বাঙালীর শুদ্ধ নাম শেখ মুজিবুর রহমান by সুভাষ সিংহ রায়

শিরোনামের এই বাক্যটি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজীর অধ্যাপক কবি মোহাম্মদ রফিকের। বর্তমান জাতীয় সংসদ সদস্য বেবী মওদুদ বেশ কয়েক বছর আগে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে একটা কবিতা সঙ্কলন প্রকাশ করেছিলেন। নাম দিয়েছিলেন, ‘বাঙালীর শুদ্ধ নাম শেখ মুজিবুর রহমান’।


সেই গ্রন্থে দক্ষিণপন্থী কবি হিসেবে সমধিক পরিচিত কবি আল মাহমুদের ‘নিশি ডাক’ নামে একটা কবিতা ছিল। সেই প্রথম পাঠক জানতে পারে কবি আল মাহমুদও বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কবিতা লিখেছেন। কবিতার গাঁথুনিতে কোথাও ‘বঙ্গবন্ধু’ শব্দ নেই। অথচ বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে অসাধারণ কবিতা; এ যেন আরেক সোনালী কাবিন। তাঁর ‘নিশি ডাক’ কবিতার অংশ বিশেষ এখানে উৎকলন করা যেতে পারে। “সে যখন, ‘ভাইসব।’ অমনি অরণ্যের এলোমেলো গাছেরাও সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে গেল।/ সে যখন ডাকলো “ভাইয়েরা আমার।’/ভেঙ্গে যাওয়া পাখির ঝাঁক ভীড় করে নেমে এল পৃথিবীর ডাঙ্গায়/কবিরা কলম ও বন্দুকের পার্থক্য ভুলে হাঁটতে লাগলো খোলা ময়দানে।” পৃথিবীতে একমাত্র নেতা শেখ মুজিবুর রহমান যার মৃত্যুর পর তাঁর হত্যাকারী ও হত্যাকা-ের বেনিফিশিয়ারিরা নাম নিশানা মুছে দেবার জন্য সব পন্থা অবলম্বন করেছে। ধরেই নিলাম একজন নেত্রীর প্রকৃত জন্মদিন ১৫ আগস্ট তাই বলে এত বছর পরে তা মনে পড়বে। জাতি যখন শোক দিবস পালন করে তখন জন্মদিনের উৎসব করবে?! আমার ধারণা বিএনপির অধিকাংশ কর্মী-সমর্থকও তা পছন্দ করেন না। বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবার নিয়ে কত অপপ্রচারই না এই দেশে হয়েছে। যে মহান লোকটির জন্ম না হলে এই দেশটার কেউ প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি, মন্ত্রী, পাতিমন্ত্রী হতে পারত না। হায় রে ‘কৃতঘœ জাতি’ (কৃতঘœ-যে উপকারীর অপকার করে)। এবং যুগ যুগ ধরে এই মাটিতে শুধু অপপ্রচারই হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথমবর্ষের ছাত্র হওয়ার সময় বিদগ্ধজনরা (সবাই না) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেছিলেন। কি সাংঘাতিক কথা। সন, তারিখ দিয়ে বলা হতো। বলা হয়েছিল, ১৯১২ সালের ২৮ মার্চ কলকাতার গড়ের মাঠে এক বিশাল সভা হয়েছিল; বিষয় ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা। কিন্তু পাঠক ইতিহাস ঘেঁটে দেখুন, ১৯১২ সালের ২৪ মার্চ থেকে ১২ এপ্রিল পর্যন্ত কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শিলাইদহে অবস্থান করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ ও বঙ্গবন্ধু বাঙালীর এই দুই সূর্য সন্তানের নানা বিষয়ে মিল রয়েছে। তাঁরা দু’জনই অপপ্রচারের শিকার হয়েছেন। রবীন্দ্রনাথের দ্বিতীয় বিবাহের মিথ্যে সংবাদ তৎকালীন খ্যাতনামা পত্রিকায় বড় বড় হরফে ছাপা হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু ও রবীন্দ্রনাথ দু’জনই মহাপ্রয়াণে যাত্রা করেন এই আগস্ট মাসে। রবীন্দ্রনাথ ৭ আগস্ট এবং বঙ্গবন্ধু ১৫ আগস্ট। