খোঁড়াখুঁড়ি যানজট আর চলাচলের অযোগ্য সড়কের নেপথ্যে by ফিরোজ মান্না

যানজটের নগরী রাজধানী ঢাকার রাস্তাঘাট ওয়াসার খোঁড়াখুঁড়িতে চলাচলের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। রাস্তাঘাট খোঁড়াখুঁড়িতে বেহাল দশার মাত্রা বহুগুণ বাড়িয়ে তুলেছে। নগর জীবনের এই দুঃসহ যন্ত্রণা বহন করতে করতে নগরবাসী এখন চরম ত্যক্তবিরক্ত হয়ে পড়েছেন।


রাস্তা খোঁড়াখুঁড়িতে যানবাহন থেকে শুরু করে নগরবাসীর ভোগান্তির সীমা ছাড়িয়ে গেছে। নগরীর ছোট বড় বহু রাস্তায় চলছে ওয়াসার ড্রেন বসানোর কাজ। কোন কোন সড়কের মাঝখান দিয়ে বিরাট খাল কেটে বসানো হচ্ছে সিমেন্টের তৈরি বিশাল বিশাল পাইপ। ড্রেন বা পানির পাইপ স্থাপনের প্রতিটি কাজেই রয়েছে ধীরগতি। অভিযোগ রয়েছে, পছন্দের ঠিকাদারকে কাজ দেয়ায় তারা সঠিক সময়ে কাজ শেষ করছে না। এ ক্ষেত্রে ওয়াসার তদারকির অভাব রয়েছে। সঠিক তদারকি থাকলে এপ্রিলের মধ্যেই ড্রেন ও পানির পাইপ নির্মাণ কাজ শেষ হতো।
ওয়াসার চেয়ারম্যান মোহাম্মদ রহমতুল্লাহ জনকণ্ঠকে বলেন, আমাদের দেশের দুর্ভাগ্য যখন কাজ করার সময় তখন কাজ হয় না। কাজগুলো অক্টোবর থেকে মার্চ মাসের মধ্যে শেষ করতে পারলে কাজের মান এখনকার তুলনায় অনেক বেশি ভাল হতো। দ্রুত কাজ শেষ করা যেত; মানুষের ভোগান্তিও কম হতো। অক্টোবর থেকে মার্চ এই ৬ মাস কাজÑবাকি ৬ মাস পরিকল্পনা করা হবে। এটা বলে কোন লাভ নেই। কারণ এভাবেই চলে আসছে যুগের পর যুগ। আমি সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোকে নির্দেশ দিয়েছি কোথায় কোথায় কাজ হচ্ছে। আমি নিজে বিভিন্ন ‘সাইট ভিজিট’ করেছি। তিনটি সংস্থার টাকায় ড্রেন নির্মাণ কাজ চলছে। এখানে সরকারের একটি অংশ, এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক ও বিশ্বব্যাংকের টাকা রয়েছে। ঠিকাদাররা মানুষের ভোগান্তি বাড়িয়ে কাজের গতি কমিয়ে কাজ করবে তা মানা হবে না। দ্রুত কাজ শেষ করার ব্যবস্থা নেয়া হবে।
ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী তাকসিম এ. খান জনকণ্ঠকে জানান, ঢাকা ওয়াসা গত ৩১ মের পরে নগরীর কোন রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি করছে না। তবে দু’প্রকল্পের কাজ চলছে। এ প্রকল্প দু’টির কাজ করছে বিদেশী প্রতিষ্ঠান। একটি হচ্ছে সায়েদাবাদ ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্রজেক্ট-২-এর ৫ কিলোমিটার পানির পাইপলাইন বসানোর কাজ। এ কাজটি বাস্তবায়ন হচ্ছে এডিবির অর্থে। আরেকটি প্রকল্প চলছে ‘ট্রেন্স লেস’ পদ্ধতিতে (রাস্তা না কেটে)। এ কাজটিও চলছে এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের (এডিবি) অর্থে। