ধিকিধিকি by মনি হায়দার

মেয়েটা লোকটার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে একটা কিছু বলে। অমায়িক হাসিতে লোকটার মুখ থৈথৈ করে ওঠেÑ বাজান, আমার সঙ্গে মাইয়াটা আমার ছোট ভাইয়ের মাইয়া। ওর বাপ নাই। মাইয়াটার নাম দরদী। ও আমার লগে থাকে। দরদী মুরগির সালুন দিয়া সাদা ভাত খাইতে চায়। আপনের কি খুব অসুবিদা অইবে?


আমি, আমজাদ আর সুমন প্রায়ই সুমনের রড ইট সিমেন্টের দোকান সোনার বাংলা এন্টারপ্রাইজে আড্ডা দিই। আজও দিচ্ছি। উঠব উঠব করছিÑ ঠিক এ সময়ে সোনার বাংলা এন্টারপ্রাইজের সামনে দশাসই চেহারার একজন ভিক্ষুক আসে। স্বাস্থ্যবান, গায়ের রং হালকা ফর্সা, মুখে বেশ লম্বা কাঁচাপাকা দাড়ি, মাথার ওপর ময়লা টুপি, ডান হাতে তসবি। তার বাম হাত ধরে এগোচ্ছে সাত-আট বছরের একটি মেয়ে। মেয়েটির হাতে এ্যালুমিনিয়ামের একটি বাটি। বাটিতে বেশ কয়েকটা এক টাকার কয়েন এবং দু-তিনটি ছেঁড়া দুই টাকার নোট।
বাজান, ভিক্ষা দেনÑ লোকটা খুব সাবলীলভাবে বলে দাঁড়িয়ে হাতের তসবিহ টিপতে থাকে। সঙ্গের মেয়েটা হাতের বাটি বাড়িয়ে ধরে। সুমন ড্রয়ার খুলে একটা দুই টাকার নোট বের করে মেয়েটির বাটিতে রাখে।
চাচা লওÑ মেয়েটি সামনে হাঁটতে শুরু করে। লোকটিও মেয়েটির পেছনে হাঁটতে শুরু করে। সুমন লোকটির দিকে বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে আছে পলকহীন চোখে।
কিরে সুমন? ধাক্কা দেয় আমজাদÑ লোকটির দিকে অমন করে তাকিয়ে আছিস কেন? আমজাদের ধাক্কায়ও সুমন লোকটির দিকে তাকিয়েই থাকে। মনে হচ্ছে সুমন গভীর কোন স্মৃতি খুঁজে ফিরছে। আমাদের মনের ভাবনা শেষ হতে পারে না, সুমন ডাক দেয়Ñ চাচা? শোনেন তো একটু...
কিন্তু ভিখেরিকে কেউ চাচা সম্বোধন করতে পারে বা করে হয়ত সে অভিজ্ঞতা ভিখেরির নেই বা ছিল না। সুতরাং সে বারেক না তাকিয়েই হন হন করে মেয়েটির সঙ্গে হাঁটতে থাকে। সুমন গদি ছেড়ে স্প্রিং দেয়া পুতুলের মতো লাফিয়ে ওঠে এবং পলকে লোকটির কাছে ছুটে যায়। আমরা অবাক চোখে তাকিয়ে আছি, তাকিয়ে ঘটনার তাৎপর্য বোঝার চেষ্টা করছি। লোকটি কি সুমনদের আত্মীয়? কিংবা খুব পরিচিত? অথবা প্রতিবেশী? সুমনের এত আগ্রহ কেন ভিখেরি লোকটার প্রতি? আমাদের ভাবনার মধ্যে সুমন লোকটাকে খুব যতেœর সঙ্গে এনে বসায় আমাদের সামনে একটা খালি চেয়ারে। নিজেও বসে। সুমন এখন আমাদের চেনে না। ওর সব মনোযোগ ভিখেরির প্রতি। ভিখেরির সঙ্গের মেয়েটিকেও বসতে দেয় আর একটি চেয়ারে। হঠাৎ অভাবনীয় সম্মানে ভিখেরি এবং মেয়েটি খানিকটা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হলেও তারা এটাকে উপভোগ করতেও শুরু করে।
কি খাবেন চাচা? সুমন জিজ্ঞেস করে লোকটাকে।
লোকটা প্রাণ খুলে হাসতে শুরু করেÑ বাজান আমি ভিখেরি মানুষ, যা পাই খাই। কোন কিছু চাইয়া খাই না।
তারপরও বলুন, আজ আপনি যা খেতে চাইবেন আমি খাওয়াব। এখানে মুরগির বিরানি পাওয়া যায়। গরুর মাংসের ভুনা খিচুড়িও আছেÑ সাদা ভাত আছেÑ কোন্টা খাবেন? সুমন খুব সম্মানের সঙ্গে জানতে চায়।
মেয়েটা লোকটার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে একটা কিছু বলে। অমায়িক হাসিতে লোকটার মুখ থৈথৈ করে ওঠেÑ বাজান, আমার সঙ্গে মাইয়াটা আমার ছোট ভাইয়ের মাইয়া। ওর বাপ নাই। মাইয়াটার নাম দরদী। ও আমার লগে থাকে। দরদী মুরগির সালুন দিয়া সাদা ভাত খাইতে চায়। আপনের কি খুব অসুবিদা অইবে?
