আলবদর ১৯৭১ by মুনতাসীর মামুন

(গতকালের পর) ৪. আলবদরদের যাত্রা শুরু আলবদর সম্পর্কে তথ্য যা পাওয়া যায় তাতে কোনো ধারাবাহিকতা নেই। আলবদর শিরোনামে নির্দিষ্ট তথ্য পাওয়াই দুষ্কর। এই নিয়ে অনেককে জিজ্ঞাসাবাদ করেছি, কিন্তু সঠিক কোনো উত্তর পাইনি।


এখন যেসব তথ্য পেয়েছি তা পুনর্বার পরীক্ষা করে ধাঁধার উত্তর পাওয়া গেল। এপ্রিলের শেষের দিক থেকে আলবদর তৈরির প্রক্রিয়া শুরু হয় এবং কালক্রমে ইসলামী ছাত্র সংঘকেই আলবদরে রূপান্তর করা হয়। সুতরাং ছাত্রসংঘ ও আলবদর একই।
মেজর রিয়াদ হুসাইন, যিনি আলবদর গঠনের প্রক্রিয়া শুরু করেন, তিনি এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, আলবদর নামেই ইসলামী ছাত্র সংঘের তরুণদের সংগঠিত করা হয়। আবু সাঈদ আলবদরদের সম্পর্কে লিখেছেন, আগস্ট (১৯৭১) মাস থেকেই সারাদেশে ইসলামী, সংঘকে আলবদরে রূপান্তর করা হয়। রেজা নসরও তার পূর্বোক্ত বইয়ে লিখেছেন, সেনাবাহিনীর সাহায্যে ইসলামী জমিয়ত ই তুলাবা আলবদর ও আলশামস নামে দুটি প্যারা মিলিটারি ইউনিট গঠন করে। আলবদরের প্রায় সব সদস্য ছিল তুলাবার অর্থাৎ ইসলামী ছাত্রসংঘ আর আলবদরের মধ্যে কোন তফাৎ নেই। সে কারণেই ইসলামী ছাত্রসংঘের নেতারাই ছিলেন আলবদরের, আলশামসের নেতা।
এছাড়াও তৃণমূল পর্যায়ে বা অপারেশনাল পর্যায়েও কমান্ডার ছিল। এ কারণে তুলাবার নাজিম ই আলা মতিউর রহমান নিজামী ছিলেন আলবদরের প্রধান। পূর্ব পাকিস্তান ইসলামী ছাত্রসংঘের প্রধান হওয়ার কারণে আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ রূপান্তরিত হন পূর্ব পাকিস্তান আলবদর বাহিনীর প্রধানে। বিভিন্ন জেলার ছাত্রসংঘের নাজেম বা প্রধান রূপান্তরিত হন ওই এলাকার বদর বাহিনীর প্রধান হিসেবে। যব উ নাজিম-ই আলা থি (১৯৮১) গ্রন্থের সম্পাদককে দেওয়া এক সাক্ষাতকারে মতিউর রহমান নিজামী জানিয়েছিলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি আলবদর ও আলশামসের কর্মীদের যোগাড় করতেন। তিনি বোঝাতে চেয়েছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামী ছাত্রসংঘের সদস্যরাই এই দুই ইউনিটের সদস্য ছিল। এ কারণেই নিজামী লিখেছিলেন, “বিগত দু’বছর থেকে পাকিস্তানের একটি তরুণ কাফেলার ইসলামী পুনর্জাগরণ আন্দোলনের প্রতিষ্ঠান পাকিস্তান ইসলামী ছাত্রসংঘ এই ঐতিহাসিক বদর দিবস পালনের সূচনা করেছে। সারা পাকিস্তানে বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনার সাথে এই দিবস উদযাপিত হওয়ার পেছনে এই তরুণ কাফেলার অবদান সবচেয়ে বেশি।” [দৈনিক সংগ্রাম, ১৪.১১.১৯৭১]।