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করতে চার বছর সময় লাগবে। সায়েদাবাদ ফ্লাইওভারের ‘র‌্যাম’ তৈরির জন্য যাত্রাবাড়ীতে অল্প কিছু জায়গায় পাইপলাইন স্থাপন করার কাজ করা হয়েছে। সেটিও সোমবার শেষ হয়েছে। এক প্রশ্নের জবাবে ওয়াসার এমডি বলেন, তেজগাঁও থেকে গুলশান লিঙ্ক রোডে ওয়াসা কোন কাজ করছে না। এটা অন্য কোন সংস্থার কাজ হতে পারে। তাছাড়া এ রোডের পাশ দিয়েই হাতিরঝিল প্রকল্পের কাজ হচ্ছে। তেজগাঁওতেও ওয়াসা কোন কাজ করছে না। গুলশান-২ নম্বর এলাকায় ওয়াসার কাজ হলেও তিনি তা স্বীকার করেননি। ৩১ মের পরে ঢাকা ওয়াসা নগরীর এক ইঞ্চি সড়কও খোঁড়াখুঁড়ি করেনি। নগরবাসীর ভোগান্তির কথা মাথায় রেখে এমন সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
এদিকে রাজধানীর বাংলামোটর, মোহাম্মদপুর, মিরপুর, রোকেয়া সরণি, শ্যামলী এলাকার মানুষ রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ির দীর্ঘ ভোগান্তির হাত থেকে মুক্তি পেয়েছে। বর্তমানে রামপুরা, গুলশান-২, তেজগাঁও থেকে গুলশান লিঙ্ক রোড, প্রগতি, মগবাজার, মৌচাক, মালিবাগ শাহজাহানপুর এলাকার বিভিন্ন স্থানে চলছে রাস্তা কাটা, নতুন পাইপড্রেন স্থাপন বা প্রতিস্থাপনের কাজ। এ নির্মাণযজ্ঞের কারণে মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা অচল হয়ে পড়েছে। যে রাস্তা ৩০ মিনিটে বাড়ি ফেরা যেতÑসেখানে এখন দেড় থেকে দুই ঘণ্টা সময় যানবাহনে বসে থেকে মানুষজনকে বাড়ি ফিরতে ও কর্মক্ষেত্রে যেতে হচ্ছে। একদিকে রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি, অন্যদিকে রাস্তার ওপর ময়লা-আবর্জনা ফেলে মানুষের ভোগান্তি আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ির মাটি সামান্য বৃষ্টি হলেই কাদায় ভরে যাচ্ছে, আবার রোদ হলে ধুলাবালিতে একাকার হয়ে যাচ্ছে পুরো এলাকা।
ঢাকা ওয়াসার ড্রেনেজ সার্কেল প্রকল্পের এক কর্মকর্তা বলেন, পাইপ বসানোর জন্য কোন জায়গা খুঁড়লেই মুহূর্তের মধ্যে গাড়ি এসে মাটি ছড়িয়ে ফেলে। আমরা চেষ্টা করি কোন জায়গায় মাটি যাতে না থাকে। কিন্তু এ ধরনের খোঁড়াখুঁড়িতে কিছু খোয়া-রাবিশ তো ওঠে। পরে সেগুলো কাটা জায়গায় দিতে হয়। পরে সেখানে আবার রাস্তা করতে হয়। এ জন্য খোঁড়ার পর মাটি সরিয়েও নেয়া যায় না।
ওই কর্মকর্তা বলেন, কাজ শেষ করতে সময় লাগার কারণ হচ্ছেÑনিয়ম অনুযায়ী বর্তমানে ডিসিসি যে কোন রাস্তা কাটার জন্য এক মাসের বেশি সময় দিতে পারে না। কিন্তু ২শ’ মিটার রাস্তা কাটাও কোনভাবে এক মাসে সম্ভব নয়। একটি জায়গা ঢালাই দিয়ে সেটা ২১ দিন রাখতে হয়। এর আগে ওই ঢালাই এলাকায় চাপ পড়লে তা নষ্ট হয়ে যায়। এ জন্য পরে আবার আবেদন করে সময় বাড়িয়ে নিয়ে কাজ করতে হয়। অবশ্য ঢাকা সিটি কর্পোরেশন (ডিসিসি) রাস্তা কাটার অনুমতি দেয়ার সময় দিনে-রাতে কাজ করার বিষয়টি বলে দেয়। বাস্তবে দিনে-রাতে নানা কারণে কাজ করা সম্ভব হয় না। দেখা যায় ২০-২২ ফুট গভীরে রাতের বেলা কাজ করা সম্ভব হচ্ছে না। কাজের সময় বাড়িয়ে দিয়ে রাতের বেলায় কাজের শর্ত শিথিল করে দিলে ভাল