আরে না, দু-তিন মিনিটের কারবারÑ সুমন দাঁড়ায়Ñ আপনারা বসুন, আমি আসছি।
সুুমন আবার গদি ছেড়ে বেরিয়ে পড়ে। মেসার্স সোনারবাংলা এন্টারপ্রাইজের ঠিক উল্টোদিকে হোটেল মধুমিতায় ঢোকে সুমন। সাধারণত এমনটা ঘটে না। কোন কিছুর প্রয়োজন হলে এপার থেকে ডাক বা ইশারা দিলে হোটেল মধুমিতার কোন একজন মেসিয়ার ছুটে আসে। কারণÑ ভাল সেলামি মেলে এখানে। আবার অনেক সময় আমরা নিজেরাই হোটেল মধুমিতায় প্রবেশ করি।
বাজানের মনে গরিবের লাইগা অনেক দরদÑ ভিখেরি লোকটা আপন মনে না কি আমাদের শুনিয়ে কথাটা বলে ঠিক ঠাহর করতে পারি না আমরা। কিন্তু একটা বিষাদ বিরক্তিতে আমাদের মন ভরে গেছে। সুমন কি আমাদের ওর সংবেদনশীল মনের পরিচয় দেখানোর জন্য হঠাৎ এই আয়োজনে নেমেছে? ও তো এমন মানুষ নয়। হঠাৎ কি কারণে এই ভিখেরি লোকটা ওর কাছে এত গুরুত্বপূর্ণ হলো?
রাহাত? আমার কাঁধ খাঁমচে ধরে আমজাদ।
আমি ওর দিকে তাকাই। ও ইশারা করলে ওর দৃষ্টি অনুসরণ করে তাকাই এবং তাকিয়েই হতবাক। সুমন নিজেই ভাতের প্লেট নিয়ে আসছে দু’হাতে। পেছনে হোটেলের বয়। বয়ের হাতে মুরগির মাংসের বাটি, পানির জগ ও গ্লাস। সব এনে টেবিলের ওপর রাখে।
চাচা, শুরু করুন।
দরদী চটপট টাইপের মেয়ে। সে দ্রুত তার চাচার হাত ধুইয়ে প্লেট টেনে ধরিয়ে দেয়। নিজেও হাত ধুয়ে অন্য প্লেট টেনে মুরগির সালুন পাতে নিয়ে দ্রুত খেতে আরম্ভ করে খুব সাবলীলভাবে। আমরা যে কয়েকজন মানুষ সামনে দাঁড়িয়ে আছি, এ নিয়ে কোন ভাবান্তর দেখলাম না। আমাদের নাকে মুরগির মাংসের গন্ধ এসে ধাক্কা দেয়। পুরো পরিবেশটা কেমন অসহ্য হয়ে উঠল। আমজাদ তাকায় আমার দিকেÑ রাহাত, চল।
চল, আমি দাঁড়াই।
খপ করে হাত ধরে সুমনÑ আর একটু বস।
তাহলে আমি যাই? আমজাদ বলেÑ আমার একটা জরুরী কাজ আছে।
যাবি না তোরা কেউ। তোদের সঙ্গে আমার জরুরী কথা আছেÑ খুব সিরিয়াসভাবে বলে সুমন।
আমজাদ অসহায়ভাবে কাঁধ ঝাঁকায়। আমি ওদের খাওয়ার দৃশ্য থেকে চোখ অন্যদিকে ফিরিয়ে রাস্তায় চলাচলরত যানবাহন দেখতে থাকি। যানবাহন দেখতে আমার খুব ভাল লাগে। একটা বাসের মধ্যে হরেক রকম মানুষ গাদাগাদি ঠাসাঠাসি করে একে অপরের সঙ্গে গুঁতোগুঁতির দাপটে ছুটে চলে উর্ধশ্বাসে। যেন সে না গেলে পৃথিবীর এক প্রান্ত অতলে হারিয়ে যাবে। কোথায় যায় এত মানুষ? আমার ভাবনা আমার ভেতর বেশিক্ষণ ক্রিয়া করতে পারে না সুমনের সংলাপের কারণে।
চাচা? ডাকে সুমন।
সুুরুৎ সুরুৎ ঝোল টেনে খেতে খেতে কথা বলে লোকটাÑ বলেন বাজান।
আপনার নাম কি?