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামেরও এই আগস্টেই মহাপ্রয়াণ ঘটে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর বঙ্গবন্ধুর নাম উচ্চারণ এ দেশে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে নিষিদ্ধ করা যায়? দেশী-বিদেশী চক্রান্তকারীরা শেখ মুজিবকে শারীরিকভাবে হত্যা করতে পেরেছে; কিন্তু তাঁর আদর্শকে হত্যা করতে পারেনি। তিনি আবার ফিরে এসেছেন ধানসিঁড়িটির তীরে এই বাংলায়। কেননা শেখ মুজিব পাকিস্তান সৃষ্টির আগেই বাংলাদেশ নির্মাণের স্বপ্ন দেখেছেন। পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম হয় ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট আর কলকাতার বেকার হোস্টেলে ‘বাংলাদেশ’ নিয়ে কথা বলছেন তারও কয়েক মাস আগে। শেখ মুজিব বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল এর মতো মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন ‘বাংলা বাঙালীর হোক; বাংলার জয় হোক; বাঙালীর জয় হোক।’ ১৩৪৯ বঙ্গাব্দে বিদ্রোহী কবি ‘বাঙালীর বাঙলা’ নামে প্রবন্ধে যা লিখেছিলেন তা খুবই প্রণিধানযোগ্য। বাঙালীকে, বাঙালীর ছেলেমেয়েকে ছেলেবেলা থেকে শুধু এই এক মন্ত্র শেখাও : “এই পবিত্র বাংলাদেশ বাঙালীর-আমাদের। দিয়া ‘প্রহায়েণ ধনঞ্জয়’ তাড়াবো আমরা, করি না ভয় যত পরদেশী দস্যু ডাকাত ‘রামা’দের ‘গামা’দের।” আজ থেকে ৭০ বছর আগের কবি নজরুলের এই আহ্বান শেখ মুজিবকে খুব বেশি অনুপ্রাণিত করেছিল। তাই খুব স্বাভাবিকভাবে বলা যায়, হাজার বছরের ইতিহাস শেখ মুজিবকে সৃষ্টি করেছে; আবার শেখ মুজিব হাজার বছরের বাঙালীর ইতিহাস নতুন করে সৃষ্টি করেছেন। তাই শেখ মুজিবের মৃত্যু দিবসে ভুয়া জন্মদিনের উৎসব খুবই ব্যথিত করে। ১৫ আগস্টে জন্মদিনের উৎসব পালন এক মহাপাপের কাজ। কবি মুহম্মদ নূরুল হুদার একটি কবিতা নামর ‘পনেরো আগস্ট’। কবিতার কয়েকটি চরণ এই পরিসরে উল্লেখ করছি।
আজ পনেরো আগস্ট, আজ বাঙালীর শোক।
অনার্য পতাকা হয়ে বাংলার আকাশটা আজ নত হোক।
আজ খাঁ খাঁ, আজ ধু-ধু, ছিন্ন ভিন্ন মানুষ অশোক রাঢ়ে বঙ্গে হরিকেলে সমতটে
বাঙালীর বজ্রবুকে আজ ঘোর বারিপাত হোক।
বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে দেশে ও দেশের বাইরে অসংখ্য কবি-সাহিত্যিক কবিতার পঙ্ক্তিমালা লিখেছেন। সারা পৃথিবীর বিবেকবান মানুষ বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-কে চরম হৃদয়বিদারক ঘটনা হিসেবে দেখেছেন। কবি মহাদেব সাহা তাঁর কবিতায় লিখেছেন এভাবে, তাঁকে বার্লিনের এক ভায়োলিন বাদক জিজ্ঞেস করেছিলেন, তোমার পরিচয় কি? কবি তৎক্ষণাৎ পকেট থেকে একটা দশ টাকার নোট বের করে বঙ্গবন্ধুর ছবিটা দেখিয়ে বলেছিলেন, এই আমার পরিচয়, এর চেয়ে বেশি কিছু আমি জানি না।

॥ দুই ॥

কবি জীবনানন্দ দাশের মায়ের নাম কুসুম কুমারী দাশ। তিনি তাঁর একটি কবিতায় লিখেছিলেনÑ‘আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে/কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে?’ বাংলার হাজার বছরের ইতিহাসের সেই কাজের ছেলেটির নাম শেখ মুজিবুর রহমান। যারা বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ পাঠ করেছেন তাদের নজরে নিশ্চয়ই এসেছে শেখ মুজিব কতটা কাজের ছেলে ছিলেন। নেতাজি সুভাষ বসুও জেলখানায় বসে একটি অসমাপ্ত আত্মজীবনী লিখেছিলেন; ‘এক ভারতীয় তীর্থযাত্রী’ আমাদের পাঠকদের হাতে তা পৌঁছানোর কথা না। সেখানেও নেতাজি সুভাষ বসু ‘বুকে বল তেজে ভরা প্রাণ’ কথা স্পষ্ট করে বলেছিলেন। ১৯৭১ সালে ‘বঙ্গবন্ধু ও রক্তাক্ত বাংলা’ শীর্ষক এক নিবন্ধে পশ্চিমবঙ্গের খ্যাতনামা লেখক নিরঞ্জন মজুমদার লিখেছিলেন, “দেশে দেশে নেতা অনেকেই জন্মান। কেউ ইতিহাসের একটি পঙ্ক্তি, কেউ একটি পাতা, কেউ বা একটি অধ্যায়। কিন্তু কেউ আবার সমগ্র ইতিহাস। শেখ মুজিব এই সমগ্র ইতিহাস।” বাংলাদেশে বহু মত থাকবে, বহু নেতা থাকবে এটাই গণতান্ত্রিক রাজনীতির মূল কথা। কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বির্তক থাকবে এটা কোন শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ আশা করেন না। একমাত্র অর্বাচীনরাই শেখ মুজিবকে অস্বীকার করতে পারে। গোটা বিশ্ব জানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সারা বাংলার ইতিহাস। বাংলার ইতিহাসের পলিমাটিতে তাঁর জন্ম। ধ্বংস, বিভীষিকা, বিরাট বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে সেই পলিমাটিকে সাড়ে সাত কোটি মানুষের চেতনায় শক্ত ও জমাট করে একটি ভূখ-কে শুধু তাদের মানসে নয়, অস্তিত্বের বাস্তবতায় সত্য করে তোলা এক মহাঐতিহাসিক দায়িত্ব। মুজিব মৃত্যু ভয় উপেক্ষা করে মৃত্যুঞ্জয় নেতার মতো এই ঐতিহাসিক দায়িত্ব ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। ইতিহাসের সন্তান ইতিহাসকে পুনর্নির্মাণ করেছেন। এখানেই তাঁর নেতৃত্বের ঐতিহাসিকতা। সেই শেখ মুজিবকে সেনাবাহিনীর কিছু বিপথগামী উচ্ছৃঙ্খল সদস্য ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করে। সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্তে বঙ্গবন্ধু নিহত হলেও আমেরিকার সুশীল সমাজ এটা কোনভাবেই মেনে নিতে পারেনি। ১৯৮২ সালের আমেরিকার বিখ্যাত সাপ্তাহিক ‘টাইম’ ৫ এপ্রিল সংখ্যায় বলা হয়েছিল, ‘স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম দশ বছরের মধ্যে শেখ মুজিবুর রহমানের আমল ছিল সর্বপ্রথম এবং দীর্ঘ গণতান্ত্রিক আমল। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট স্বাধীনতা সংগ্রামের নায়ক ও প্রথম নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবকে হত্যার পর হঠাৎ গণতান্ত্রিক আমলের অবসান ঘটে।’ ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময়ও এমনটি ঘটেছিল। আমেরিকার তখনকার সরকার বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে ছিল। কিন্তু আমেরিকার সিভিল সমাজ বাংলাদেশের জনগণের মুক্তিসংগ্রামের পক্ষে ছিল। এবং মুক্তিযুদ্ধের সময় সোভিয়েত ইউনিয়ন ও ভারত অকুণ্ঠ সমর্থন না করলে মুক্তিযুদ্ধের সময়কাল অবশ্যই প্রলম্বিত হতো। অথচ মুক্তিযুদ্ধের পরে বিপথগামী মুক্তিযোদ্ধারা সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর মতো আচরণ করেছিল। বাংলাদেশে স্বাধীনতার অব্যবহতি পরে যেখানে সেøাগান দেয়ার কথা ‘চীন মার্কিনের দালালেরা হুঁশিয়ার সাবধান;’ কিন্তু সেøাগান দেয়া হতো ‘রুশ ভারতের দালালরা হুঁশিয়ার সাবধান।’ এ রকম অজ্ঞতাবাদের বশবর্তী হয়ে বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের অর্জনকে ভূলুণ্ঠিত করার চেষ্টা করা হয়েছে। গত দু’বছর আগে প্রয়াত নির্ভীক সাংবাদিক সন্তোষ গুপ্তের ডায়েরি, স্মৃতিকথা ও সাক্ষাতকারভিত্তিক একটি বই প্রকাশিত হয়েছে। সদ্য প্রকাশিত এই গ্রন্থের কিছুটা অংশ এই অংশে সংযুক্ত করছি। “১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোর সম্ভবত সাড়ে ছ’টায় দিকে শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকা-ের কথা শুনি। আমাদের বাসায় যে মহিলা পরিচারিকা কাজ করে তার ছোট মেয়েটি খবরটা প্রথমে আমাকে দেয়। খবরটি শুনে আমার অনুভূতি হলো যে, শেষ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুকে আলেন্দের ভাগ্যবরণ করতে হলো। আর এজন্য আমাদের দেশের সাধারণ মানুষের প্রতি এ হত্যার জন্য আমিও অপরাধী।”

॥ তিন ॥

বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের পর সমগ্র বিশ্বের প্রগতিবাদী, শোষিত-বঞ্চিত মানুষ, নিপীড়িত মানুষ ঘাতকদের অভিশাপ দিয়েছিল। বিবিসি টেলিভিশনের দূরপ্রাচ্য সংবাদদাতা ব্রায়ন বারন বঙ্গবন্ধু হত্যার কয়েকদিন পর বিভিন্ন দেশের সাংবাদিকদের সঙ্গে ঢাকা এসেছিলেন। তৎকালীন হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে তিন দিন আটক থাকার পর তাদের সবাইকে বাংলাদেশ ত্যাগে বাধ্য করা হয়। ১৯৭৫ সালের আগস্ট মাসের শেষ সপ্তাহে লিখিত তাঁর সংবাদ বিবরণীতে বলা হয়, শেখ মুজিব