকেই গোপন রাখেন। এভাবে সমাজদেহের ভয়াবহ পচন দৃশ্যত আড়াল থাকে মাত্র। উল্লেখ্য, বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো শিক্ষাঙ্গনে শিক্ষকের হাতে ছাত্রী লাঞ্ছনা, রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার সুযোগ নিয়ে ঢাকার একটি সরকারি মহিলা কলেজে কতিপয় ছাত্রীকে অনৈতিক কাজ করার জন্য চাপ সৃষ্টির খবর বেরিয়েছে কাগজে। লজ্জায় অধোবদন হলেই কি নারীর প্রতি নারীর এই জঘন্যতম আচরণের গ্লানি থেকে রক্ষা পাওয়া যায়? এমনকি ধর্ষণের সময় সিডি করে বাজারজাত করছে দুর্বৃত্তরা। পতিতাবৃত্তিতে নিয়োগ করছে জোর করে। এরপর নারী নিগ্রহ কোথায় গিয়ে ঠেকেছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। সম্প্রতি অতি উত্সাহী পুলিশ ‘জঙ্গি’ সন্দেহে বোরকাপরা এক শিক্ষিকা ও দুই ছাত্রীকে তিন দিনের রিমান্ডে নিয়েছিল। তাদের বোরকা ছাড়া ছবি ছাপা হয়েছে পত্রিকায়; কিন্তু অপরাধ প্রমাণিত হয়নি। যা হয়েছে তা হলো, জীবনভর বহন করতে হবে এমন একটি যাতনা তাদের উপহার দিয়েছে পুলিশ। ঘটনাটি ঘটেছে ৩ জুলাই পিরোজপুর জেলার জিয়ানগর থানায়।
নারী নির্যাতনের প্রতিকার ও নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব যাদের, সেই পুলিশই যদি অনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ে এবং আইন প্রয়োগ না করে হাত গুটিয়ে রাখে তাহলে নৈতিক সর্বনাশের আর কীইবা বাকি থাকে! অথচ নারী নির্যাতনের কোনো ঘটনা ঘটলে প্রথমেই যেতে হয় পুলিশের কাছে। ক্ষেত্রবিশেষে মামলা হলেও নানা কারণে প্রমাণের অভাবে অসংখ্য বিচার ঝুলে যায়। এ থেকে উত্সাহিত হয় অপরাধীরা। দৃষ্টান্তস্বরূপ—ধর্ষণের ঘটনা বেড়েছে কিন্তু মৃত্যুদণ্ডের আইন কার্যকর হচ্ছে না। অর্থাত্ কাজীর গরু কেতাবে আছে, গোয়ালে নেই।
একথা ধ্রুব সত্য যে, নারী নির্যাতন আইন যদি আক্ষরিক অর্থে রূপায়িত না হয়, মাঠ পর্যায়ে পুলিশ তার দায়িত্ব পালন না করে তাহলে নারী নির্যাতন কমবে না। চিঁড়ে ভিজবে না মুখের কথায়। প্রতিটি ঘটনার জন্য দ্রুত শাস্তির দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে। নারীর আর্থ-সামাজিক নিরাপত্তার বলয় বাড়াতে হবে, বাড়াতে হবে গণসচেতনতা। এসব ব্যাপারে সরকারের ভূমিকা মোটেই উল্লেখ করার মতো নয়। দিন বদলের কথা বলে অপরাধীর লাগাম কষতে না পারলে ফলাফল নেতিবাচক হতে বাধ্য। সরকার কি সেই ভয়াবহ পরিণতির জন্য নির্বিকার অপেক্ষা করবে?

No comments

Powered by Blogger.