বাজান নাম দিয়া কি করবেন? আমি রাস্তার সামান্য ফকির মানুষ। ভিক্ষা কইরা খাই।
কিন্তু আমি আপনার নাম জানি। লোকটার ছলাৎ ছলাৎ খাওয়ার গতি হঠাৎ থেমে যায়Ñ আপনে আমার নাম জানেন?
জানি। আপনার নাম তোবারক। লোকে আপনাকে জবাই তোবারক বলত। কি আমি ঠিক বলেছি?
তোবারক খাওয়া থামিয়ে তাকায় সুমনের দিকেÑ আপনে যহন খুব যতœ কইরা বসাইতেছিলেন তহনই আমার মনে কেমন সন্দেহ হইতেছিল। বাজান, যা হবার হইয়া গেছে, আগের কথা আর সামনে টানতে চাই নাÑ লোকটা গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার খাওয়ায় মন দেয়।
আমরা অন্য রকমের ঘটনার সন্ধান পাই। সুমন লোকটার দিকে অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে আছে। লোকটাকেÑ তোবারককে অনেক স্মৃতির ওপার থেকে চিনবার চেষ্টা করছে মনে হচ্ছে।
সুুমন? ডাকে আমজাদ। এই লোকটা কে?
খুব শৈশবে নানা মুখে শুনতাম তোবারক ডাকাতের নানা লোমহর্ষক ঘটনা। যে বাড়িতে তোবারক ডাকাত ঢোকে সে বাড়িতে একটা দুটো মানুষ খুন হবেই। খুন বললে ভুল বলা হবেÑ জবাই করে হত্যা এবং এই জবাই করার কাজটা করত ডাকাত সরদার তোবারক নিজে। কারণÑ মানুষ জবাই করে হত্যা করতে সে খুব পছন্দ করত। জবাই হয়ে যাওয়া মানুষটির আর্তি ও আর্তনাদ ডাকাত সরদার তোবারকের খুব ভাল লাগত। মানুষকে জবাই করার সময় নিজেকে তার বিধাতার মতো শক্তিশালী মনে হতো।
সুুমন বলছে আর আমরা তোবারকের দিকে তাকিয়েই আছি। লোকটা নির্বিকার। যেন শুনতে পাচ্ছে না কিছুই। তার একমাত্র কাজ খেয়ে যাওয়া- সে খেয়ে যাচ্ছে। কথার ফাঁকে সুমন আর এক প্লেট ভাত তোবারকের পাতে ঢেলে দেয়। তোবারক মুরগির মাংসের সালুন আর পাতলা ডালের সঙ্গে ভাত মেখে মেখে মুখে দিতে থাকে। মনে হয় তার পেটে অনন্তের ক্ষুধা।
আমরা তখন সিক্সে কিংবা সেভেনে পড়িÑ এই সময় আমাদের বাড়িতে ডাকাত সরদার তোবারক চিঠি পাঠায়। লোকটা চিঠি দিয়ে ডাকাতি করত? প্রশ্ন আমজাদের।
হ্যাঁÑ বড় বড় ডাকাত চিঠি দিয়ে ডাকাতি করত এক সময়। তখন দেশ সবেমাত্র স্বাধীন হয়েছে। চারদিকে পাকিস্তানীদের ধ্বংসযজ্ঞ। আইনশৃঙ্খলা কর্তৃপক্ষ ততটা মজবুত হয়ে বসতে পারেনি। এই সুযোগটাই গ্রহণ করেছিল কিছু মানুষরূপী হায়েনার দল। শোনা যায় তারা মুক্তিযুদ্ধের নামে অপকর্ম করে বেড়াত। বলা যায় এরা ছিল রাজাকার আল বদরদের একটি শাখা সংগঠন। তাদেরই একটি শাখা দলের প্রধান ছিল এই তোবারক ডাকাত। তার দলের নৃশংসতার খবর লোকের মুখে মুখে ফিরত। শুনেছিÑ ছোট ছোট বাচ্চাকে ঘুম পাড়াতে কিংবা ভাত খাওয়াতে তোবারক ডাকাতের ভয় দেখাত মা-চাচিরা।
তোদের বাড়িতে তোবারক ডাকাত এসেছিল? সামনে বসে তোবারক ডাকাতকে দেখতে দেখতে প্রশ্ন করি আমি। আমার কেমন যেন সন্দেহ জাগেÑ সুমন আমাদের সম্মোহিত করতে চাইছে। একজন খুনে রক্তপিপাসু ডাকাতকে সামনে বসিয়ে আদর-যতেœ মুরগির সালুন দিয়ে সাদা ভাত খাওয়াতে খাওয়াতে আমাদের কোন এক বধ্যভূমিতে নিয়ে যাচ্ছে ও?
