পদ্মা সেতু প্রকল্প- মসিউর পদত্যাগ করেননি চিঠিও যায়নি বিশ্বব্যাংকে

সব শর্ত পূরণ করার পর বিশ্বব্যাংকের কাছে পাঠানোর জন্য চিঠির খসড়া তৈরি করে রেখেছিলেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) কর্মকর্তারা গতকাল রোববার অপেক্ষায় ছিলেন সেই চিঠির। কিন্তু অর্থমন্ত্রীর কাছ থেকে কোনো সংকেত না পাওয়ায় সেই চিঠি আর পাঠানো হয়নি।
ফলে পদ্মা সেতু নির্মাণে দাতাদের সহায়তা পাওয়া এখনো অনিশ্চিত অবস্থায় আছে।
বিশ্বব্যাংকের একটি শর্ত পূরণই বাকি ছিল। আর সেটি হলো প্রধানমন্ত্রীর অর্থ উপদেষ্টা মসিউর রহমানের পদত্যাগ। গতকাল পর্যন্ত তাঁর পদত্যাগের সিদ্ধান্ত হয়নি। পদত্যাগ করার ব্যাপারে তাঁকে কোনো নির্দেশনাও দেওয়া হয়নি। এ নিয়ে গতকাল বিভিন্ন পর্যায়ে একাধিক বৈঠকও হয়। কিন্তু পদত্যাগ করার ব্যাপারে ওপর মহল থেকে সিদ্ধান্ত আসেনি বলে জানা গেছে।
তবে গতকাল প্রথম বারের মতো পদত্যাগের বিষয়টি নিয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেছেন মসিউর রহমান। দেশের স্বার্থে পদত্যাগ করতে রাজি আছেন বলে এ সময় জানান তিনি। বিকেলে রাজধানীর মিন্টো রোডের সরকারি বাসভবনের প্রধান ফটকে দাঁড়িয়ে মসিউর রহমান বলেন, যদি সরকার ও প্রধানমন্ত্রী মনে করেন যে তিনি বিশ্বস্ততার সঙ্গে কাজ করছেন না, তাহলে তিনি পদত্যাগ করবেন। বিশ্বব্যাংকের উদ্দেশে তিনি বলেন, কোনো অভিযোগ থাকলে সাক্ষ্য প্রমাণ দিতে হবে এবং আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দিতে হবে।
দুর্নীতির অভিযোগ তুলে বিশ্বব্যাংক গত ২৯ জুন পদ্মা সেতু প্রকল্পের ঋণচুক্তি বাতিল করে। প্রকল্পের অন্যতম দুই সহযোগী এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ও জাপান আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা (জাইকা) ঋণচুক্তির কার্যকারিতার মেয়াদ বাড়ায় আরও এক মাস। আর পাঁচ দিন পর ৩১ আগস্ট এ সময়ও শেষ। এ সময়ের মধ্যে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে আলোচনা সম্পন্ন করার একধরনের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এ সময়ের মধ্যে বিশ্বব্যাংক ইতিবাচক সিদ্ধান্ত দিলে তবেই পদ্মা সেতুর জন্য অর্থ পাবে বাংলাদেশ।
বিশ্বব্যাংকের শর্ত মেনে এরই মধ্যে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন পদত্যাগ করেছেন। সেতু কর্তৃপক্ষের সচিব মোশাররফ হোসেন ভুঁইয়াকেও ছুটিতে পাঠানো হয়েছে। বিশ্বব্যাংকের শর্তে সেতু প্রকল্পের ইনটিগ্রিটি উপদেষ্টা মসিউর রহমানকে সরানোর কথাও ছিল। ঈদের পর থেকেই গুঞ্জন চলছে মসিউর রহমান সরে দাঁড়াতে পারেন।
সূত্র জানায়, গতকাল সকাল থেকেই এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয়, বেলা দুইটার পর অর্থমন্ত্রী সচিবালয়ে আসবেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে অর্থমন্ত্রী সরাসরি চলে যান মিন্টো রোডের সরকারি বাসভবনে।
