রোজা রাখলে রোগ ও স্বাস্থ্যের উপকার by ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ

আল্লাহতায়ালা বলেন, “রোজা আমার জন্য, আমি নিজে রোজার প্রতিদান দেব।” সব ইবাদতই তো আল্লাহর জন্যই। তাহলে রোজাকে আল্লাহ কেন বললেন ‘আমার জন্য।’ আসলে অন্য সব ইবাদত করার পাশাপাশি তা প্রদর্শনের সুযোগ ও মনোভাব থাকে, যেমন নামাজ, হজ, যাকাত ইত্যাদি।


কিন্তু রোজা আল্লাহ এবং বান্দা ছাড়া প্রদর্শনের বা জাহির করার কোন সুযোগই থাকে না। আল্লাহর প্রতি বান্দার আনুগত্যই আমাদের জাগতিক ও পারলৌকিক কল্যাণের মূল নিয়ামক। এই আনুগত্য প্রকাশের অন্যতম উপায় হলো রোজা। দিনে রকমারি খাবারের প্রাচুর্য্য থাকার পরও বান্দা তা মুখে তোলে না। তৃষ্ণায় বুকের ছাতি ফেটে গেলেও পানি পান থেকে বিরত থাকে। প্রিয়জনদের সঙ্গে ইফতারের পসড়া সাজিয়ে বসে থাকে, কিন্তু নির্ধারিত সময়ের আগে খাওয়া হয় না। এদের উদ্দেশ্যে হাদিসে বলা আছে- “যে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের (সা.) আনুগত্য করে, সে-ই সফলকাম”। বান্দা যেহেতু শুধু আল্লাহর হুকুম পালন এবং সন্তুষ্টির জন্য রোজা রাখে, তাই আল্লাহতায়ালা নিজ হাতেই তার পুরস্কার দিবেন। মাহে রমজানের সিয়াম সাধনার মাধ্যমে রোজাদারের জন্য রয়েছে দৈহিক ও মানসিক উৎকর্ষ সাধন, আত্মিক ও নৈতিক অবস্থার উন্নতিসহ অশেষ কল্যাণ ও উপকার লাভ করার সুযোগ। রোজা মানুষকে সংযমী ও শুদ্ধ করে এবং অশ্লীল-মন্দ থেকে বিরত রাখে।
আর সেজন্যই প্রত্যেক মুমিন মুসলমান, সুস্থ অথবা রোগাক্রান্ত, সবাই রোজা রাখতে চান এবং আল্লাহর নৈকট্য লাভ করতে চান। তবে রমজানে রোগীরা প্রায়ই রোজা রাখবেন কি রাখবেন না তা নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভোগেন। অবশ্য কি কি অবস্থায় রোজা রাখা যাবে বা যাবে না তার সুস্পষ্ট বিধান শরীয়তে আছে। আবার সুনির্দিষ্ট কারণে রোজা না রাখতে পারলে তার পরিবর্তে ক্ষতিপূরণস্বরূপ কাযা, কাফফারা, ফিদিয়া বা বদলি রোজা রাখার সুস্পষ্ট ব্যবস্থা আছে। কিন্তু তারপরও রোজা পালনে যে আনন্দ, অনুভূতি, আত্মিক পরিতৃপ্তি এরসাথে সংযম, কুপ্রবৃত্তি দমন, লোভ-লালসা, হিংসা, প্রতিহিংসা ইত্যাদি ত্যাগ করার যে আলোকোজ্জ্বল আমেজ-অনুভূতির চর্চা হয় তা রমজানের রোজা ছাড়া অন্য কোনভাবে লাভ করা যায় না। তাই রোগাক্রান্ত অবস্থায়ও অনেকেই রোজা রাখতে চান। অনেকে এমনও বলেন “মরি মরব, বাঁচি বাঁচব, তবুও রোজা ছাড়ব না।”
রমজানে বিশেষ করে যারা ডায়াবেটিস, পেপটিক আলসার বা গ্যাস্ট্রিক আলসার, শ্বাসকষ্ট, হার্টের রোগ, উচ্চ রক্তচাপ ইত্যাদিতে ভুগছেন, তাদের সমস্যা হবার সম্ভাবনা থাকে। তবে রোজা রাখা নিয়ে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব থাকলেও রোজা রাখতে তারা প্রবল আগ্রহী। তারা যদি চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী রোজার মাসের জন্য ওষুধ সেবনবিধি ঠিক করে নিতে পারেন, তবে সহজেই রোজা রাখতে পারেন। এতে রোজা ভাঙ্গার বা রোজা থেকে বিরত থাকার কোন প্রয়োজন হয় না।
রোজা, রোগ ও আপনার স্বাস্থ্য
রোজা রাখার উদ্দেশ্য শরীরকে দুর্বল করে অকর্মন্য করা নয়, বরং শরীরকে সামান্য কিছু কষ্ট দিয়ে দৈহিক ও আত্মিক উৎকর্ষ সাধন। শুধু তাই নয়, অনেক রোগের বেলায় রোজায় ক্ষতি না হয়ে বরং বহু রোগব্যাধির প্রতিরোধক এবং আরোগ্যমূলক চিকিৎসা লাভে সহায়ক হয়। রোজায় স্বাস্থ্যের সমস্যার চেয়ে বরং স্বাস্থ্যের উপকারই বেশি হয়।
ডায়াবেটিস রোগী