আলবদররা যে ভাল কাজ করছে সে সম্পর্কে সার্টিফিকেট দিয়েছিল জামায়াতের মুখপত্র দৈনিক সংগ্রামÑ “দেশের প্রতিরক্ষা ও দুশমনদের সমুচিত শাস্তি দেবার জন্য আমাদের সশস্ত্র বাহিনী সব সময় প্রস্তুত রয়েছেন। শান্তি কমিটির কর্মতৎপরতা এবং দুশমনদের ওপর রেজাকার ও বদর বাহিনীর মারণাঘাত সে সচেতনতা বোধেরই বাস্তব স্বাক্ষর বহন করছে। আমাদের সশস্ত্র বাহিনীর পাশাপাশি বেসামরিক প্রতিরোধ আরও শক্তিশালী হয়ে উঠুক এ কামনাই করি।” (৬.৯.১৯৭১)
৭ নবেম্বর আলবদর দিবস পালন করা হয়। এ সম্পর্কে সংগ্রাম লেখেÑ “আলবদর দিবস উপলক্ষে গতকাল বোরবার ঢাকা শহরে ইসলামী ছাত্রসংঘের উদ্যোগে এক বিরাট গণমিছিল বের করা হয়। পবিত্র রমজানের মধ্যে গতকালই প্রথম আলবদরের অনুপ্রেরণায় উজ্জীবিত মিছিলকারীদের পদভারে রাজধানীর রাজপথ প্রকম্পিত হয়ে ওঠে।” [সংগ্রাম ৮.১১.৭১]। সেখানে বক্তৃতা করেন সংঘের ঢাকা শহরের সভাপতি শামসুল হক, পূর্ব পাকিস্তান ইসলামী ছাত্রসংঘের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ ও মীর কাশেম আলী।
এখানে উল্লেখ্য, এর চার বছর পর, বঙ্গবন্ধু ও চার জাতীয় নেতাকে হত্যার পর জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে ৭ নবেম্বর সংঘটিত হয় ‘সিপাহী বিপ্লব’। বলা যেতে পারে তা ছিল নতুনভাবে আলবদর দিবস পালন। আলবদর দিবস, কিন্তু আলবদর নামে কেউ বক্তৃতা দেয়নি। কেন? কারণ, ছাত্রসংঘই তো তখন আলবদর; এর নেতারাই আলবদরের নেতা।
আর একটি উদাহরণ দিয়েই এ পর্ব শেষ করব। রাজাকার-আলবদরদের হিংস্রতায় খুব সম্ভব আশঙ্কিত হয়ে হানাদার বাহিনীর সহযোগী জুলফিকার আলী ভুট্টো, কাওসার নিয়াজী ও মুফতি মাহমুদ বোধহয় কিছু মন্তব্য করেছিলেন [জমিয়াতে তুলাবার শক্ত ঘাঁটি ছিল লাহোরে। হয়তো তারা আশঙ্কা করছিলেন, পাকিস্তানেও তুলাবা একই কা- শুরু করতে পারে]। এ কারণে আলী আহসান মুজাহিদ ক্ষিপ্ত হয়ে এক বিবৃতিতে ১৫ অক্টোবর বলেছিলেন, যা সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয় : “পূর্ব পাকিস্তানে দেশপ্রেমিক যুবকেরা ভারতীয় চরদের হাত থেকে দেশকে রক্ষা করার জন্য এগিয়ে এসেছে এবং রাজাকার, আলবদর ও অন্যান্য স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর সদস্য হিসেবে জাতির সেবা করছে। অথচ সাম্প্রতিককালে দেখা যাচ্ছে, কতিপয় রাজনৈতিক নেতাÑ জনাব জেড এ ভুট্টো, কাউসার নিয়াজী, মুফতি মাহমুদ ও আসগর খান রাজাকার, আলবদর ও অন্যান্য দেশহিতৈষী স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর বিরুদ্ধে আপত্তিকর মন্তব্য করে বিষোদ্গার করছেন। এসব নেতার এ ধরনের কার্যকলাপ বন্ধ করার জন্য এবং এ ব্যাপারে কঠোর মনোভাব গ্রহণ করার জন্য তিনি সরকারের প্রতি আবেদন জানান।” সেনাবাহিনীকে সহায়তা করার জন্য তিনি আলবদর বাহিনীর সদস্যদের নির্দেশ দেন। (সংগ্রাম, ১৫.১০.৭১)
