মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের রিপোর্টঃ বাংলাদেশে মানবাধিকার পদদলিত

বাংলাদেশের অবস্থা সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টের বার্ষিক প্রতিবেদনে যে চিত্র ফুটে উঠেছে, তাকে স্বাভাবিক ধরে নিলে স্বাভাবিকতার সংজ্ঞা পাল্টে ফেলতে হবে। বৃহস্পতিবার ওয়াশিংটনে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশিত ওই রিপোর্টে বলা হয়েছে, এক বছরে বাংলাদেশে গ্রেফতার করা হয়েছে ৫০ হাজার ৭৮১ জনকে। রিপোর্টে মিডিয়ার ওপর সরকারি হস্তক্ষেপ এবং আমার দেশ, ডেইলি স্টার, প্রথম আলোসহ বিভিন্ন পত্রিকার সাংবাদিককে সরকারি দলের লোকজনের হামলার শিকার হতে হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

রিপোর্টে বলা হয়েছে, র্যাবের হাতে গত এক বছরে মারা গেছে ৪১ জন। সরকারি হেফাজতে নির্যাতনের কারণে মারা গেছে ৫৯ জন বিডিআর সদস্য। ওই রিপোর্টের তথ্য মোতাবেক বাংলাদেশের কারাগারগুলোতে এখন বন্দির সংখ্যা ৭১ হাজার ৮৮০ জন। অথচ কারাগারগুলোর মোট ধারণক্ষমতা হচ্ছে ২৮ হাজার ৬৬৮ জনের। বাকি দুই-তৃতীয়াংশকে বিভিন্ন অভিযোগে দীর্ঘদিন আটক রাখা হয়েছে। বাড়তি বন্দির চাপে কারাগারগুলোর পরিবেশ মানুষ বাসের উপযোগী নেই। কয়েদিদের রাতে পালা করে ঘুমাতে হয়। বিশেষ ক্ষমতা আইনের অপপ্রয়োগ বন্দিদের সংখ্যা অস্বাভাবিক বৃদ্ধির বড় কারণ বলে উল্লেখ করা হয়েছে রিপোর্টে।
স্টেট ডিপার্টমেন্টের মানবাধিকার রিপোর্টের বাংলাদেশ সংক্রান্ত অংশ পড়ে যে কারও মনে হতে পারে, এতে একটা নিষ্ঠুর অগণতান্ত্রিক স্বৈরশাসনের বিবরণ দেয়া হয়েছে। কাগজে-কলমে কিন্তু তা নয়। দেশটি এখন পরিচালিত হচ্ছে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোটের ‘গণতান্ত্রিক’ সরকার দ্বারা। কিন্তু বর্তমান সরকারের হাতে পড়ে বেচারা গণতন্ত্রের এমন দশা হয়েছে যে, পদদলিত মানবাধিকারের আর্তনাদে ভারি হয়ে উঠেছে বাংলার আকাশ-বাতাস। অপরাধী সাব্যস্ত না হয়েও যে দেশে ৫০ হাজারের মতো মানুষকে মাসের পর মাস কারা-যন্ত্রণা ভোগ করতে হয়, সে দেশের সরকারকে আদৌ গণতান্ত্রিক বলা যায় কিনা—এ প্রশ্ন উঠতে বাধ্য। র্যাবের ক্রসফায়ারে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড যে এ সরকারের অতিপ্রিয় পদ্ধতি হয়ে উঠেছে, এক বছরে র্যাবের হাতে ৪১ জন খুন হওয়ার ঘটনা সে সত্যকেই স্পষ্ট করে তুলেছে। সরকারি হেফাজতে রেখে জিজ্ঞাসাবাদকালে যে ৫৯ জন বিডিআর সদস্যের মৃত্যু ঘটেছে, তার প্রত্যেকটিই ‘স্বাভাবিক মৃত্যু’ বলে সরকার দাবি করেছিল। কিন্তু স্টেট ডিপার্টমেন্টের রিপোর্টে সে দাবি নাকচ করে দিয়ে বলা হয়েছে, নির্যাতনের ফলেই তারা মারা গেছে। এ রিপোর্ট প্রকাশিত হওয়ার পর সরকার কী বলবে আমরা জানি না। তবে প্রকৃত পরিস্থিতি যে আরও ভয়ঙ্কর, তা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে এদেশের মানুষ। একদিকে সরকারি দলের এবং বিভিন্ন অঙ্গসংগঠনের ক্যাডারদের তাণ্ডব, অন্যদিকে সরকারি পেটোয়া বাহিনীর ভূমিকায় পুলিশের অকল্পনীয় বাড়াবাড়ি, সেই সঙ্গে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের নামে নারকীয় নির্যাতন—সব মিলিয়ে এদেশের মানুষকে একেবারে দিশেহারা করে ফেলেছে।
আমাদের মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশের মানবাধিকার সংক্রান্ত রিপোর্টটি তৈরি করেছে যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্ট। বাংলাদেশের বর্তমান সরকার যে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ পশ্চিমা দেশগুলোর অতি আদরের, এটা গোপন কোনো তথ্য নয়। সেই প্রিয় সরকারের কাণ্ডকারখানা রয়েসয়ে প্রকাশ করতে গিয়েও বেরিয়ে এসেছে এই ভয়ঙ্কর চিত্র। তাই এ রিপোর্টকে অতিরঞ্জিত বলে পার পাওয়া যাবে না। বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে, এভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘনের রেকর্ড সৃষ্টি করেও নিজেদের গণতন্ত্রের চ্যাম্পিয়ন বলে দাবি করতে বর্তমান সরকারের হর্তাকর্তাদের গলা কাঁপে না। তবে ইতিহাস এই সাক্ষ্য দেয় যে, মানবাধিকার পদদলিত করে অতীতে কেউই কোনো দেশে তার মাশুল না দিয়ে রেহাই পায়নি। আমরা চাই, তেমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ার আগেই সরকারের শুভবুদ্ধির উদয় হোক।

No comments

Powered by Blogger.