হতো। এপ্রিল মাসের মধ্যে ড্রেনেজের সকল কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু মে মাসের মাঝামাঝি সময়েও কাজের ৭০ শতাংশ শেষ করতে পারেনি ঢাকা ওয়াসা। ড্রেনেজের কাজ করতে একটু বেশি সময় লেগে যায়। কারণ পুরনো ড্রেন প্রতিস্থাপন করতে পানি উঠলে কাজ করা জটিল হয়ে পড়ে। তখন কাদা মাটি কেটে উপরে তোলা হয়। শুকনো মাটি কেটে তোলা যতটা সহজÑকাদা মাটি কেটে তোলা অতটা সহজ নয়। কাদা মাটি কেটে তুলতে বেশি সময়ের প্রয়োজন হয়। তাই কাজের গতি স্বাভাবিকভাবেই কমে যায়।
এ বছরের ২৩ ফেব্রুয়ারি স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে এক বৈঠকে বলা হয়, সরকারের বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে সমন্বয় না থাকায় রাজধানীর রাস্তাঘাট কাটাকাটি করা হচ্ছে। যত্রতত্র রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি, ড্রেনেজ ব্যবস্থা নিয়ে ওয়াসা ও সিটি কর্পোরেশনের মধ্যে ঠেলাঠেলিসহ বিভিন্ন কাজে সমন্বয় না থাকায় এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক সিটি কর্পোরেশন, সড়ক বিভাগ, রাজউক, ওয়াসা, এলজিইডিসহ সরকারের বিভিন্ন সংস্থার প্রতিনিধিদের নিয়ে জরুরী বৈঠক করে রাস্তা কাটাকাটির কাজ ৩০ এপ্রিলের মধ্যে শেষ করার কঠোর নির্দেশ দিয়েছিলেন। তিনি ওই বৈঠকে রাজধানীর ড্রেনেজ ব্যবস্থা নিয়ে একটি মাস্টারপ্ল্যান করার সিদ্ধান্ত দেন। মাস্টারপ্ল্যান না করলে প্রতিবছর রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি চলতেই থাকবে। নগরবাসীর কষ্ট লাঘবের জন্য কোন অবস্থাতেই মানুষের দুর্ভোগ বাড়ানো যাবে না। শুরু হওয়া কাজ দ্রুত শেষ করতে হবে। পরে অবশ্য সময়সীমা বাড়িয়ে ৩১ মে পর্যন্ত রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ির কাজ করার অনুমতি দেয়া হয়।
মন্ত্রীর এই নির্দেশের পরেও রাস্তা কাটাকাটি থেকে মুক্তি পায়নি নগরবাসী। রাজধানীতে আবর্জনাই নয়, অনেক এলাকায় পানি ও স্যুয়ারেজের লাইন এক হয়ে যাচ্ছে। ফলে গ্রাহকদের বাসায় পানির লাইনে ঢুকে পড়ছে স্যুয়ারেজের ময়লা। পানি হয়ে পড়ছে দুর্গন্ধ। এ কারণে নগরীর বিভিন্ন এলাকার বাসিন্দারা পেটের পীড়াসহ নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন।
ডিসিসি সূত্র জানিয়েছে, ২০১৫ সালের মধ্যে রাজধানীতে দক্ষ বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম গড়ে তুলতে ২০০০ সাল থেকে কাজ করে যাচ্ছে জাপানী সাহায্য সংস্থা জাইকা। এ জন্য জাইকা ডিসিসির প্রকৌশল, পরিবহন, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা শাখাকে একীভূত করার পরামর্শ দেয়। কিন্তু ডিসিসি এখনও তা কার্যকর করেনি। ফলে জাইকা বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় সহায়তা বন্ধ করতে শুরু করেছে। ইতোমধ্যে ১৮ কোটি টাকার বরাদ্দ স্থগিত করেছে।

No comments

Powered by Blogger.