মৃদু হাসে সুমনÑ এসেছিল মানে? না আসলে এই তোবারক ডাকাতকে চিনলাম কি করে?
তোর শৈশবের ঘটনা মনে আছে? মৃদু সংশয় প্রকাশ করে আমজাদ।
কেবল আমার নয় যে কোন মানুষেরই মনে থাকবে সেই লোমহর্ষক ঘটনা ও ঘটনার মানুষকে।
বল, অনুমতি দেয় আমজাদ।
আমাদের বাড়িটা অনেক বড়। এগারোটা ছোটবড় ঘর। প্রত্যেক ঘরে যদি দু’জন করে তরুণও থাকেÑ সর্বমোট বাইশজন। কিন্তু ছিল আরও অনেক বেশি তরুণ, চাচাত মামাত ভাই মিলে। এলাকার লোকজন আমাদের বাড়ির কারও সঙ্গে পারতপক্ষে ঝগড়া ফ্যাসাদ করতে যেত নাÑ এক ডাকে আমাদের বাড়ি থেকে বিশ পঁচিশজন লোক বের হয়ে আসত। আবার ভেতরের ব্যাপার ছিল ভিন্নÑ বাইরে একতা থাকলেও ভেতরে ভেতরে কিন্তু একে অন্যের শত্রু ছিল। কেউ কারও চেয়ে খেয়ে পরে ভাল থাকুক অন্যরা চাইত না। কিংবা ধর কারও ছেলেমেয়ে পড়াশোনায় ভাল করলÑ এটা নিয়েও ঈর্ষা হতো।
ইন্টাংরেস্টি তো! আমি ফোড়ন কাটি।
যেখানে বেশি মানুষ সেখানেই বেশি সংঘাত, ঈর্ষা আর মানুষের ঠুনকো বড়াই থাকবেই।
ধমক দেয় আমজাদÑ তোর তত্ত্ব কথা রাখ। সামনে বাড়Ñ
তোবারক ডাকাতের খাওয়ার গতি কমে গেছে। সে খেতে পারছে না। মনে হচ্ছেÑ মেসার্স সোনারবাংলা এন্টারপ্রাইজের দোকান থেকে পালিয়ে যেতে পারলে বাঁচে। বার বার পানি খাচ্ছে। গলায় মুরগির সালুন আর সাদা ভাত আটকে যাচ্ছে। দরদী নির্বিকারভাবে হাপুস হুপুস খেয়ে যাচ্ছে। হয়ত জানেও না একজন লোমহর্ষক ডাকাতের সঙ্গে সে ভিক্ষার ব্যবসা করে।
অতবড় বাড়ি, প্রচুর লোক। মুক্তিযুদ্ধের সমর্থক সবাই ছিল নাÑ কেউ কেউ ইসলামের নামে পৃথিবীর অবাস্তব রাষ্ট্র পাকিস্তানকেও সমর্থন দিয়েছিল। আমাদের বড় চাচা সরাসরি পাকিস্তানের দালাল ছিল। তার ধারণা ছিলÑ পাকিস্তান না থাকলে দুনিয়াতে ইসলাম থাকবে না। অথচ তথাকথিত পাকিস্তান জন্মানোর কয়েক শ’ বছর আগে ইসলাম পৃথিবীতে এসেছিল। আরও কয়েকজন ছিল পাকিস্তানের পক্ষে। আমরা পুরো পরিবার স্বাধীন বাংলার পক্ষে। আমার বড় ভাই মাসুদ ভাইকে তো তোরা চিনিসÑ সে তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। থাকত ইকবাল হলেÑ এখন যেটা সার্জেন্ট জহুরুল হক হল। ছাত্রলীগের মাঝারি সাইজের নেতা। শেখ মুজিবের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল। ফলে একটা বাড়িতে অনেক ফ্যাক্টর কাজ করছিল। আমরা যারা ছোট অত না বুঝলেও পরিবারের সেই সৌহার্দ যে নেই বুঝতাম। (এরপর ২১-এর পাতায়)

(২২-এর পাতার পর)

