প্রমিথিউসের জয়যাত্রা

দলের প্রথম রজতজয়ন্তীতে অনুভূতিটা কেমন? এই আনন্দ প্রকাশ করার মতো নয়। যখন প্রমিথিউস ব্যান্ড গড়ে তুলেছিলাম তখন এতদূর আসার কথা চিন্তাতেও ছিল না। এটা সত্যিই বিস্ময়কর যে, শ্রোতাদের ভালোবাসায় আমরা টিকে থাকতে পেরেছি এবং দীর্ঘ পঁচিশ বছর পেছনে ফেলে এসেছি।


এমন একটি মাইলফলক ছুঁতে পারা যে কোন ব্যান্ডের জন্যই বিশাল প্রাপ্তি এবং এর অনুভূতিও অনেক আনন্দের। টিকে থাকাই বড় কথা নয়, গানে গানে শ্রোতাদের ভাবনাগুলো তুলে এনে তাদের মাঝে বেঁচে থাকাই ব্যান্ড দলের লক্ষ্য হওয়া উচিত। সেটা মনে হয় কিছুটা হলেও আমরা করতে পেরেছি। না হলে হয়ত শুরু থেকেই জনপ্রিয়তার সঙ্গে পঁচিশ বছর পার করা আমাদের পক্ষে সম্ভব হতো না। আমাদের প্রথম রজতজয়ন্তীতে বাংলাদেশের সকল প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা প্রমিথিউসের সকল ভক্ত-শ্রোতাদের জানাচ্ছি ভালোবাসা এবং অভিনন্দন।
‘কীভাবে প্রমিথিউস ২৫ বছর পার করল, টেরই পেলাম না। এটা সত্যিই অবিশ্বাস্য। যে প্রেক্ষাপটে আমরা প্রমিথিউস ব্যান্ডদল গড়ে তুলেছিলাম, তখন এতটা দূর আসতে পারব চিন্তা করিনি। তবে আমাদের সবার মনে অনেক বেশি আত্মবিশ্বাস ছিল।’ বলছিলেন প্রমিথিউস ব্যান্ডদলের অন্যতম সদস্য বিপ্লব। গত ৪ জুন পড়ন্ত বিকেলে রাজধানীর ক্রিসেন্ট লেকের ধারে বসে আড্ডায় কথা হচ্ছিল প্রমিথিউসের সদস্যদের সঙ্গে।
এই ২৫ বছরে প্রমিথিউসের অর্জন কী?
বিপ্লব বলেন, ‘২৫ বছর টিকে থাকাটাও কম অর্জন নাকি? তবে আজকের অবস্থানে আসার পেছনে অন্যতম শক্তি দর্শক- শ্রোতাদের ভালবাসা।’
সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে অনেকটা পথ এগিয়েছে প্রমিথিউস। পেছনের দিনগুলোতে ফিরে যান বিপ্লব। বলেন, ‘প্রমিথিউসের শুরুর দিকটার কথা ভোলার নয়। ১৯৮৬ সালের কথা। আরিফ, রেজওয়ান ও শারেক একসঙ্গে গান করতেন। তাঁদের সঙ্গে জ্যামিং করতেন বন্ধু কোয়েলও। তখন আবার ‘কিউপিড’ নামে আমার একটি ব্যান্ড ছিল। কোয়েলের মাধ্যমে একদিন আরিফ, রেজওয়ান ও শারেকদের সঙ্গে পরিচয়। এরপর সবাই মিলে ভাবতে থাকি একটি নতুন ব্যান্ড গড়ার। সেটাই আজকের প্রমিথিউস।’
ব্যান্ডের লাইনআপের পরিবর্তন সম্পর্কে সোহাগ বলেন, ‘প্রমিথিউস পুরোপুরি একটা পরিবার। এখানে আমরা সবাই আন্তরিকতা নিয়েই কাজ করি। বিভিন্ন সময় লাইনআপে যেসব পরিবর্তন এসেছে, তা সদস্যদের জীবনের তাগিদে। ভুল- বোঝাবুঝি কিংবা মনোমালিন্যের কারণে ব্যান্ড ছাড়ার মতো ঘটনা প্রমিথিউসে কখনোই ঘটেনি।
