অবৈধ অস্ত্রের ঝনঝনানিঃ শান্তি কি সোনার হরিণ হয়েই থাকবে?

সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তারা যতই বাগাড়ম্বর করুন, তাতে যে কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না সে কথা বলাই বাহুল্য। সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন সামনে রেখে সমাজবিরোধী সন্ত্রাসীচক্র যেমন হচ্ছে সংগঠিত, তেমনি এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে পা মিলিয়ে দেশের বিভিন্ন সীমান্ত টপকে বহরে বহরে আসছে অবৈধ অস্ত্রের চালান। সঙ্গত কারণেই এখন পুলিশ বলতে বাধ্য হচ্ছে, আগ্নেয়াস্ত্রের সহজলভ্যতা ও ব্যবহার বাড়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে অন্য উপসর্গগুলো পর্যায়ক্রমে গুটিবসন্তের আকারে প্রকটভাবে ফুটে উঠবে।

এ আশঙ্কা এরই মধ্যে আইনশৃংখলা পরিস্থিতির অবনতির ফলে অস্থির ও অসহায় জনমনে নতুন করে আরেক প্রস্থ আতঙ্ক ছড়িয়েছে।পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর মতে, বাংলাদেশ ভারত সীমান্তের ১০টি পয়েন্ট দিয়ে হরদম অস্ত্রের চালান আসছে। সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর মতে, পিলখানায় বিডিআর ম্যাসাকারের পর যখন সীমান্তের প্রহরীদের অস্ত্রহীন অবস্থায় ঢিলেঢালা টহলে নামানো হয়, সেই সুযোগে আমাদের প্রতিবেশী দেশ থেকে অরক্ষিত সীমান্ত দিয়ে ঢুকতে থাকে একের পর এক অবৈধ অস্ত্রের চালান। ভারতে তৈরি সহজলভ্য ছোট ও মাঝারি আগ্নেয়াস্ত্রের পাশাপাশি স্থানীয়ভাবে একশ্রেণীর লোক লেদ মেশিনে পিস্তল ও রিভলবার তৈরি করে অপরাধ জগতের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে থাকে। একই সঙ্গে সীমান্ত পথে মাদকদ্রব্য বহনকারীদের সংঘবদ্ধ চক্রও নিয়ে আসছে ছোট ছোট অস্ত্র ও বিস্ফোরকদ্রব্য। এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে শুধু যে সন্ত্রাসী ও মাদক ব্যবসায়ীরাই জড়িত তা নয়, অনেক ক্ষেত্রে বর্তমান শাসক দলের নেতাকর্মীদেরও সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলকে এখনও অস্ত্রের খনি হিসেবেই দেখা হচ্ছে। সেখানে চরমপন্থী ক্যাডারদের হতে শুধু ছোটখাটো নয়, একে-৪৭ এর মতো ভারি অস্ত্রের সন্ধানও পাওয়া গেছে। পুলিশ জানাচ্ছে, কিছু কিছু অভিযানের ফলে সামান্য কিছু আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করা গেলেও অবাধ চোরাচালানের ফলে সেই শূন্যস্থান পূর্ণ হয়ে অস্ত্র উপচে পড়ছে আশপাশে। এই কারণে অবৈধ অস্ত্রের সংখ্যা কমার কোনো আলামত পাওয়া যাচ্ছে না। অপরাধীরা নিজস্ব অস্ত্রের বাইরে ভাড়া করা অস্ত্রও হামেশাই ব্যবহার করছে। সন্ত্রাসী, টপটেরররা আমাদের আইনশৃংখলা বাহিনীর কাছে নেই এমন অত্যাধুনিক এক্সট্রা গুয়ের্নিকা পর্যন্ত সংগ্রহ করে ফেলেছে। অন্যদিকে দেশের ১ লাখ ৯৬ হাজার বৈধ অস্ত্রের মধ্যে হিসাব পাওয়া যাচ্ছে মাত্র ১ লাখ ৩০ হাজার ছোট-বড় অস্ত্রের। বাকি ৬৬ হাজার অস্ত্রের নাম ‘কেতাবে আছে, গোয়ালে নেই।’ এসব অস্ত্রের মালিকরা ভুয়া ঠিকানা, টিন নাম্বার ও লাইসেন্স ব্যবহার করে এসব সংগ্রহ করেছিল। এখন গণনার সময় তাদের লেজের অগ্রভাগও কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। পরিস্থিতির ভয়াবহতা এতোটাই, ধারণা করা হচ্ছে সন্ত্রাসীদের হাতে এখন অস্ত্রের পরিমাণ ৪ লাখের মতো। এ বিশাল অস্ত্রভাণ্ডারের ৬০ ভাগ সিন্ডিকেটের গডফাদার ও রাজনৈতিক দলগুলোর সন্ত্রাসীদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। ২৫ ভাগ চোরাচালানি ও সীমান্ত সন্ত্রাসীদের হাতে। ১৫ ভাগ আছে চরমপন্থী, উপকূলীয় জলদস্যু ও সন্ত্রাসীদের হাতে। ফলে ছোটখাটো ঘটনাও খুন-খারাবির মধ্যে গড়াচ্ছে। ভাসমান অপরাধী, ছিচকে সন্ত্রাসী এবং কোমলমতি কিশোরদের হাতেও ঝলসে উঠছে মারাত্মক সব অস্ত্র। গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মতো, এখন সন্ত্রাসীদের তত্পরতাকে আরও খানিকটা উস্কে দেয়ার জন্যই যেন আসছে সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন। এ নির্বাচনকে সামনে নিয়ে সংঘবদ্ধ হতে শুরু করেছে সন্ত্রাসীরা। সন্ত্রাসীদের সংঘবদ্ধ হওয়ার অর্থ হলো, অস্ত্রের ব্যবহার বেড়ে যাওয়া। আর অস্ত্রের ব্যবহার বাড়া মানেই হত্যাকাণ্ড, গুম, রাহাজানি, ডাকাতি, অপহরণ অর্থাত্ সমাজ জীবনের শান্তি ও স্থিতিশীলতার বারোটা বাজানো।
এই আপদ নিয়ন্ত্রণে সরকারের পদস্থ কর্তাদের কোনো মাথাব্যথা আছে বলে মনে হয় না। তারা ব্যস্ত তাদের রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার কর্মে।
মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীদের কাণ্ডকারখানা দেখে মনে হয়, হয় তারা এ ব্যাপারে উদাসীন অথবা এই সঙ্কটের ভয়াবহতা সম্পর্কে তাদের আদৌ কোনো ধারণা নেই। নইলে সোফার নিচে টাইম বোমা রেখে উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপানোর কসরত্ বাদ দিয়ে বাস্তবের বিষবৃক্ষটিকে সমূলে উপড়ে ফেলার উদ্যোগ নেয়া হত। তবে পুলিশের কোনো কোনো কর্তা অবশ্য বলছেন যে অস্ত্র উদ্ধার অভিযান চলছে এবং চলবে। যদিও তাদের কথায় আশ্বস্ত হতে মন সায় দেয় না। যাই হোক, আমরা সবার কাছেই শুভবুদ্ধি প্রত্যাশা করি এবং দেখতে চাই অবৈধ অস্ত্রের ঝনঝনানিমুক্ত একটি স্থিতিশীল ও শান্তিপূর্ণ দেশ।

No comments

Powered by Blogger.