পদ্মা সেতু প্রকল্প-বিশ্বব্যাংককে ফেরাতে সব শর্তই মানছে সরকার by আবুল কাশেম

পদ্মা সেতু প্রকল্পে অর্থায়নে বিশ্বব্যাংককে ফিরিয়ে আনতে সব চেষ্টাই করছে সরকার। এতে সংস্থাটিও অর্থায়নের পথেই এগোচ্ছে। তবে সে জন্য আরো কিছু দাবি মেনে নিতে হবে সরকারকে। এর মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক বিষয়-সংক্রান্ত উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমানকেও বিদায় দিতে হবে।


বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে অর্থায়নের নিশ্চয়তা পাওয়া মাত্রই তাঁকে সরিয়ে দেওয়া হতে পারে। এ ছাড়া সেতু নির্মাণে সম্পদ সংগ্রহ, দরপত্র আহ্বান ও মূল্যায়ন করার পর কার্যাদেশ দেওয়াসহ সব ক্ষেত্রেই মূল ভূমিকায় থাকবে বিশ্বব্যাংকসহ অন্য দাতা সংস্থাগুলো।
সরকার দাতা সংস্থাগুলোর সঙ্গে থাকবে মাত্র। এ ক্ষেত্রেও ছাড় দিতে প্রস্তুত সরকার। আর তাতে ফিরে এসে পদ্মা সেতুতে অর্থায়নও করবে বিশ্বব্যাংক। বিশ্বব্যাংকের বাতিল করা ঋণচুক্তি পুনর্বহালের বাধা-বিপত্তি কেটে যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত।
বিশ্বব্যাংকের দাবিমতো দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) তদন্ত কার্যক্রমেও সংস্থাটির প্রতিনিধি অন্তর্ভুক্ত করা হবে। সে জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিয়েও রেখেছে দুদক। দুদক টার্মস অব রেফারেন্সের খসড়া তৈরি করে রেখেছে। বিশ্বব্যাংকের তরফ থেকে ঋণচুক্তি পুনর্বহালের ঘোষণা আসার পরই টার্মস অব রেফারেন্স স্বাক্ষর ও তদন্ত কার্যক্রমে বিশ্বব্যাংকের প্রতিনিধিকে অন্তর্ভুক্ত করবে দুদক।
বার্তা সংস্থা বিডিনিউজকে অর্থমন্ত্রী বলেছেন, 'সমঝোতার সব বাধা-বিপত্তি কেটে যাচ্ছে। আশা করছি, এক সপ্তাহের মধ্যে সমাধান হবে। বিশ্বব্যাংক ফিরে এলে আগামী নভেম্বর মাসে সেতু নির্মাণের দরপত্র আহ্বান করা হবে। আর আগামী বছরের এপ্রিলের দিকে সেতু নির্মাণের কাজ শুরু হবে।'
পদ্মা সেতু প্রকল্পের ইন্টেগ্রিটি অ্যাডভাইজার ও প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমানকে সরিয়ে দেওয়া হবে বলে যে কথা উঠেছে সে সম্পর্কে গতকাল শনিবার সাংবাদিকরা তাঁকে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, 'আমি এ ব্যাপারে কিছুই জানি না। বিশ্বব্যাংককেই আপনারা জিজ্ঞেস করেন।'
একটি সূত্র বলছে, মসিউর রহমান ছাড়াও প্রধানমন্ত্রীর আরো একজন উপদেষ্টাকে সরানোর শর্ত জুড়ে দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। তাঁকেও সরিয়ে দিতে হবে। তারপর পদ্মা সেতুতে অর্থায়নের জন্য বাতিল করা ঋণচুক্তি পুনর্বহালের জন্য বিশ্বব্যাংকের কাছে 'নরম ভাষায়' একটি চিঠি পাঠাবে বাংলাদেশ। ওই চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে সংস্থাটি ঋণচুক্তি পুনর্বহাল করবে- এমন আশা করছে সরকার। আর এত কিছু করতে হবে আগামী ৩১ আগস্টের মধ্যেই। বিশ্বব্যাংকের সম্মতি পেলেই অন্য সহায়তাকারী সংস্থা এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ও জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা (জাইকা) তাদের ঋণচুক্তি কার্যকরের মেয়াদ বাড়াবে।
সরকারের একজন নীতিনির্ধারক কালের কণ্ঠকে জানান, ঋণচুক্তি বাতিলের পর বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে সরকার নানাভাবে আলোচনা অব্যাহত রেখেছে। জাইকা ও এডিবির শীর্ষ কর্মকর্তারাও বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে আলোচনা অব্যাহত রেখেছেন। ঢাকায় নিযুক্ত বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতরা পদ্মা সেতুতে অর্থায়নের ব্যাপারে ইতিবাচক মনোভাব নিতে সংস্থাটির বাংলাদেশপ্রধান অ্যালেন গোল্ডস্টেইনকেও চাপে রেখেছেন। সম্প্রতি ঢাকায় নিযুক্ত জার্মান রাষ্ট্রদূতও এভাবে ঋণচুক্তি বাতিল করায় গোল্ডস্টেইনের কাছে ক্ষোভ প্রকাশ করে তা পুনর্বহালের অনুরোধ করেছেন। বিশ্বব্যাংকের দাবি মেনে নিতে সরকারের নেওয়া বিভিন্ন পদক্ষেপ, অন্য দাতা সংস্থাগুলোর তদবির ও নানামুখী চাপের কারণে শেষ পর্যন্ত পদ্মা সেতুতে ফিরে আসার পক্ষেই বিশ্বব্যাংক।