ব্যান্ডের ২৫ বছর পূর্তিতে নতুন-পুরোনো সবাইকে নিয়ে একটি ডিজে লাইভ শো করার ইচ্ছেও আছে, বললেন রুবেল।
প্রমিথিউস দেশের গান নিয়ে কাজ করে, তাই স্বাধীনতার ৪০ বছর পূর্তি অনুষ্ঠানের সময় এ বছরের শেষ দিকে উদ্যাপন করা হবে প্রমিথিউসের রজতজয়ন্তী অনুষ্ঠান। এ উপলক্ষে বিভিন্ন সময়ে ব্যান্ডটির প্রকাশিত এ্যালবামগুলো থেকে নিজেদের দৃষ্টিতে সেরা গানগুলোর সংকলনের একটি এ্যালবাম উপহার দেয়ার কথাও ভাবছে দলটি। এ্যালবামের কাজ অনেকখানি এগিয়েছে বলে জানান মাইকেল।
২৫ বছরে প্রমিথিউসের ১৫টির মতো এ্যালবাম প্রকাশিত হয়েছে। কয়েকটি উল্লেখযোগ্য এ্যালবাম হচ্ছে স্বাধীনতা চাই, মুক্তির প্রত্যাশায়, প্রজন্মের সংগ্রাম, সেøাগান, যোদ্ধা, স্মৃতির কপাট, অ-আ, পাঠশালা, টাকা, প্রমিথিউস ২০০০, প্রমিথিউস আনবাউন্ড ওয়ান ও ছায়াপথ। এগুলোর বেশির ভাগ এ্যালবামের মধ্যে দেশের সমসাময়িক বিভিন্ন সমস্যা ও দেশাত্মবোধক গান রয়েছে।
সামাজিক দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে তাঁরা দেশের সরকারী-বেসরকারী স্কুলে ইংরেজী সংস্করণ চালুর পাশাপাশি কার্যকর শিক্ষাব্যবস্থার ব্যাপারে সবাইকে উদ্বুদ্ধ করার এক কর্মসূচি হাতে নিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে বিপ্লব বলেন, ‘সরকার ছেলেমেয়েদের অবৈতনিক শিক্ষা দেয়ার ব্যবস্থা করেছে। কিন্তু এই শিক্ষা কতটা কার্যকর, তা ভেবে দেখা হচ্ছে না। ঢাকা শহরে সরকারী- বেসরকারী পর্যায়ে অনেক স্কুলেই এখন ইংরেজী সংস্করণ চালু হয়েছে, কিন্তু গ্রামে কিংবা মফস্বলে তা চালু না হওয়ায় ওই ছেলেমেয়েরা পিছিয়ে পড়ছে। এ কারণে ইংরেজী সংস্করণ কর্মসূচীর কাজ শুরু করেছি। ইতোমধ্যে দাদার বাড়ি কুমিল্লার কালীবাজারের একটি স্কুলে প্রথম এই কর্মসূচি শুরু করেছি। রজতজয়ন্তীতে শ্রোতাদের বিশেষ কিছু উপহার দেয়ার জন্যই এ ধরনের প্রজেক্টের সঙ্গে যুক্ত হওয়া।’
বর্তমান লাইনআপ : বিপ্লব (ভোকাল, গিটার), সোহাগ (লিড গিটার), পল্বব (কিবোর্ড), মাইকেল (ড্রামস), রুবেল (ডি জে)।
প্রমিথিউস এবার নিজেদের গানগুলো ইন্টারনেটের মাধ্যমে ফ্রি ডাউনলোড করার সুযোগ করে দিয়েছে ভক্ত ও শ্রোতাদের। এখন থেকে িি.িঢ়ৎড়সবঃযবঁংনফ.পড়স ঠিকানা থেকে বিনা খরচে ডাউনলোড করা যাবে প্রমিথিউসের গান।