১৯৭১ সালের পূর্ব পাকিস্তানের স্পেশাল ব্রাঞ্চের রিপোর্ট অনুযায়ী, রংপুরে সংঘের এক সভায় মুজাহিদ নির্দেশ দেন বিভিন্ন পর্যায়ে আলবদর বাহিনী গঠন করার জন্য।
এ পরিপ্রেক্ষিতে উপসংহারে পৌঁছা যায়Ñ ইসলামী ছাত্রসংঘই আলবদর বাহিনী, আলবদর বাহিনীই ইসলামী ছাত্রসংঘ। ছাত্রসংঘের নেতারাই আলবদরের নেতা, আলবদরের নেতারাই সংঘের নেতা।
১৫ মে ঢাকায় প্রাদেশিক শূরার এক অধিবেশন হয়। সেখানে জামায়াত কর্মীদের নিয়ে আলাদা একটি রাজাকার ফোর্স গঠনের প্রস্তাব রাখা হয় ইস্টার্ন কমান্ডের কাছে। সেনাবাহিনীর অনেকের কাছে মনে হয়েছিল, রাজাকাররা যথাযথভাবে কাজ করতে পারছে না বা করছে না বা তাদের মধ্যে অনুপ্রবেশ ঘটছে। সংঘের হাইকমান্ডও তাই মনে করত। ৩১ বেলচু রেজিমেন্টের মেজর রিয়াদ হুসাইন এ নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করছিলেন। খালেদকে এক সাক্ষাতকারে তিনি জানিয়েছেন, “আমি দেখলাম যে, আমার সেক্টরে ইসলামী ছাত্র-সংঘের বাঙালিরা বড় নিষ্ঠার সঙ্গে প্রতিরক্ষা, পথ দেখানো ও তথ্য গোপন রাখার জিম্মাদারিগুলো আদায় করছে। এ কারণে আমি হাইকমান্ড থেকে আনুষ্ঠানিক কোনো অনুমতি না নিয়ে কিছুটা ঝুঁকি নিয়ে এসব ছাত্রদের আলাদা করলাম। তারা সংখ্যায় ছিল ৪৭ জন। সবাই ইসলামী ছাত্রসংঘের কর্মী। ১৬ মে ১৯৭১ সালে শেরপুরে তাদের সংক্ষিপ্ত সামরিক ট্রেনিং দেওয়া শুরু হলো।”
এরা এত নিষ্ঠার সঙ্গে ট্রেনিং নিচ্ছিল যে, মেজর রিয়াদ মুগ্ধ হয়ে ২১ মে এক বক্তৃতায় বলেন, “আপনাদের মতো সুন্দর চরিত্রের মুজাহিদ সুলভ প্রকৃতির অধিকারী ইসলামের সন্তানদের আলবদর নামে আখ্যায়িত করা উচিত।” মেজর রিয়াদ আরও জানিয়েছেন, “তখন হঠাৎ আমার মনে বিদ্যুতের মতো এ চিন্তা ঝলক দিয়ে উঠল যে, এই সংগঠনটিকে আলবদর নামে আখ্যায়িত করা হোক। এই নাম এবং কর্মীদের আলাদা সংগঠনে অন্তর্ভুক্ত করার অভিজ্ঞতা এতখানি সাফল্যম-িত হলো যে, দুই-তিন মাসের মধ্যেই গোটা পূর্ব পাকিস্তানে এই নামেই সংঘের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট তরুণদের সংগঠিত করা সম্ভব হয়ে ছিল।” মেজর রিয়াদ উল্লেখ করেছেন, আলবদরের প্রথম কমান্ডার ছিল কলেজের বিজ্ঞান বিভাগের কামরান। আবু সাইয়িদ তার গ্রন্থে জানিয়েছেন, আলবদর বাহিনীর সূত্রপাত জামালপুরে। জামালপুরে ইসলামী ছাত্র সংঘের সভাপতি মোহাম্মদ আশরাফ হোসেনের নেতৃত্বে গঠিত হয় এই বাহিনী। “জামালপুর মহকুমায় আলবদর বাহিনী কর্তৃক ৬ জন মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যার মাধ্যমে তাদের ‘কৃতিত্ব’ প্রকাশিত হয়ে পড়লে জামায়াতে ইসলামীর নেতৃত্ব অনুধাবন করতে সক্ষম হয় যে, রাজাকারদের চেয়ে উন্নততর মেধাসম্পন্ন রাজনৈতিক সশস্ত্র ক্যাডার গড়ে তোলার সুযোগ বর্তমান। .... আগস্ট মাস হতেই সারাদেশে ইসলামী ছাত্রসংঘকে আলবদরে রূপান্তরিত করা হয় ...।”
আসলে মে মাসেই গঠিত হয় আলবদর বাহিনী। তারপর প্রতি জেলার ছাত্রসংঘপ্রধান বদর বাহিনীর প্রধানে রূপান্তরিত হয় ও তাদের অপারেশন শুরু করে। আশরাফ জামালপুরের সংঘের প্রধান হওয়ার কারণে জামালপুর বদর বাহিনীর প্রধানে রূপান্তরিত হন এবং অপারেশন শুরু করেন অর্থাৎ মুক্তিযোদ্ধা হত্যা শুরু করেন। এমনও হতে পারে, আশরাফও মেজর রিয়াদের নেতৃত্বে শেরপুরে প্রশিক্ষণ নিয়ে জামালপুরে ফেরত এসেছিলেন। আবু সাইয়িদ নির্দিষ্টি তারিখের উল্লেখ করেননি। লিখেছেন, ২২ এপ্রিলের পর। সেটি মে মাস হওয়াই স্বাভাবিক। যে ৪৮ জনের প্রশিক্ষণ হয়েছিল তাদের কমান্ডার ছিল কামরান।

৫. আলবদরের কর্মসূচি ও প্রশিক্ষণ
খুন করা ছিল আলবদরের প্রধান কাজ, কিন্তু কাগজেকলমে কিছু আদর্শের কথা বলা হয়েছিল, সেগুলোকে বলা হতো আলবদরের কর্মসূচি। তাদের ছিল পাঁচদফা কর্মসূচি
১. ব্যাপক জনসংযোগ। শহর থেকে গ্রামগঞ্জ পর্যন্ত সভা সমাবেশ করে মানুষকে পাকিস্তানের অখ-তা রক্ষার কথা বোঝাতে হবে।
২. বাঙালি ও অবাঙালিদের মাঝে যে ব্যবধান সৃষ্টি হয়েছে তা দূর করা। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মাঝে যে দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে তা দূর করার জন্য ‘ভালোবাসার আবেগ’ সঞ্চার করা।
৩. ভারতীয় অনুচর, অনুপ্রবেশকারী ও দুষ্কৃতকারীদের প্রতি সতর্ক দৃষ্টি রাখার জন্য তথ্য সংগ্রহের ব্যবস্থা করা।
৪. পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা জোরদারের জন্য সেনাবাহিনী ও প্রশাসনকে সহায়তা এবং গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা রক্ষার জন্য ছাত্রদের (ছাত্রসংঘের) সংগঠিত করে সামরিক প্রশিক্ষণ দেয়া।
৫. সরকারি ও আধাসরকারি কর্মচারীদের মাঝে কারা শক্রর অনুচর তা চিহ্নিত করার জন্য প্রশাসন ও সামরিক বাহিনীকে নির্ভরযোগ্য তথ্য সরবরাহ করা।
আলবদরদের প্রশিক্ষণ দু’ভাগে বিভক্ত ছিলÑ সামরিক ও মনস্তাত্ত্বিক।
পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী আলবদরদের এক সপ্তাহ থেকে দুই সপ্তাহের প্রশিক্ষণ দিত। এর মধ্যে অস্ত্র প্রশিক্ষণ, ওয়ারলেস ব্যবহার, অস্ত্রাদি এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নিয়ে যাওয়া ইত্যাদির ব্যাপারে প্রশিক্ষণ দেয়া হতো। খালেদ উল্লেখ করেছেন, আলবদরদের ভালোভাবে অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত করা হয়নি। কিন্তু এটি ঠিক নয়। পাকিস্তানি বাহিনী তাদের প্রয়োজনমতো যানবাহন ও অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহ করত। বুদ্ধিজীবী হত্যার সময় আলবদরদের প্রয়োজনীয় যানবাহন ও অস্ত্র সরবরাহ করা হয়।
মনস্তাত্ত্বিক প্রশিক্ষণের মধ্যে ছিল “দৈনিক দরসে কোরান, দরসে হাদিসে রসুল, ইবাদত, জিকির” প্রভৃতি। একদিন শুধু জিহাদ, পরকাল ইত্যাদি সম্পর্কে জ্ঞান দেয়া হতো। খালেদ লিখেছেন, “আলবদর মুজাহিদদের রাত যদি তরবারির জিহাদে অতিক্রান্ত হতো তবে দিনের বেশিরভাগ অংশ আদর্শিক প্রশিক্ষণ গ্রহণে অতিবাহিত হতো। অর্থাৎ সারাদিন যুদ্ধের ময়দানে ক্লান্ত অবসন্ন এই মুজাহিদরা রাতের বেলা তাহাজ্জুদ ও আল্লাহ্র দরবারে কান্নাকাটিতে কাটিয়ে দিত। এ ছিল এমন কর্ম যা পাক বাহিনীর কয়েকজন অফিসার ও জওয়ানদের ইসলামের কার্যগত দাবিগুলোর প্রতি মনোযোগী করেছিল এবং এখনও আলবদরের নামে তাদের মাথা ভক্তি ও কৃতজ্ঞতায় নুয়ে যায়। খালেদ লিখেছেন, অবশ্য তারা চাকরি ও রাজনীতির বাস্তবতার কারণে আলবদর সম্পর্কে কোন আলোচনা করতে চান না। আলবদরদের নিয়মিত বেতন দিত ইস্টার্ন কমান্ড। এ তথ্য পাকিস্তানি কোন জেনারেল স্বাভাবিকভাবে স্বীকার করেনি। তাদের বেতন ধার্য করা হয়েছিল মাসিক ৯০ টাকা। কিন্তু ছাত্রসংঘের নেতৃত্বের প্রস্তাব ছিল এই টাকা প্রতিরক্ষা ফান্ডে দেওয়া হোক। কিন্তু ইস্টার্ন কমান্ড জানিয়ে দেয় এই বেতন নিতে হবে। তখন সংঘের নেতারা নির্দেশ দেন, কোন আলবদর যেন ব্যক্তিগতভাবে এ বেতন গ্রহণ না করে। বরং আলবদরদের নামে একটি ব্যাংক এ্যাকাউন্ট খোলা হবে এবং সেখানে এই টাকা জমা দেওয়া হবে। তবে যখন তারা অপারেশনে যেত তখন যাতায়াত ও খাদ্যের সুবিধা (ভাতা) নিত।
অন্য আরেকটি সূত্র অনুসারে আলবদরদের বেতন ছিল মাসে ১৫০ টাকা। রাজাকার, মুজাহিদ থেকেও তাদের নেওয়া হতো। এবং অবাঙালিও ছিল। এদের নির্দিষ্ট পোশাকও ছিল “....source reports that pak. Army has organised and formed Razakar Bahini in East Pakistan. Badar Bahini : This Bahini is mixed with Punjabi, Bihari and Bengalee. Almost all the persons one educated and well trained. The Bahini, most of the persons, selected from Razakars and Muzhaids. Their dress is Millishian. Their monthly salary is Rs.150/-. This Bahini has been deployed with local Razakars in different district.