তবে কথিত দুর্নীতির সঙ্গে সম্পৃক্তদের সরানোর পাশাপাশি আরো কিছু শর্তও জুড়ে দিয়েছে সংস্থাটি। অনেকটা আত্মসমর্পণ করেই সরকার তা মেনে নিচ্ছে। দাবি পূরণ করলে বিশ্বব্যাংক অর্থায়নে ফিরে আসার ইঙ্গিত দেওয়ার পরই মন্ত্রী আবুল হোসেনকে পদত্যাগ করিয়েছে সরকার। দুর্নীতি দমন কমিশনও তাদের তদন্ত প্যানেলে বিশ্বব্যাংকের প্রতিনিধি রাখতে মৌখিক সম্মতি জানিয়েছে। আর আনুষ্ঠানিকভাবে সংস্থাটির প্রতিনিধিকে প্যানেলে অন্তর্ভুক্ত করতে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতিও নিয়ে রেখেছে দুদক। বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে আলোচনায় অগ্রগতি হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতেই পদত্যাগ করার এক মাস পর গত ২২ আগস্ট সৈয়দ আবুল হোসেনের পদত্যাগপত্র গ্রহণ করেছেন রাষ্ট্রপতি।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, বিশ্বব্যাংকের দাবি মানার পর বাতিল করা ঋণচুক্তি পুনর্বহালের আবেদন কিভাবে করতে হবে সে বিষয়েও জানিয়েছে সংস্থাটি। সরকারকে অত্যন্ত নরম ভাষায় ঋণচুক্তি পুনর্বহালের আবেদন করতে হবে। বিশ্বব্যাংকের নির্দেশনা মেনে পত্র লেখার প্রস্তুতিও নিচ্ছে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি)।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা জানান, ঋণচুক্তি বাতিল করলেও বিশ্বব্যাংকের ১২০ কোটি ডলার এখনো বাংলাদেশের নামেই রয়েছে। তাই চুক্তি পুনর্বহালের জন্য বিশ্বব্যাংকের খুব একটা বেগ পেতে হবে না। তবে এডিবি ও জাইকা ঋণচুক্তি বাতিল করলে ওই অর্থ আর বাংলাদেশের জন্য বরাদ্দ থাকবে না। আর বিশ্বব্যাংক ঋণচুক্তি পুনর্বহাল না করলে আগামী ৩১ আগস্টের পর সংস্থা দুটিও ঋণচুক্তি কার্যকরের মেয়াদ বাড়াবে না। পরে বিশ্বব্যাংক ফিরে এলেও এ দুটি সংস্থার পক্ষে নতুন করে অর্থায়নের চুক্তি করা কঠিন হয়ে পড়বে। তাই সরকার ৩১ আগস্টের মধ্যেই বিশ্বব্যাংককে ফিরিয়ে আনতে তৎপর রয়েছে।
সরকারের অন্য একজন নীতিনির্ধারক নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে বলেন, বিশ্বব্যাংকের প্রথম শর্ত মেনে সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন, সেতু বিভাগের সাবেক সচিব মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া ও সাবেক প্রকল্প পরিচালক রফিকুল ইসলামকে আগেই সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। সৈয়দ আবুল হোসেনকে তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। তাতেও বিশ্বব্যাংকের আপত্তি থাকায় গত ২৩ জুলাই তিনি মন্ত্রিসভা থেকেই পদত্যাগ করেন, যা গৃহীত হয়েছে বলে গত সপ্তাহে রাষ্ট্রপতির দপ্তর থেকে জানানো হয়েছে।
পদ্মা সেতুতে বিশ্বব্যাংকের ১২০ কোটি ডলার ছাড়াও এডিবির ৬০ কোটি ডলার, জাইকার ৪১ কোটি ডলার ও ইসলামিক উন্নয়ন ব্যাংকের (আইডিবি) ১৪ কোটি ডলার ঋণ দেওয়ার কথা ছিল। তবে দুর্নীতির অভিযোগ তুলে সরকারের মন্ত্রীসহ বেশ কয়েকজন কর্মকর্তাকে সরিয়ে দেওয়ার শর্ত দেয় বিশ্বব্যাংক। তাতে রাজি না হয়ে কালক্ষেপণ করতে থাকে সরকার। গত ২৯ জুন ঋণচুক্তি বাতিল করে বিশ্বব্যাংক। তবে অন্য তিনটি সংস্থার ঋণচুক্তি এখনো বহাল রয়েছে। সরকার বিশ্বব্যাংককে ফিরিয়ে আনার পাশাপাশি পদ্মা সেতুর জন্য অভ্যন্তরীণ ও বিকল্প বৈদেশিক উৎস থেকে অর্থ সংগ্রহের চেষ্টাও অব্যাহত রেখেছে।

No comments

Powered by Blogger.