রোজা ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে রোগীদের জন্য এক সুবর্ণ সুযোগ ও রহমতস্বরূপ। ডায়াবেটিস রোগীরা সঠিক নিয়মে রোজা রাখলে নানা রকম উপকার পেতে পারেন। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের মূল উপায় হলো খাদ্য নিয়ন্ত্রণ, আর রোজা রাখা হতে পারে এক অন্যতম উপায়। এতে সহজেই খাদ্য নিয়ন্ত্রণ সহজ ও সুন্দরভাবে করা যায়। যারা ইনসুলিনের ওপর নির্ভরশীল নন, তাদের ক্ষেত্রে রোজা রাখা হতে পারে আদর্শ চিকিৎসা ব্যবস্থা। যারা ইনসুলিন নেন তাদের ক্ষেত্রেও রোজা অবস্থায় ওষুধের মাত্রা কমাতে সহায়ক। শুধু রক্তের গ্লুকোজই নয়, রক্তের চর্বি নিয়ন্ত্রণেও রোজা মোক্ষম। এর সঙ্গে সঙ্গে রোজা ডায়াবেটিস রোগীকে সংযম, পরিমিতিবোধ ও শৃঙ্খলার শিক্ষা দেয় যা ডায়াবেটিসের চিকিৎসায় অপরিহার্য।
রক্তের কোলেস্টেরল
যাদের শরীরে কোলেস্টেরলের মাত্রা বেশি, রোজা তাদের কোলেস্টেরলের মাত্রা কমাতে সহায়তা করে। রোজা ভাল কোলেস্টেরলকে (এইচডিএল) বাড়াতে এবং মন্দ কোলেস্টেরলকে (এলডিএল) ও ট্রাইগ্লিসারাইড কমাতে সাহায্য করে।
অতিরিক্ত ওজন
যাদের ওজন অতিরিক্ত, তাদের ক্ষেত্রে রোজা ওজন কমানোর জন্য এক সহজ ও সুবর্ণ সুযোগ। ওজন কমে যাওয়ায় বিভিন্ন রোগ থেকে বেঁচে থাকা যায় যেমন উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগসহ শ্বাসকষ্টজনিত রোগ, বাতের ব্যাথা, অস্টিও আরথ্রাইটিস, গাউট ইত্যাদি। আবার ওজন কমাতে পারলে কোলেস্টেরলের মাত্রাও কমে আসে।
হৃদরোগী এবং উচ্চ রক্তচাপ
রোজার মাধ্যমে ডায়াবেটিস ও কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণ হওয়ার ফলে যারা হৃদরোগে অথবা উচ্চ রক্তচাপে ভুগেন তাদের জন্য রোজা অত্যন্ত উপকারী। এতে শরীরের, বিশেষ করে রক্তনালীর চর্বি হ্রাস পায়, রক্তনালীর এথেরোস্ক্লেরোসিস কমাতে সাহায্য করে, যা হৃদরোগের ঝুঁকি কমায় ও উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে।
পেপটিক আলসার
একসময় ধারণা ছিল পেপটিক আলসারে আক্রান্ত রোগীরা রোজা রাখতে পারবেন না, তাদের ঘন ঘন খাওয়া খেতে হবে, অনেকক্ষণ পেট খালি রাখা যাবে না। অনেকে মনে করেন রোজা পেপটিক আলসারের ক্ষতি করে এবং এ্যাসিডের মাত্রা বাড়ায়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এসব ধারণা ঠিক নয়। রোজায় নিয়ন্ত্রিত খাওয়া-দাওয়ার ফলে এ্যাসিডের মাত্রা কমে যায়। তাই সঠিকভাবে রোজা রাখলে এবং সঠিক খাবার দিয়ে সেহেরি ও ইফতার করলে রোজা বরং আলসারের উপশম করে, অনেক সময় আলসার ভাল হয়ে যায়। এছাড়া রোজা গ্যাস্ট্রাইটিস, আইবিএস ইত্যাদি রোগেও উপকারী।
শ্বাসকষ্ট বা এজমা রোগী
যারা এই সমস্ত রোগে ভোগেন, তাদেরও রোজা রাখতে কোন অসুবিধা নেই। রোজায় এ ধরনের রোগ সাধারণত বৃদ্ধি পায় না। বরং চিন্তামুক্ত থাকায় এবং আল্লাহর প্রতি সরাসরি আত্মসমর্পণের ফলে এ রোগের প্রকোপ কমই থাকে। প্রয়োজনে রাতে একবার বা দু’বার ওষুধ খেয়ে নেবেন যা দীর্ঘক্ষণ শ্বাস নিয়ন্ত্রণে রাখে। এ ধরনের ওষুধ বাজারে সহজেই পাওয়া যায়। দিনের বেলায় প্রয়োজন পড়লে ইনহেলার জাতীয় ওষুধ ব্যবহার করা যায়, যা রোজার কোন ক্ষতি করবে না।
উপসংহারে বলা যায়, রোজা যেহেতু আল্লাহ তায়ালার জন্য এবং আল্লাহ এর পুরস্কার দেবেন, তাই কেউ যদি মনে করেন আমি আল্লাহর জন্যই রোজা রাখব, যা হবার হবে, তার কোন সমস্যাই হবে না। আর যারা মনে করবে রোজা রাখলে নানা রকমের সমস্যা হবে, রোগের প্রকোপ বৃদ্ধি পাবে, নানা রকম জটিলতা হবে, তাদের বেলায় এসব সমস্যা হবার সম্ভাবনাই বেশি। দৈহিক রোজার সঙ্গে সঙ্গে অন্তরের রোজাটাই আসল, তাই কোন অজুহাত বা আলস্য করে রোজা পালন থেকে বিরত থাকা উচিত নয়।

লেখক : ডিন, মেডিসিন অনুষদ, অধ্যাপক, মেডিসিন বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়

No comments

Powered by Blogger.