অর্থমন্ত্রী সচিবালয়ে ফিরে না আসায় গতকাল বিকেলে সাংবাদিকেরা জড়ো হন তাঁর বাসার সামনে। অর্থমন্ত্রীর একান্ত সচিব আ স ম রাশেদ বেলা সাড়ে তিনটায় সাংবাদিকদের জানান, অর্থমন্ত্রী আজ কোনো কথা বলবেন না।
অর্থমন্ত্রীর পাশের বাসাটিই প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা মসিউর রহমানের। সাড়ে চারটার দিকে মসিউর রহমান বাইরে থেকে বাসায় ঢোকার সময় কথা বলেন সাংবাদিকদের সঙ্গে। পরে বিকেল সোয়া পাঁচটার পর মসিউর রহমান জাতীয় পতাকাসংবলিত গাড়িতে করে তাঁর বাসা থেকে বেরিয়ে যান।
সাংবাদিকেরা অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলার জন্য তাঁর বাসার সামনে অপেক্ষা করতে থাকেন সন্ধ্যা পর্যন্ত। পৌনে ছয়টায় অর্থমন্ত্রীর বাসার ভেতর থেকে ঘুরে এসে অর্থ মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ তথ্য কর্মকর্তা শাহেদুর রহমান বলেন, অন্তত আজ কোনো কথা বলবেন না অর্থমন্ত্রী।
এর আগে উপদেষ্টা পদ থেকে পদত্যাগ করেছেন কি না, জানতে চাইলে সরাসরি কোনো উত্তর দেননি মসিউর রহমান। তিনি বলেন, ‘আমি দুইটি কাহিনি বলতে চাই আপনাদের। আমি যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি, তখন কাফকার (ফরাসি লেখক ফ্রানৎস কাফকা) ট্রায়াল বইটি পড়েছিলাম। ওখানে আছে, একটা লোককে অপরাধের জন্য বিচারকের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়েছে। কিন্তু কী তাঁর অপরাধ তা কেউ বলতে পারছে না।’
মসিউর বলেন, ‘একটি বই আমি মাঝেমধ্যেই পড়ি। জেমস ফ্রেজারের গোল্ডেন ভাউ। এতে বলা আছে, ‘প্রাচীন গ্রিসে যখন কোনো স্থাপনা তৈরি করা হতো, তখন তার নিচে মানুষের রক্ত দেওয়া হতো। ধারণা করা হতো, এতে স্থাপনার ভিত্তি মজবুত হবে। কিন্তু মানুষের রক্ত যখন পাওয়া যাচ্ছিল না, তখন মোরগের রক্ত দেওয়া শুরু হলো। তারও যখন অভাব দেখা দিল, তখন ভবন নির্মাণ শুরু হলো মোরগের ছায়ার ওপর। এরপর ওই ছায়াকে ঘিরে একধরনের বাণিজ্যও তৈরি হলো।’”
মসিউর রহমানের নিজের ক্ষেত্রে ওই দুই গল্পের মতো কিছু একটা হয়েছে বলে মনে করেন তিনি। তিনি বলেন, ‘কোনো লোককে যদি দোষ দেওয়া হয়, তাহলে তাকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেওয়া উচিত।’
মসিউর রহমান আরও বলেন, ‘আমি পদত্যাগ করলে যদি ২ দশমিক ৯ বিলিয়ন ডলারের ঋণের সুরাহা হয়, তাহলে আমি একবার কেন, ১০ বার পদত্যাগ করব।’ ১০ বার হিসেবে বিশ্বব্যাংক থেকে তখন ২৯ বিলিয়ন ডলার পাওয়া যেতে পারে বলে অঙ্ক করে বলেন তিনি। পদত্যাগের বিষয়ে উপদেষ্টা আবারও বলেন, ‘এ বিষয়ে আমার কোনো বক্তব্য নেই। আমার পদত্যাগ কোনো বিষয় নয়। এটি গৌণ। দেখতে হবে আমার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ থাকলে তা প্রমাণসাপেক্ষ কি না।’ পদত্যাগের বিষয়ে মসিউর আরও বলেন, এ ব্যাপারে সরকারের ভাষ্য জানাবেন অর্থমন্ত্রী। কিন্তু অর্থমন্ত্রী গতকাল কোনো কথা আর বলেননি।

No comments

Powered by Blogger.