সবাই পাশাপাশি থাকলেও সুযোগ বুঝে রাজনৈতিক স্বার্থ বুননের চেষ্টাও ছিল। এত কিছুর পরও মুক্তিযোদ্ধা ছিল প্রায় আঠারো-উনিশ জন সারা বাড়িতে। তোবারক ডাকাতের চিঠি পেয়ে মুক্তিযোদ্ধারা তাদের লুকিয়ে রাখা অস্ত্র বের করে আনে।
বাহ এ তো দেখছি রীতিমতো যুদ্ধ! বিস্ময় প্রকাশ করে আমজাদ।
সেটা সত্যি একটা যুদ্ধ ছিলÑ সুমন সমর্থন করে আমজাদকে। বাড়ির পেছনে ট্রেঞ্চ করা হয়েছিল। যে রাতে ডাকাত আসার কথাÑ সেখানে শিশু ও নারীরা সন্ধ্যা থেকেই লুকিয়েছিল। মাঝরাতে আমরা শুনেছিলাম কান ফাটা অজস্র গুলির শব্দ। এক সময়ে আর কিছু মনে নেই আমরা ঘুমিয়ে যাই। খুব সকালে ঘুম ভাঙলে দেখিÑ বাড়ির সামনে হাজার হাজার মানুষ। মানুষের সেই মিছিল আর শোরগোল লক্ষ্য করে এগিয়ে দেখিÑ অনেক মানুষ হাত-পা বাঁধা অবস্থায় মাটিতে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। আর ছেলে-বুড়ো যে যেভাবে পারছে লাথি কিল গুঁতো দিচ্ছে। কেউ কেউ লাঠি দিয়ে আচ্ছা করে পেটাচ্ছে। লোকগুলো নির্বিকারভাবে মুখ বুঝে সব সহ্য করে যাচ্ছে আর ফ্যাল ফ্যাল করে এদিক সেদিক তাকাচ্ছে। সেদিন না বুঝলেও আজ বুঝতে পারিÑ কি ছিল সেই দৃষ্টিতে?
বলত কি ছিল তাদের দৃষ্টিতে? জিজ্ঞেস করে আমজাদ।
তাদের দৃষ্টিতে ছিল নিখাঁদ বিস্ময়। যারা এতদিন মানুষ মেরেছে, মানুষের সংসার লুট করেছে আজ সেই তারা লুটের শিকার? বসে বসে মার খেয়েও সেটা মানতে পারছিল না তারা।
মৃৃদ হাসে আমজাদÑ তোর মধ্যে এক সাংঘাতিক দার্শনিক বাস করে রে সুমন, এতদিন জানতে পারিনি।
তোর সেই লোকগুলোই তো এই তোবারক ডাকাত দলের সদস্য? আমি জানতে চাই।
হ্যাঁ, সুমন তাকায় আমার দিকে। তোরা আমাকে বোকা ভাবতে পারিসÑ কিন্তু আমি সত্যি বলছি ডাকাত যে মানুষ, আমি এদের না দেখা পর্যন্ত জানতাম না সেই কিশোর বয়সে। আমি ভাবতামÑ যারা মানুষকে এমন নিপীড়ন করে, আনন্দের সঙ্গে জবাই করে তারা ভিন্ন জাতের কোন প্রাণী। মানুষ হয়ে মানুষকে এমন নির্দয়ভাবে খুন করে কিভাবে? যেমন ধরÑ মুক্তিযুদ্ধের সময় রাজাকার আলবদর জামায়াতের নির্মম খুনোখুনির ঘটনা যখন শুনতামÑ এরাও যে মানুষ জানতাম না। ভেবেছি এরা এক ধরনের জন্তু বা জানোয়ার। কিন্তু বড় হয়ে যখন বুঝতে পারলাম এই খুনীরাও মানুষ তখন বিস্ময়ে হতবাক হয়েছি। যারা কেবল চিন্তার পার্থক্যের জন্য একই ধর্মের মানুষ হয়েও হত্যাযজ্ঞে মেতে ওঠে প্রতিবেশী বা স্বদেশের মেধাবী মানুষদের হত্যা করতেÑ তারা কেমনে মানুষ হয়? এই প্রশ্নের উত্তর আজও পাইনি।
সুমনের ভেতর যে এমন চিন্তার বিস্তার আছে আমরা সত্যি জানতাম না। ওকে দেখতাম ভাসমান পদ্মর মতো সদাহাস্য মুখ। দিনরাত হাসি আনন্দের স্রোতে গা লাগিয়ে থাকে। আসলে প্রত্যেক মানুষের নিজস্ব একটা ভুবন থাকেÑ যে ভুবন একান্ত তার নিজের। আজকে বিনামেঘে বজ্রপাতের মতো তোবারক ডাকাতের মুখোমুখি না হলে সুমনের গভীর