বিপ্লব বলেন, ‘বাংলাদেশের অডিওশিল্পে এখন এক ধরনের অস্থিরতা চলছে। পাইরেসিসহ নানা জটিলতার কারণে শিল্পী থেকে শুরু করে প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান। সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পাইরেসির বিরুদ্ধে এক ধরনের প্রতিবাদ হিসেবে আমাদের গান শ্রোতাদের বিনামূল্যে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এখন থেকে শ্রোতারা প্রমিথিউসের নতুন ও পুরোনো যে কোন গান এই ওয়েবসাইট থেকে সংগ্রহ করতে পারবে।’
১৯৮৬ সালের ১৭ জুলাই যাত্রা শুরু করেছিল ‘প্রমিথিউস।’ ২৪ বছর পেরিয়ে পঁচিশের ছায়াপথে হাঁটছে ব্যান্ডটি। শীঘ্রই বাজারে আসছে ব্যান্ডের ১৫তম এ্যালবাম ‘ছায়াপথ’। রবিউল ইসলাম জীবন
শহরের বাংলা মাধ্যমের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে ইংরেজী ভার্সনও যুক্ত হয়েছে। ফলে শিক্ষার্থীরা ইংরেজীতেও বিষয়গুলো জানতে পারে। কিন্তু গ্রামের স্কুলগুলোর ক্ষেত্রে চিত্রটি ভিন্ন। সেখানে শুধু বাংলাই চালু আছে। এ বিষয়টি বেশ নাড়া দেয় প্রমিথিউসকে।
তারা ভাবতে থাকে, এ নিয়ে কাজ করলে মন্দ হয় না। যেমন ভাবা তেমন কাজ। গত ১৭ জুলাই ব্যান্ডের ২৪ বছর পূর্তির দিন থেকে কাজটি শুরু করে দিয়েছে প্রমিথিউস। সেটা কিভাবে? ব্যান্ডের দলনেতা বিপ্লব বললেন, ‘এ বিষয়ে মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে কাজ করছি আমরা। এ জন্য আমরা কয়েকটি এলাকায় গিয়েছিও। কিছু এলাকায় প্রমিথিউস ফ্যান ক্লাবের সদস্যরাও কাজ করছেন। যাঁদের সঙ্গে কথা বললে এ বিষয়ে সফলতা আসতে পারে আমরা তাঁদের সঙ্গেও যোগাযোগের চেষ্টা করছি।’ এমন উদ্যোগ নিতে গেল কেন প্রমিথিউস? ‘আগামী বছর আমাদের ব্যান্ডের ২৫ বছর হচ্ছে। সেই দিন শ্রোতাদের বিশেষ কী উপহার দেয়া যায়, সেটা নিয়ে ভাবতে থাকি আমরা। শেষ পর্যন্ত পরিকল্পনাটি মাথায় আসে। বাস্তবায়ন করতে পারলে ভালই হবে। বলতে পারেন এটি আমাদের সামাজিক দায়বদ্ধতারও একটি অংশ -বললেন বিপ্লব।
নবেম্বরের প্রথম সপ্তাহে সঙ্গীতার ব্যানারে বাজারে আসছে ব্যান্ডটির ১৫তম একক। এখানেও পড়েছে সেই পঁচিশের ছায়া। “২৪ পেরিয়ে ২৫-এ পা দিয়েছে প্রমিথিউস। ২৫-এর ছায়া এসে পড়েছে আমাদের চলার পথে। তাই আমাদের এবারের এ্যালবামের নাম ‘ছায়াপথ’।” বললেন ব্যান্ডের কি-বোর্ডিস্ট পল্বব। এ এ্যালবামে নতুন কী থাকছে? ‘আমরা সব সময়ই সময়ের সঙ্গে চলতে পছন্দ করি। নতুন নতুন ভাবনা যোগ করি গানে। এবারও সেই ধারা বজায় রাখার চেষ্টা