পৌষ দিয়ে মুছে যাক সব শঙ্কার মেঘ, উৎসবের আমেজ-রমনায় পৌষমেলা আজ শেষ by সৈয়দ সোহরাব

পৌষের হাড় কাপানো শীত এখন জেঁকে বসেছে রাজধানী জুড়ে। সকাল-সন্ধ্যা তো আছেই ভর দুপুরেও শীত বস্ত্র পরে চলা ফেরা করতে হচ্ছে নগরবাসীকে। দিনের অধিকাংশ সময় কুয়াশা ঢেকে রাখছে সূর্যকে। তবে বছরের প্রথম দিন শুক্রবারের ভোরটি ছিল একটু অন্যরকম। কুয়াশা তেমন ছিল না।


কিন্তু হিমেল হাওয়া ছিল যা ঘর থেকে বের হয়ে আসা মানুষদের ভুগিয়েছে বেশ। অবশ্য হিমেল হাওয়ার এমন শীতে অত ভোরে স্বাস্থ্য সচেতন মানুষ ছাড়া কেউ আসেন না ঘর ছেড়ে। তবে শুক্রবারের ব্যাপারটি ছিল একটু আলাদা। এদিন কাকডাকা ভোরে ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছিল সংস্কৃতিকমর্ীরা। কারণ বাঙালীর অসাম্প্রদায়িক উৎসবগুলোর একটি পৌষ মেলা ছিল এদিন। রমনার বটমূলে যখন তারা (সংস্কৃতিকমর্ীরা) এসে পেঁৗছে তখনও পূর্বাকাশে সূর্যের দেখা নেই। ভোরের আভায় পাখিদের কলকাকলিতে মুখর রমনা চত্বর। মানুষের উপস্থিতি টের পেয়ে পাখিদের কোলাহল যেন আরও বেড়ে যায়। গ্রামাঞ্চলে সাধারণ মানুষ যেমন আইলায় কাঠ কয়লার আগুন জ্বালিয়ে শরীর উষ্ণ করেন, তেমনি নিজেদের উষ্ণ করতে এবং পৌষ মেলার উদ্বোধনের জন্য আইলায় আগুন জ্বালানোর আয়োজনে ব্যসত্ম হয়ে পড়ে সংস্কৃতিকমর্ীরা।
নির্ধারিত সময় সকাল সাড়ে ৭টায় মেলা উদ্বোধন হওয়ার কথা থাকলেও সাউন্ড সিস্টেমের ত্রম্নটির কারণে দেরি হয় এক ঘণ্টা। ইতোমধ্যে পূর্বাকাশে উদিত নতুন বছরের প্রথম সূর্য আলো ছড়াতে থাকে পার্কজুড়ে। কনকনে শীতে এই পরশ মাখানো নতুন আলোর উষ্ণতা যখন হাজারো সংস্কৃতিপ্রেমী মানুষ গায়ে মেখে নিচ্ছিল, তখনই মঞ্চ থেকে ভেসে আসে সঙ্গীতের সুর ওই ওই সে দোলায় হিমেল হাওয়ার হাত ছানি ... এবং নজরম্নলের গান পৌষ এলো গো পৌষ এলো...। নিবেদনের শিল্পীদের সমবেত কণ্ঠে এ দুটি গান দিয়েই শুরম্ন হয় এবারের দু'দিনব্যাপী পৌষ মেলা। এ দু'টি গান পরিবেশনের পরেই প্রসন্ন ভোরে উৎসবের আমেজ ছড়িয়ে পড়ে রমনা চত্বরজুড়ে। ঘড়ির কাঁটা যতই ঘুরতে থাকে মেলা প্রাঙ্গণে সংস্কৃতিপ্রেমীদের ভিড় বাড়তে থাকে। বছরের প্রথম দিন, তার ওপর শুক্রবার হওয়ায় শীতকে উপেৰা করে অনেকেই পুরো পরিবার নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে বাঙালীর অসাম্প্রদায়িক উৎসব পৌষ মেলায় শামিল হতে। গান আর আবৃত্তির পরিবেশনায় মেলা যখন বেশ জমে উঠেছে তখন গরম গরম পিঠা ও চায়ে চুমুক দিয়ে নিজেদের আরও উষ্ণ করে নিচ্ছিলেন উৎসবে আগত সঙ্গীতপ্রেমীরা। পৌষের পুরো আমেজ দিতেই মেলা প্রাঙ্গণে পিঠা পুলির আয়োজন নিয়ে বসেছিল গোটা ১৫ স্টল। এসব স্টলে শুধু পিঠাই নয় আরও ছিল নানা ধরনের ফুড প্রোডাক্ট, মধু বুটিকের পোশাক ইত্যাদি। গরম গরম ভাপা ও চিতই পিঠা ছাড়াও স্টলগুলোতে আরও ছিল পাটিসাপটা পিঠা, পাকান পিঠা, ফুল পিঠা, নারকেল পিঠা, রস পিঠা, ইত্যাদি। এ ছাড়া যারা ভোরে এসেছিল তারা খেজুরের রসের স্বাদও গ্রহণ করতে পেরেছিল। রস ও পিঠা পুলির স্বাদ গ্রহণ করতে করতে উৎসবে আগত অতিথিরা স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পী শাহীন সামাদের কণ্ঠে শোনেন ধরার প্রিয় কেন এলে অবহেলে হিমেল বায়... গানটি, আর আয়োজক পৌষ মেলা উদ্্যাপন পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য সচিব ডালিয়া নওশিনের কণ্ঠে ওই মহা সিন্ধুর ওপার থেকে কি সঙ্গীত ভেসে আসে...