অন্তরলোকের মানবিক ভাবনার সঙ্গে আমাদের পরিচয় হতো না।
চাচাজান? দরদী ডাকে তোবারক ডাকাতকে। দরদীর খাওয়া শেষ। সে খুব যতেœর সঙ্গে ডান হাতের সালুন মাখা আঙ্গুলগুলো চাটছে।
তোবারক ডাকাতের খাওয়াও শেষ। তার ডান হাতখানা চেটেপুটে খাওয়া ভাতের থালার মাঝখানে ছিন্ন জামরুলের মতো স্থির। মুখ ভাবলেশহীন। তার শ্বাস-প্রশ্বাস বেড়ে গেছে। শব্দ করে শ্বাস নিচ্ছে সে। ইতোমধ্যে মেসার্স সোনারবাংলা এন্টারপ্রাইজের টেবিল ঘিরে একটা ছোটখাটো জটলা জমেছে। আশপাশের দোকানের লোকজন এসে সুমনের মুখে তোবারক ডাকাতের ঘটনা শোনে আর বিস্ফোরিত চোখে সামনে বসা জলজ্যান্ত তোবারককে দেখে। তোবারকও বুঝে গেছে সে এক চিড়িয়াখানার জন্তু বনে গেছে।
হ্যাশে আপনেরা তোবারক ডাকাইতরে কি করলেন? পাশের দোকানের এক কর্মচারী জানতে চায়।
আমার তো কিছু করার ছিল না। যা করার বড়রাই করেছে। আমি এবং আমার বয়সের ছেলেমেয়েরা দেখেছি। এখন আপনাদের যা বলছিÑ আমার সেই সময়ের দেখা দৃশ্যাবলী থেকেই বলছি এবং পরবর্তীতে বড় ভাইদের বলা ঘটনা থেকেÑ সুমন যেন উপস্থিত জনতাকে একটা কৈফিয়ত দিচ্ছে।
এতক্ষণ আমজাদ চুপ থাকার পর মুখ খোলেÑ তোর বড় ভাইয়েরা খুব খারাপ একটা কাজ করেছে রে সুমন। ওর কণ্ঠে খানিকটা ক্ষোভ।
কিভাবে?
এই খুনে রক্তপিপাসু ডাকাতটাকে বাঁচিয়ে রেখে মস্ত অন্যায় করেছে তারা।
সেটা তাদের ব্যাপার ছিল। তবে তাদের বিচারটা মনে হয় ভালই হয়েছেÑ তাকায় তোবারক ডাকাতের দিকেÑ আপনি কি বলেন তোবারক সাহেব?
হঠাৎ তোবারক ডাকাত তার দশাসই শরীর কাঁপিয়ে টেবিলে মাথা রেখে হাহাকার করে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। উপস্থিত লোকসকল হঠাৎ কান্নার জন্য প্রস্তুত ছিল না। যে ডাকাত নিজের হাতে মানুষ জবাই করার সময় নিজেকে বিধাতা ভাবতÑ জবাই করে মানুষের টাটকা রক্তে হাত ডুবিয়ে দেয়ালে দেয়ালে ছবি আঁকত, সেই তোবারক ডাকাতের এমন সকরুণ আত্মসমর্পণ কেউ আশা করেনি। তারা ভেবেছিল সুমনের কথা শেষ হবার আগেই তোবারক ডাকাত রাগে ক্ষোভে চিৎকারে ফেটে পড়বেÑ সুমনকে কেটে টুকরো টুকরো করে মহাসড়কের কংক্রিটে বিছিয়ে সুনামির সর্বনাশে অবাক অট্টহাসিতে নাচবে। সেখানে সে কি নির্বিকার! তার এই নির্মম নির্বিকারত্ব উপস্থিত লোকসকল মানতে পারছে না। তারা চায় তোবারক ডাকাত একটা ভয়ঙ্কর হুঙ্কার দিয়ে আবার মাঠে নামুক। দেখিয়ে দিক তার প্রবল প্রতাব আর ...