[Bangladesh Documents, Vol-II] রাজাকার বা মুজাহিদ থেকে আলবদরদের নেয়া হতো, এতে একটু ভুল আছে। অবশ্য, রাজাকারদের বড় একটি অংশ ছিল জামায়াত কর্মী।
আমাদের এতদিন একটি ধারণা ছিল, আলবদর নামে আলাদাভাবে একটি ফ্রন্ট গঠন করা হয়েছিল, যাদের হানাদার বাহিনী সহায়তা করত এবং তারাও হানাদারদের সাহায্য করত। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, ইসলামী ছাত্র সংঘই আলবদরে রূপান্তরিত হয়ে গিয়েছিল। এর বাইরেও কেউ চাইলে আলবদর হতে পারত। পাকিস্তান সরকার এদের প্রশিক্ষণ ও অস্ত্রশস্ত্র দিত। নিয়মিত বেতনও দিত। অর্থাৎ সহযোগী বললে কম হবে। এরাও পাকিস্তানি বাহিনীর মতো হানাদার বাহিনীতে পরিণত হয়েছিল, যাদের পাকিস্তান সরকার নিয়মিত বাহিনীর মতো বেতন দিত। সুতরাং বাংলাদেশে গণহত্যা, ধর্ষণ, লুট, অগ্নিসংযোগ, অপহরণের জন্য পাকিস্তানি বাহিনীর মতো তারাও সরাসরি দায়ী।
প্রশিক্ষণ শেষ হওয়ার পর আলবদরদের শপথ নিতে হতো। খালেদ সেই শপথ উদ্ধৃত করেছেন
‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
আশহাদু আল লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু
ওয়া আশহাদু আন্না মুহাম্মাদান আবদুহু ওয়া রাসূলুহু
আমি মহান ও মহামহিম আল্লাহকে হাজির নাজির জেনে ঘোষণা করছি যে, পাকিস্তানের অখ-তার ওপর আঁচড় লাগতে দেব না, শান্তিপূর্ণ নাগরিকদের জানমালের হেফাজত করব। রাজনৈতিক বিরোধ ও রেষারেষিতে কারো ক্ষতি করতে দেব না।
কোন লোকের বিরুদ্ধে বা শুধুমাত্র আওয়ামী লীগের সমর্থক বা হিন্দু হওয়ার অজুহাতে শাসনমূলক কোন পদক্ষেপ হাতে নেব না। যতক্ষণ না পূর্ণ তদন্তের পর গাদ্দারদের সহায়তা বা তাদের দ্বারা সরাসরি দেশের স্বার্থের ক্ষতি সাধনের বিষয়টি প্রমাণিত হয়। ঐক্যবদ্ধ পাকিস্তানের জন্য গণতান্ত্রিক পরিবেশ সৃষ্টি এবং সাধারণ জীবনধারা বহাল করার জন্য সাধারণের ইতিবাচক পদক্ষেপ নেব।
যোগাযোগ ব্যবস্থা তছনছ করার জন্য যারা পুল উড়িয়ে দেবে, লুটতরাজ করবে, হত্যা করবে তাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালাব। আল্লাহ আমার সহায় ও সাহায্যকারী হোন, আমীন।’
বলাবাহুল্য এসব শপথের ধার ধারেনি আলবদররা। নিজামী-মুজাহিদের নেতৃত্বে বিপুলসংখ্যক নিরীহ শিক্ষক হত্যা এর উদাহরণ। (চলবে)

No comments

Powered by Blogger.