কঠোর কর্মসূচী নেই ১৮ দলীয় জোটের

নির্দলীয় সরকার পুনর্বহালসহ বিভিন্ন দাবিতে বিক্ষোভ, সমাবেশ, মিছিল, গণসংযোগসহ দুই মাসব্যাপী গতানুগতিক আন্দোলন কর্মসূচী পালনের ঘোষণা দিয়েছে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোট। ৭ সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হয়ে ৩০ অক্টোবর পর্যন্ত দেশব্যাপী এ কর্মসূচী চলবে।
মঙ্গলবার নয়া পল্টনে দলীয় কার্যালয়ে ১৮ দলীয় জোট নেতাদের বৈঠক শেষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এই কর্মসূচী ঘোষণা করেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব ও ১৮ দলীয় জোট লিয়াজোঁ কমিটির আহ্বায়ক মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। উল্লেখ্য, রবিবার বিএনপির স্থায়ী কমিটি ও সোমবার ১৮ দলীয় জোটের বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুসারে মঙ্গলবার এ কর্মসূচী ঘোষণা করা হয়।
কর্মসূচী ঘোষণার পর আগাম ঘোষণা দেয়া সত্ত্বেও এখন কঠোর কর্মসূচী না দেয়া প্রসঙ্গে মির্জা ফখরুল বলেন, দেশের রাজনীতিতে আমরা ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে চাই। জনগণের দুর্ভোগ হয় ও অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হয় এমন কর্মসূচী দিতে চাই না। এ ছাড়া আন্দোলনের কতগুলো স্তর থাকে, যার মাধ্যমে ধীরে ধীরে অগ্রসর হতে হয়। আর আমাদের আন্দোলন কর্মসূচীতে জনগণকে আরও সম্পৃক্ত করতে চাই। নির্দলীয় সরকারের দাবি আদায়ে সরকারকে বাধ্য করতে সারাদেশে জনমতকে আরও শক্তিশালী করতেই এই কর্মসূচী ঘোষণা করছি। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কর্মসূচী শুরুর আগেই সারাদেশে ১৮ দলীয় জোটের লিয়াজোঁ কমিটি গঠন করা হচ্ছে। অপর এক প্রশ্নের জবাবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের রূপরেখা দেয়ার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে তিনি বলেন, সরকারের সঙ্গে আলোচনা হতে পারে নির্দলীয় সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নিয়ে, অন্য কিছু নিয়ে নয়। আর নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের রূপরেখা তো সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীতে দেয়াই আছে। তাই আদালতের রায়ের আলোকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থায় নির্বাচন করার ব্যাপারে সরকার আলোচনা করতে চাইলে আমরা রাজি আছি।
ঘোষিত কর্মসূচীর মধ্যে রয়েছে ৭ থেকে ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সারাদেশের সকল মহানগর, জেলা ও উপজেলায় গণমিছিল ও জনসভা এবং ১৮ দলীয় জোট নেতাদের গণসংযোগ। ২০ সেপ্টেম্বর থেকে ৩০ অক্টোবর পর্যন্ত আগে যেসব মহানগর ও জেলা সদরে জনসভা করেননি সেসব মহানগর জেলায় খালেদা জিয়ার উপস্থিতিতে জনসভা ও গণসংযোগ। সরকারের দলীয়করণ, অব্যবস্থাপনা ও সন্ত্রাসের প্রতিবাদ এবং প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অচলাবস্থা নিরসনের দাবিতে ৬ সেপ্টেম্বর রাজধানী ঢাকাসহ সকল মহানগর সদরে বিক্ষোভ সমাবেশ ও মিছিল। এ ছাড়া পদ্মা সেতুসহ সকল ক্ষেত্রে সরকারের দুর্নীতির প্রতিবাদে ৯ সেপ্টেম্বর, সারাদেশের সকল মহানগর, জেলা ও উপজেলায় বিক্ষোভ সমাবেশ, চাল, ডাল, তেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, জ্বালানি, গ্যাস, বিদ্যুত, পানি ও কৃষি উপকরণের মূল্য বৃদ্ধির প্রতিবাদে ১৬ সেপ্টেম্বর সারাদেশের সকল মহানগর, জেলা ও উপজেলায় বিক্ষোভ সমাবেশ, বিএনপি নেতা এম ইলিয়াস আলীসহ বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের গুম, খুন ও নির্যাতনের প্রতিবাদে ২৩ সেপ্টেম্বর সারাদেশের সকল মহানগর, জেলা ও উপজেলা সদরে বিক্ষোভ সমাবেশ এবং খালেদা জিয়াসহ বিরোধী দলের শীর্ষনেতাদের বিরুদ্ধে মামলা ও রাজবন্দীদের মুক্তির দাবিতে ৩০ সেপ্টেম্বর সারাদেশের সকল মহানগর, জেলা ও উপজেলা সদরে বিক্ষোভ সমাবেশ। এসব কর্মসূচী শেষে আবার ১৮ দলীয় জোট নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করে বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া পরবর্তী কর্মসূচী ঘোষণা করবেন বলে মির্জা ফখরুল জানান।
সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান সৈয়দ মুহাম্মদ ইব্রাহিম, জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার, ঢাকা মহানগর জামায়াতের নায়েবে আমির হামিদুর রহমান আযাদ, এলডিপি মহাসচিব রেদোয়ান আহমেদ, যুগ্ম মহাসচিব সাহাদাত হোসেন সেলিম, এনপিপি চেয়ারম্যান শেখ শওকত হোসেন নিলু, জাগপা সভাপতি শফিউল আলম প্রধান, ইসলামী ঐক্যজোটের মহাসচিব আবদুল লতিফ নেজামী, এনডিপি সভাপতি খন্দকার গোলাম মর্তুজা, ন্যাপ সভাপতি জেবেল রহমান গানি, ডেমোক্র্যাটিক লীগের সাধারণ সম্পাদক সাইফুদ্দিন মনি, পিপলস লীগের সভাপতি গরীব নেওয়াজ, লেবার পার্টির চেয়ারম্যান মুস্তাফিজুর রহমান ইরান এবং মুসলিম লীগ (একাংশ) সভাপতি এএইচএম কামারুজ্জামান খান।
সংবাদ সম্মেলনে মির্জা ফখরুল বলেন, দলীয় সরকারের অধীনে আমরা নির্বাচনে যাব না। কিন্তু সরকার দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন করার পাঁয়তারা করছে। পৃথিবীর কোন গণতান্ত্রিক দেশে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হয় বলে আমাদের জানা নেই। তিনি বলেন, ত্রয়োদশ সংশোধনীর আলোকে নির্দলীয় সরকার হতে হবে। তাই আমাদের মূল দাবি নির্দলীয় সরকার প্রতিষ্ঠা না হওয়া পর্যন্ত আমরা গণতান্ত্রিক আন্দোলন চালিয়ে যাব। তিনি বলেন, বর্তমান সরকার দেশ পরিচালনায় চূড়ান্ত ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। সরকারের একগুঁয়েমি, অযোগ্যতা ও সর্বগ্রাসী দুর্নীতির কারণে দেশের রাজনীতি বিপজ্জনক অবস্থায় মোড় নিয়েছে বলে আমরা আশঙ্কা প্রকাশ করছি।
ফখরুল বলেন, সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সরকার দেশকে সংঘাতের দিকে ঠেলে দিয়েছে। সরকারের আচরণ দেখে এখন স্পষ্টত প্রমাণ হয়েছে এ সরকার সচেতনভাবেই দেশকে অন্ধকার সুড়ঙ্গের দিকে নিয়ে গেছে। সরকার সুপরিকল্পিতভাবে অসৎ উদ্দেশ্যে রাষ্ট্রের সব প্রতিষ্ঠানকে পারস্পরিক সংঘাতের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। সরকার বিচার বিভাগ ও সংসদকে আজ মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। সোমবার হাইকোর্টের একটি রায়ে এই সঙ্কট আরও ঘনীভূত হয়েছে। স্পীকার নিরাপদ অবস্থানে থাকলেও ক্ষমতাসীন সরকারের মন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের বক্তব্য আক্রমণাত্মক। এ অবস্থা থেকে দেশকে রক্ষার লক্ষ্যে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তন করতে হবে। তিনি বলেন, নির্দলীয় সরকার কেবল বিএনপির দাবি নয়, জনগণের দাবি। তাই নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন দিয়েই এ সরকারকে ক্ষমতা ছাড়তে হবে। তা না হলে সরকারের অগণতান্ত্রিক কাজের বিরুদ্ধে জনগণকে সংগঠিত করে আন্দোলন করে দাবি আদায় করা হবে।
সরকারের দুর্নীতির কঠোর সমালোচনা করে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব বলেন, দুর্নীতির সঙ্গে মন্ত্রীরা জড়িত। পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির কারণে বিশ্বব্যাংক ঋণচুক্তি বাতিল করেছে। তিনি বলেন, সরকারী দলের লোকেরা আর্থিক প্রতিষ্ঠানেও লুটপাট চালাচ্ছে। আওয়ামী লীগের নেতা-নেত্রীরাই সোনালী ব্যাংকের পর্ষদের সদস্য। সেই সোনালী ব্যাংক থেকে হলমার্ক নামের একটি অখ্যাত কোম্পানির মাধ্যমে ক্ষমতাসীনরা সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা লুট করেছে। ডেসটিনি গ্রুপের মাধ্যমেও ক্ষমতাসীন দলের লোকজন সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এ ছাড়া পুঁজিবাজার থেকেও ক্ষমতাসীনরা হাজার হাজার কোটি টাকা লুট করেছে। মির্জা ফখরুল বলেন, দেশে আইনের শাসন নেই। সরকার বিরোধী দলকে নির্মূল করতে হত্যা, গুম ও নির্যাতন চালাচ্ছে। জাতি আজ ভয়াবহ সঙ্কটের মুখে। দেশের প্রতিটি মানুষ আজ উদ্বিগ্ন। অভাবের কারণে বাবা সন্তানকে হত্যা করছে। আর এ ঘটনা দেশের জন্য অশনিসঙ্কেত, যা আমাদের আবার ’৭৪ কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব বলেন, দ্রব্যমূল্য বেড়েই চলছে। সীমান্তে মানুষ হত্যা বেড়েই চলছে। আমরা পানির ন্যায্য হিস্যা পাচ্ছি না। বিদ্যুতের দাম বাড়ার কারণে শিল্প ও কৃষির উৎপাদন ব্যাহত এবং মানুষের জীবনযাত্রা ব্যাহত হচ্ছে।

No comments

Powered by Blogger.