দরদী এইবার বিচলিতবোধ করে। সে তার এতদিনের পরিচিত চাচাকে অপরিচিত আঙ্গিকে কাঁদতে দেখে হতবাক। দরদী তার চাচার পিঠে হাত রাখে। তোবারক তার উচ্চস্বরের কান্না থামায় এবং থেতলানো মিহি সুরে কাঁদতে থাকে। তার কাঁদার সঙ্গে সঙ্গে শরীর কেঁপে কেঁপে ওঠে।
বিচারে কি হয়েছিল? প্রতিবেশী দোকানদারদের একজন জানতে চায়।
আমাদের এলাকা থেকে ভান্ডারিয়া থানা প্রায় আট-নয় কিলোমিটার দূরে। সকালেই থানায় খবর দেয়ার জন্য লোক পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিল। এই ফাঁকে ডাকাতের হাতে অত্যাচারিত লোকজন হামলে পড়ে। কয়েকজন ডাকাতকে পিটিয়ে মেরে ফেলে উন্মত্ত জনতা। কিন্তু সব মানুষের ক্ষোভ এই তোবারক ডাকাতের ওপর। তাকে নিয়ে কি করা যায়Ñ ভাবছে সবাই। থানা থেকে পুলিশ এলে ওকে নিয়ে যাবে, পুলিশ ওকে জেলে পাঠাবে এবং কয়েক বছর জেল খেটে বের হয়ে এসে আবার দ্বিগুণ উৎসাহে প্রতিশোধ নেবে। পুলিশ আসার আগে ওকে চিরকাল মনে রাখার মতো একটা শাস্তি দিতে চায় সবাই। কেউ বলে একটা হাত কেটে দিতে, কেউ বলে একটা পা কেটে দিতে। তখন আমাদের হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক গৌরকিশোর ঘোষ একটা পরামর্শ দেনÑ যা সবার মনে লাগে। এখানে একটা কথা বলা দরকারÑ গৌরকিশোর ঘোষ স্যারের তিন ছেলে মুক্তিযুদ্ধে যান এবং তিনজনই শহীদ হন।
উপস্থিত লোকজনের মনে তৎক্ষণাৎ না দেখা শিক্ষক গৌরকিশোর ঘোষের জন্য গভীর সহানুভূতি ও সম্মান অনুরণিত হয়।
তোবারক ডাকাতের কান্না থেমে গেছে। বুঝে গেছে জীবনের গল্প তাকে সারা জীবন বয়ে বেড়াতে হবে এভাবে। গৌর বাবু কি সিদ্ধান্ত দিলেন? আমার প্রশ্ন।
তিনি বললেনÑ তোবারককে মেরে ফেলা অন্যায় হবে। ওকে এমন একটা শাস্তি দিতে হবে যাতে বুঝতে পারেÑ অন্য মানুষকে কষ্ট দেয়া কত অন্যায় ছিল। তিনি বললেন ওর চোখ দুটো তুলে ওকে মুক্তি দাও। সঙ্গে সঙ্গে উপস্থিত লোকজন জয় বাংলা সেøাগান দিয়ে স্যারের ঘোষণাকে স্বাগত জানাল। একটু থামে সুমনÑ সেই সকাল, সেই দিনটি আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ স্মৃতি হয়ে আছে। আমাদের এলাকার কসাই হাবিবুরকে দায়িত্ব দেয়া হলো ওর চোখ তোলার। হাবিবুরের ছোট বোনের বাড়িতে মাস তিনেক আগে ডাকাতি করেছে তোবারক ডাকাতের দল। লোকমুখে জানা গেছে হাবিবুরের ছোট বোনকে ডাকাতরা ধর্ষণও করেছে। এই কারণেÑ বোনটা এখন হাবিবুরদের বাড়িতেÑ জামাই নিতে চায় না। সুতরাং হাবিবুরের ক্ষোভ ছিল ভয়ঙ্কর রকম। অল্প সময়ের মধ্যে গরু বাঁধার দড়ি যোগাড় করে ওকে চোখের পলকের মধ্যে বেঁধে ফেলা হলো। হাতে সময় নেই, কারণ পুলিশ আসতে পারে যে কোন সময়। পুলিশ এলে চোখ তোলা যাবে না। দ্রুত তাকে আমাদের গ্রামের খেলার মাঠে নিয়ে গেল সবাই ধরাধরি করে। হাজার হাজার লোক চারপাশে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মুক্তিযোদ্ধারা পাহার দিচ্ছেন। ওকে চিৎ করে সবুজ ঘাসের ওপর শোয়ানো হলো। যদিও হাত দুটো পিছমোড়া বাঁধাÑ তারপরও চার-পাঁচজনে মিলে হাত ও পায়ের ওপর দাঁড়িয়ে গেল। যাতে সে একচুল পরিমাণ নড়াচড়া করতে না পারে। হাবিবুর তার গরুর মাংস বানানো বিশেষ কায়দায় তৈরি তীক্ষè চাকু নিয়ে দাঁড়ায় ওর বুকের ওপর। তাকায় উপস্থিত জনতার দিকে। জনতার ভেতর একটা সাড়া পড়ে যায়।