সরকারীভাবে বাংলাদেশের ইতিহাসে এবং জনসাধারণের হৃদয়ে উচ্চতম আসনে পুনর্প্রতিষ্ঠিত হবেন। এটা শুধু সময়ের ব্যাপার। এটা যখন ঘটবে, তখন নিঃসন্দেহে তাঁর বুলেট-বিক্ষত বাসগৃহ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্মারক চিহ্ন এবং কবরস্থান পুণ্য তীর্থে পরিণত হবে । (“দি লিসনার” লন্ডন, ২৮ আগস্ট, ১৯৭৫)। “দি ডেইলি টেলিগ্রাফ” এ প্রকাশিত সংবাদে বলা হয়েছিল, শেখ মুজিবের ভয়াবহ মৃত্যুকে বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষ অপূরণীয় ক্ষতি বলে গণ্য করবে। শেখ মুজিব এখনও জনগণের শ্রদ্ধা ও ভালবাসার পাত্র। এ ছাড়া লন্ডনের বিখ্যাত “দি গার্ডিয়ান পত্রিকার” ২৮ আগস্ট, ১৯৭৫-এর সংখ্যাটিতে মন্তব্য করা হয়েছিল, বাংলাদেশের জনসাধারণ আইয়ুবের রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মীয় প্রচারণা ও সামরিক শাসনের যুগে ফিরে গিয়েছে। বঙ্গবন্ধু যার যা সম্মান তা দিয়েছেন অকৃপণভাবে; কিন্তু তাঁকে খাটো করার চেষ্টা করেছেন অনেকে। মওলানা ভাসানীকে বঙ্গবন্ধু পিতৃসম শ্রদ্ধা করেছেন, কিন্তু বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে সবসময় উস্কানি দিয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর তাঁর ভূমিকা ছিল রহস্যজনক। সেই সময়কার জাসদ ছিল ভয়ানক ধ্বংসাত্মক ভূমিকায়। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ে সেনাবাহিনী প্রধান আতাউল গণি ওসমানী বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের নানাভাবে প্রটেকশন দেবার চেষ্টা করেছেন। আবার নিজে যখন রাষ্ট্রপতি প্রার্থী হয়েছেন তখন আবার বঙ্গবন্ধুর কথা অনবরত বলেছেন।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর বাংলাদেশের পত্রপত্রিকায় বঙ্গবন্ধু শব্দটি ছিল নিষিদ্ধ, কিন্তু বিশ্বের সকল বহুল প্রচারিত পত্রিকাগুলো বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের প্রতিবাদ জানিয়েছিল। সকলেরই স্মরণে থাকা দরকার, স্বাধীনতার সংগ্রামে বঙ্গবন্ধুর বিরোধিতা করে যারা পরাজিত হয়েছিল, তারাই স্বাধীনতার পর কড়ায় গ-ায় সেই পরাজয়ের প্রতিশোধ গ্রহণ করেছে। কারোরই ভুলে যাওয়া উচিত নয়, বঙ্গবন্ধুর পরাজয় মানে স্বাধীনতার মর্মসত্যের পরাজয়। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর বাংলাদেশকে পিছন দিকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। যারা এখনো বলেন, বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর মানুষ কাঁদেনি তারা হচ্ছেন জ্ঞানপাপী ও মতলববাজ। তারা ভাল করেই জানেন, এদেশের দুঃখী মানুষ বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর ডুকরে ডুকরে কেঁদেছে। আওয়ামী লীগের আজকের প্রেসিডিয়াম মেম্বার সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীন যখন বঙ্গবন্ধুর হত্যার বিচার চেয়ে সারা দেশে বক্তৃতা করতেন তখন মানুষ হাউমাউ করে কেঁদেছেন। কবি নির্মলেন্দু গুণ যখন বাংলা একাডেমীতে ১৯৭৭ সালে ২১ ফেব্রুয়ারিতে ‘আমি আজ কারো রক্ত চাইতে আসিনি’ কবিতার লাইনগুলো উচ্চারণ করেছিলেন তখন সমবেত সকলে প্রতিধ্বনি করেছিল। এই কবিতা আজ অনেকের কাছে হয়ত অতি পরিচিত, কিন্তু ওই সময়ে কবির কণ্ঠের উচ্চারিত প্রতিটি শব্দ ছিল সেসময়ের প্রেক্ষাপটে এক একটি শব্দব্রহ্মসম। সেই সময়ের প্রেক্ষাপটে উন্মুক্ত সভায় বঙ্গবন্ধুর হত্যার বিচার চাওয়া তো দূরের কথা, বঙ্গবন্ধুর নাম উচ্চারণ ছিল নিষিদ্ধ। সেই রকম একটি সময়ে কবি নির্মলেন্দু গুণ প্রতিবাদের ও প্রতিরোধের সাহসী মশাল জ্বালিয়েছিলেন। ভাবা যায় না, সেসময় তিনি কি রকম সাহসী উচ্চারণ করেছিলেন।
“সমবেত সকলের মতো আমারো স্বপ্নের প্রতি পক্ষপাত আছে, ভালবাসা আছে, শেষ রাতে দেখা একটি সাহসী স্বপ্ন গতকাল আমাকে বলেছে, আমি যেন কবিতায় শেখ মুজিবের কথা বলি।
আমি তাঁর কথা বলতে এসেছি।”
প্রয়াত লেখক আহমদ ছফার একটি বিশ্লেষণধর্মী গ্রন্থের নাম ‘সাম্প্রতিক বিবেচনা : বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস’। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার পরিচালনায় দায়িত্ব পাবার পর তিনি এই গ্রন্থটি লিখেছিলেন। এই গ্রন্থ থেকে কয়েকটি লাইন পাঠকদের সামনে উপস্থাপন করছি। ‘বাহাত্তর সাল আর ছিয়ানব্বই সাল এক নয়। বাহাত্তর সালে প্রতিক্রিয়ার শক্তি ছিন্ন ভিন্ন হয়ে গিয়েছিল। মৌলবাদের অবস্থান ছিল তখন টলটলায়মান। এখন প্রতিক্রিয়ার শক্তি অনেক বেশি সংহত এবং সুসংহত এবং সংগঠিত। মৌলবাদ অক্টোপাসের মতো ক্রমাগতভাবে আমাদের সমাজকে চারপাশ থেকে বেষ্টন করে ফেলছে। যাঁরা মৌলবাদী তারা শতকরা একশো ভাগ মৌলবাদী। কিন্তু যারা প্রগতিশীল বলে দাবি করে থাকেন তাঁদের কেউ কেউ দশভাগ প্রগতিশীল, পঞ্চাশ ভাগ সুবিধাবাদী, পনেরো ভাগ কাপুরুষ, পাঁচ ভাগ একেবারে জড়বুদ্ধিসম্পন্ন।” সত্যি সত্যি আজকের বাংলাদেশে মৌলবাদীরা চারদিকে ফেলছে বিষাক্ত নিঃশ্বাস। সেরকম সময়ে বঙ্গবন্ধুর মূল্যায়নের জন্য নিবেদিতপ্রাণ অনেক মানুষ দরকার। প্রয়োজন আত্মপ্রত্যয়ী বেশ কিছু নেতা, যাদের নানান প্রতিবন্ধকতা মোকাবেলা করার দৃঢ়তা থাকবে। ১১ জানুয়ারির প্রেক্ষাপটে যাঁরা যথাযথ দায়িত্ব পালন করতে পারেননি তাঁদের নিজেদের পরাজয়ের কারণ নিজেদেরই মূল্যায়ন করা উচিত। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর এ রকম বিশ্বাসযোগ্যতার সঙ্কট দেখা দিয়েছিল। চার জাতীয় নেতা আপোস করেননি বলে তাঁদেরকে জেলখানার ভেতরে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। বাংলাদেশকে একটি সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র বানানোর সুগভীর চক্রান্ত থেকে মূলত বঙ্গবন্ধু হত্যার নীলনকশা করা হয়েছিল।