করেছি। সব শ্রেণীর শ্রোতাই পছন্দের গান খুঁজে পাবেন এ এ্যালবামে’ বললেন বিপ্লব। এতে গান রয়েছে ১৪টি। গানগুলো হলো ‘স্বপ্নপুরী’, ‘নীলাম্বরী নীল’, ‘অচেনা মুখ-অচেনা শহর’, ‘হায় প্রেম’, ‘যাত্রা ৬/৪’, ‘যাত্রা ৪/৪’, ‘ছায়াপথ’, ‘ঝিরিঝিরি বৃষ্টিতে’, ‘হিপহপ ছেলেপান’, ‘গোধূলি মেঘ’, ‘আয়রে আয় মেঘ’, ‘তুমি চাইলেই’, ‘জিজ্ঞাসা’ ও ‘কাফনের কাপড়ে পকেটে থাকে না।’ শেষের তিনটি গান একটি এককে গেয়েছিলেন বিপ্লব। রিমেক করে ব্যান্ডের এ্যালবামেও রেখেছেন। বিপ্লব বললেন, ‘যাত্রা ৬/৪’ এবং ‘যাত্রা ৪/৪’ গান দুটির কথা একই। তবে সুর ও সঙ্গীতায়োজন ভিন্ন। ‘আয়রে আয় মেঘ’ গানটির সঙ্গীতায়োজন সম্পূর্ণ রাগভিত্তিক। ‘হিপহপ ছেলেপান’ করা হয়েছে শুধু কনসার্টের জন্য। অন্যান্য এ্যালবাম থেকে এটি আলাদা করা হয়েছে। ৯ মাস ধরে এর জন্য খেটেছে প্রমিথিউস দল।
বিপ্লব জানান, ‘কাগজ-কলমে ৯ মাস লাগলেও এটি তৈরি করতে সময় লেগেছে ১৫ মাস। আসলে একটি এ্যালবাম প্রকাশের পর থেকেই আমাদের পরেরটির কাজ শুরু হয়ে যায়।’
সময়ের স্রোতে ভেসে এতটা পথ এগিয়েছে প্রমিথিউস। তবে স্মৃতির পাতায় রয়ে গেছে অনেক কিছুই। ব্যান্ড তৈরির সে সময়টা এখনও বেশ ভাবায় বিপ্লবকে। স্মৃতি হাতড়ে বললেন, ‘প্রমিথিউসের শুরুর দিকটার কথা কখনও ভুলব না। ১৯৮৬ সালের কথা। আরিফ, রেজওয়ান ও সারেক একসঙ্গে গান করতেন। তাঁদের সঙ্গে জ্যামিং করতেন আমার বন্ধু কোয়েল। সে সময় কিউপিড নামে আমার একটি ব্যান্ড ছিল। কোয়েলের মাধ্যমে এক দিন তাঁদের সঙ্গে পরিচয়। সবাই মিলে ভাবতে থাকি একটি ব্যান্ড গড়ার। তারই প্রতিচ্ছবি আজকের প্রমিথিউস।’ অনেক চড়াই-উতরাই পাড়ি দিয়ে প্রমিথিউসের বর্তমান অবস্থান। এ সময়ে ব্যান্ডের লাইনআপেও অনেক পরিবর্তন এসেছে। বিপ্লব বলেন, ‘প্রমিথিউস একটি পরিবারের মতো। সবাই খুব আন্তরিকতা নিয়ে কাজ করে। বিভিন্ন সময় লাইনআপে যেসব পরিবর্তন এসেছে, তা সদস্যদের জীবনের ব্যস্ততার কারণেই হয়েছে। সমঝোতার অভাবে ব্যান্ড ছাড়ার ঘটনা প্রমিথিউসে ঘটেনি। আমাদের ইচ্ছা আছে, ব্যান্ডের ২৫ বছর পালন অনুষ্ঠানে সবাইকে একত্র করার। ব্যান্ডের ২৫ বছর পূর্তি! অথচ গান হবে না এমনটা ভাবার অবকাশ নেই। সেদিন শ্রোতাদের একটি এ্যালবাম উপহার দেবে প্রমিথিউস। যাতে থাকছে প্রমিথিউসের প্রকাশিত গান থেকে সেরা গানগুলো।’ তবে আপাতত ‘ছায়াপথ’কে ঘিরেই প্রমিথিউসের সব ভাবনা।

No comments

Powered by Blogger.