হাবিবুর মৃদু হেসে হাতের ছুরিটা নাচাতে নাচাতে হঠাৎ ঢুকিয়ে দেয় ডান চোখে। ফিনকি দিয়ে রক্তের একটা ধারা উঠল এবং কানে এলো একটি সকরুণ বিলাপধ্বনিÑ আমি সেই আর্তধ্বনি আর কখনও কোথাও শুনিনি। বাতাসে কান পাতলে আমি এখনও একজন মানুষের অতিমানবিক বিলাপধ্বনি শুনতে পাই। উপস্থিত হাজার হাজার লোকের মধ্যে নেমে এলো অবাক নীরবতা। মনে হলো সেই মাঠে কোন মানুষ নেই। হাবিবুর হাতে ওর চোখটা নিয়ে একটু পরখ করে দেখে জনতার দিকে ছুড়ে মারে। জনতা দূরে সরে যায়। চোখটা বিপুল ঘাসের সবুজ রঙের মধ্যে ডুব দেয়। তার কয়েক মুহূর্ত পর হাবিবুর দ্বিতীয় চোখ তুলে আনে এক লহমায় এবং বাতাসে ভেসে আসে আগের চেয়েও করুণ বর্ণনাতীত বিলাপধ্বনি। দ্বিতীয় চোখ হাতে নিয়ে হাবিবুর নেমে আসে তোবারকের বুকের ওপর থেকে। অন্যরাও নামে। শরীরের ওপর থেকে লোক সরে গেলে তোবারক সাহেব উঠে বসার চেষ্টা করেÑ কিন্তু হাত বাঁধা থাকায় পারে না। তখন আপনি কি করেছিলেন আপনার মনে আছে? সামনে বসা তোবারক ডাকতকে খুব আলতোভাবে জিজ্ঞেস করে সুমন। যেন অনেকদিনের পরিচয় ওদের দু’জনের।
তোবারক নিরুত্তর থাকে। দরদীর কাঁধে হাত রাখে। সে এখান থেকে চলে যেতে চায়। এখানে থাকা মানে দ্বিতীয়বার তার হত্যা দৃশ্য তাকেই উপভোগ করতে হবে।
আপনার মনে না থাকলেও আমার মনে আছেÑ সুমনকে আজ স্মৃতি তাড়িত কথায় পেয়েছে এবং সেই সঙ্গে পেয়েছে নিষ্ঠাবান শ্রোতা, সামনে পেয়েছে প্রধান চরিত্র তোবারককেÑ সুতরাং কথা তো বলবেইÑ আপনি দড়ি পাকানোর মতো করে সারাটা মাঠে গড়িয়ে যেতে যেতে হাহাকার করে কাঁদছিলেন। মাঠে ছিল লম্বা ঘাসÑ আপনি সেই ঘাসের ওপর দিয়ে যন্ত্রণায় কাতরাতে কাতরাতে যখন শরীরে দড়ি পাকাচ্ছিলেন, যদিও আপনি অনেক মানুষকে নিজের হাতে হাসতে হাসতে খুন করেছিলেন, সেই সকালে আমাদের খেলার মাঠে উপস্থিত প্রত্যেকটি মানুষের চোখে আপনি ছিলেন গণশত্রু কিন্তু কি আশ্চার্যÑ আপনার চোখ দুটো উপড়ে ফেলার পর সকরুণ বিলাপ ও আর্তনাদে অনেকের চোখে আমি পানি দেখেছি। এমনকি আমি নিজেও কেঁদেছি আপনার জন্য... বিশ্বাস করুন, সুমন হাত ধরে তোবারক ডাকাতেরÑ
আমি অহন যেতে চাইÑ গলায় অসহায় ক্ষোভ।
আপনার সঙ্গে আবার দেখা হবে ভাবি নাই তোবারক সাহেবÑ আপনাকে না পুলিশ নিয়ে গিয়েছিল! শুনেছিলাম আপনার যাবজ্জীবন কারাদ- হয়েছে। ছাড়া পেলেন কিভাবে?
অন্ধ মানুষরে জেলেও রাখতে চায় না। আমারে কয়েক বছর পর ছাইড়া দিয়াছেÑ দাঁড়ায় তোবারকÑ আমারে যাইতে দেন।
যান আপনে, আপনাকে কেউ কিছু বলবে না। সুমন কথা বলতে বলতে মানিব্যাগ বের করে দরদীর হাতে দুটো পাঁচ শ’ টাকার নোট ধরিয়ে দেয়। দরদীর চোখে-মুখে উল্লাস। যেতে যেতে তোবারক ফিরে তাকায়Ñ বাজান, আপনেরে একটা কথা কই?
বলুন।
আপনেরা যদি আমারে অন্ধ না কইরা মাইরা হালাইতেন, অনেক ভাল অইত।
তার কণ্ঠ ভারি হয়ে আসেÑ পথে পথে ভিক্ষা কইরা কুকুরের মতো আর বাঁচতে ইচ্ছা করে না। কত দিন মরতে চাইছি কিন্তু হেইসব মানুষের মরণের কষ্ট মনে পইড়া যায়... মনে পইড়া যায়Ñ আর মরতে পারি না।
লোকটা ধিকি ধিকি আগুনের মধ্যে হেঁটে হেঁটে চলে যায়। আমরা তার পথের দিকে বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে থাকি।

No comments

Powered by Blogger.