॥ চার ॥

মনে রাখা দরকার বাঙালী জাতির সবচেয়ে বড় শত্রু সাম্প্রদায়িক শক্তি। এই অপশক্তি বাঙালী জাতিকে উল্টোরথের যাত্রী বানিয়েছে। স্বাধীনতার মর্মসত্য অবগাহন করতে হলে বঙ্গবন্ধুর চেতনার সমুদ্রে ঝাঁপ দিতে হবে। বাঙালী জাতিসত্তা এই মহানামের মধ্যে প্রোথিত হয়ে আছে। তাই তো কবি মোহাম্মদ রফিক বাঙালী জাতির যথার্থ পরিচয়ের কথা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ কাব্যময় মাধুর্যে ব্যক্ত করেছেন, ‘বাঙালীর শুদ্ধ নাম শেখ মুজিবুর রহমান’। অনেক প-িতজন বলে থাকেন স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্র পরিচালনায় দায়িত্ব না নিলে ভাল করতেন। দীর্ঘকাল যাবত অনেকে বলে এসেছেন স্বাধীন রাষ্ট্র নির্মাণে তিনি সার্থক হলেও রাষ্ট্র পরিচালনায় ব্যর্থ হয়েছেন। এ সব প-িতজনরা বিরোধিতার কারণে বিরোধিতা করে থাকেন। এরা বাঙালী জাতির স্বাধীন জাতিসত্তায় বিশ্বাস করেন কিনা সে ব্যাপারে সন্দেহ থেকে যায়। এক্ষেত্রে কবি অন্নদা শঙ্কর রায়ের ‘কাঁদো, প্রিয় দেশ’ গ্রন্থ থেকে একটি নির্বাচিত অংশ পাঠকদের সমীপে প্রাসঙ্গিকভাবে উপস্থাপন করা যেতে পারে। ‘সাক্ষাৎকারের জন্য সেবার বঙ্গবন্ধুর দ্বারস্থ হই। তিনি আমাদের পরম আদরের সঙ্গে গ্রহণ করেন ও আমাদের বিচিত্র প্রশ্নে সহাস্য উত্তর দেন। কথায় কথায় বলেন, “আমার কাজ সারা হয়েছে। আমি আর থাকতে চাইনে। গ্রামে গ্রামে ঘুুরে বেড়াবো। দু’লাখ লোক আমার সঙ্গে ঘুরবে। কিন্তু আমাকে যেতে যেতে দিচ্ছে কে? আমাকে আটকে রেখেছে ওই যাদের দেখছেন ওরাই।” আঙ্গুল দিয়ে দেখান তাঁর দলের চাঁইদের কয়েকজনকে। হেসে হেসে ওঁদের দু’কথা শোনান। কোন নেতাই স্বয়ংসিদ্ধ নন। প্রত্যেকেরই একটা দল থাকে, দলের চাঁই থাকে। তাঁদের তিনি নাচান। তাঁকেও তারা নাচায়। সেদিন আমার সত্যি বিশ্বাস হলো যে কাজের জন্যে মুজিব এসেছিলেন সে কাজ সারা হয়েছে। দেশকে তিনি মুক্ত করে দিয়েছেন। তাকে শাসন করবেন অন্য কেউ। গারিবালডির পর যেমন কাভুর। কিন্তু কাভুরটি কোথায়? তাঁর ধারে কাছে দাঁড়াতে পারেন এমন একজনও কি আছেন। ইতিমধ্যে একদিন আমাদের নিজেদের একজন ডিপ্লোমাটের ভবনে আমার ভোজন। তিনি বলেন, ‘মুজিবুর রহমান যে কোনদিন নিহত হতে পারেন। ভয়ঙ্কর দুর্ভাবনার বিষয়। তাঁর শূন্যস্থান পূরণ করতে পারেন এমন একজনকেও দেখছিনে।” অরাজকতার আগ্নেয়গিরি উপরে দাঁড়িয়ে শেখ সাহেব যাদের অভয় দিচ্ছেন তারা কি জানে তাঁর জীবনই বিপন্ন? জানলে তাঁকে অব্যাহতি দিত। তিনি পদত্যাগ করলে পরে কেউ তাঁকে মারতে চাইত না। তিনিও নিরাপদে গ্রামে ঘুরে বেড়াতেন। কিন্তু কা-ারিকে ছেড়ে দেবে কার ভরসায়? নৌকা যদি ডোবে?

No comments

Powered by Blogger.