গানটি। এর পরই দলীয় পরিবেশন নিয়ে আসে বহ্নিশিখা ও সত্যেন সেন শিল্পী গোষ্ঠী। বহ্নিশিখার শিল্পীরা পরিবেশন করে আগুন জ্বালাইস না আমার গায়... গানটি। ভোরের অধিবেশনে একক কণ্ঠে আরও গান গেয়ে শ্রোতাদের মুগ্ধ করেন খ্যাতিমান শিল্পী সুবীর নন্দী, শাম্মী আক্তার, নার্গিস চৌধুরী, পান্না বিশ্বাস, সঞ্জয় রায়, সুমনা দাস, মাফিয়া রহমান প্রমুখ। তারা একে একে গেয়ে শোনান পৌসের কাছাকাছি রোদ মাখা সেই দিন..., আমার গানের অস্থায়ী আমার বাংলাদেশটা..., এই বাংলার শ্যামলী মাটি ভোরের শিশির ভেজা..., জাগাও পথিকে ও সে ঘুমে অচেতন..., ফিরে চল ফিরে চল আপন ঘরে..., মধুমালতী ডাকে আয়..., তোমার বুকের ফুলদানিতে... প্রভৃতি গান।
ভোরের অধিবেশনের পর বেলা দশটার দিকে উৎসবের উদ্বোধনের আয়োজন করা হয়। ৬টি ঢাকঢোলের মধ্যে তালে তালে শাশ্বত বাংলার সেই চিরায়ত নিয়ম আইলায় আগুন জ্বালিয়ে পৌষ মেলার উদ্বোধন করেন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব শিল্পী মুসত্মাফা মনোয়ার। এ সময় সুকানত্মের হে শীতের সূর্য কবিতাটি আবৃত্তি করেন রফিকুল ইসলাম। হে শীতের সূর্য দাও শূন্যতারে পূর্ণ করি সেস্নাগান নিয়ে আয়োজিত দু' দিনব্যাপী এই মেলায় ঘোষণাপত্র পাঠ করেন আয়োজক পরিষদের বর্তমান সদস্য সচিব বিশ্বজিৎ রায়। পৌষ নিয়ে আরও আলোচনা করে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সাধারণ সম্পাদক গোলাম কুদ্দুছ, শিল্পকলা একাডেমীর সঙ্গীত ও নৃত্যকলা বিভাগের পরিচালক মাহমুদ সেলিম, সুবীর নন্দী, ডালিয়া, নওশিন প্রমুখ। মুসত্মাফা মনোয়ার বলেন, বাংলাদেশ মূলত কৃষিপ্রধান দেশ। কৃষককে নিয়েই আমাদের জীবন গড়ে উঠেছে। কিন্তু আজ সেই কৃষককেই আমরা ভুলতে বসেছি। কৃষকের আনন্দ উৎসবকে ভুলতে বসেছি। তাই নতুন প্রজন্মের কাছে আমাদের অতীতকে, আমাদের ঐতিহ্যকে তুলে ধরতে হবে। তাদের শেকড়ের সন্ধান দিতে হবে। দেশের সকল শঙ্কার মেঘ যেন পৌষ দিয়ে মুছে যায় এমন আহ্বান জানিয়ে গোলাম কুদ্দুছ আরও বলেন, যুদ্ধাপরাধীরা এখনও সক্রিয়। তাদের তৎপরতা আমাদের রম্নখতে হবে এবং শীঘ্র তাদের বিচার নিশ্চিত করতে হবে। তিনি আরও বলেন, বাঙালীর হাজার বছরের সংস্কৃতির অসাম্প্রদায়িক উৎসবগুলোর অন্যতম হলো পৌষ মেলা। এ উৎসবে বাঙালী নানা আনন্দে মেতে ওঠে। কিন্তু নগর সভ্যতার কারণে আমরা তা ভুলতে বসেছি। নতুন প্রজন্ম পিঠা পুলির বদলে হটডগ, ফাস্টফুডে অভ্যসত্ম হয়ে পড়ছে। কিন্তু এটা ভুললে আমাদের চলবে না, দু'-এক পুরম্নষ আগে আমরা সবাই গ্রামে ছিলাম। তাই নতুন প্রজন্মকেও শেকড়ে যেতে শেখাতে হবে।
বিকালের অধিবেশনে গান, আবৃত্তির পাশাপাশি আরও পরিবেশিত হয় নাটক ও যাত্রা। নাটক পরিবেশন করে সংলাপ নাট্য গোষ্ঠী। সন্ধ্যায় যাত্রাপালা লাইলী মঞ্জু পরিবেশন করে কৃষ্ণবীণা অপেরা। আজ শনিবার পৌষ মেলার সমাপনী সন্ধ্যায় তারা মঞ্চায়ন করবে যাত্রাপালা গুনাই বিবি। আজও সকাল সাড়ে সাতটায় গানের মাধ্যমে শুরম্ন হবে মেলার আয়োজন। আজকের সকালের আয়োজন সরাসরি সম্প্রচার করবে আরটিবি। উদ্বোধনী দিনের সকালের অধিবেশন সরাসরি সম্প্রচার করে চ্যানেল আই। আর পুরো অনুষ্ঠানটি স্পন্সর করেছে ডেসটিনি।

No comments

Powered by Blogger.