পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি-নারীর অধিকার না সস্তা শ্রম—কোনটা বিবেচ্য? by সুলতানা কামাল

বাংলাদেশ যে একটি বিচিত্র দেশ, এ উক্তিটির যেমন ভালো দিক আছে, আবার মন্দেরও। যিনি উক্তিটি করছেন, তাঁর খেদেরও একটা ইঙ্গিত পাওয়া যায়। নানা ধর্মের, নানা বর্ণের, নানা বিশ্বাসের, নানা রুচির এই দেশ। এখানে প্রকৃতি যেমন বৈচিত্র্যময়, মানুষও নানা মতের, নানা পথের। তাই হঠাৎ করে চমকে ওঠার মতো অনেক ঘটনা ঘটে, অনেক


কথা শোনা যায়। চমকগুলো আলোচনায় আসে, আবার তলিয়ে যায় নতুন চমকের জোয়ারে। এর পরও হঠাৎ হঠাৎ একেকটি সংবাদ এমন আঘাত হানে যে স্তব্ধ হয়ে যেতে হয়—মনের গভীরে আস্থার জায়গাটা টলে ওঠে। এমনই একটা খবর এল ১০ জুলাইয়ের সংবাদপত্র মারফত। একটি দৈনিকে খবরটি পেলাম এভাবে, ‘মাতৃত্বকালীন ছুটি বাড়ালে জন্মহার বাড়বে।’ পরের লাইনে, যাকে সাব-হেডিং বলে তাতে লেখা, ‘মনে করে বিজিএমইএ’। এ রকম একটি বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় কী বলা যায়?
বিষয়টি বোঝার জন্য আবারও খবরটা মন দিয়ে পড়লাম। দেখলাম, সত্যি সত্যিই বাংলাদেশ তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতি, সংক্ষেপে যাদের বিজিএমইএ বলে অভিহিত করা হয়, তারা এ কথা বলেছে। একটু হোঁচট খেতেই হলো। সেই কবে—নারীর অধিকার, নারীর মুক্তি, নারীর ক্ষমতায়ন নিয়ে কাজ শুরু করেছিলাম। আজ থেকে প্রায় ৪০ বছর আগে, তখন থেকে নিরবচ্ছিন্নভাবে একটি উপলব্ধি ঘুরেফিরে আসে যে নারীর অধিকার, নারীর মুক্তি বা নারীর ক্ষমতায়নের বিপক্ষ শক্তি হচ্ছে হয় রক্ষণশীল মৌলবাদী গোষ্ঠী, না হলে সাধারণ শিক্ষাবঞ্চিত মানুষ।
শিক্ষার আলো পেয়েছে, সমাজে এমন স্তরে পৌঁছে গেছে যে তারা মোটামুটি গণ্যমান্য বলে পরিচিতি লাভ করেছে—এমন মানুষেরাও যে এ ধরনের উক্তি করতে পারে, সেটা অসম্ভব বলে ধরে না নিলেও চিন্তার বাইরেই ছিল। কিন্তু আবার বেশ ভালোভাবেই সেই বিভ্রান্তিতে ধাক্কা লাগল। বিজিএমইএর এই কথাগুলো নতুন করে মনে করিয়ে দিল, নারীর অধিকারের ক্ষেত্রে সমাজের অতি উচ্চ স্তরে যাঁরা বসে মানুষের জীবন নিয়ন্ত্রণের কলকাঠি নাড়ছেন, তাঁদের অনেকেরই মানসিকতার সঙ্গে শিক্ষা বা প্রগতির বার্তা যাঁদের কাছে তেমনভাবে পৌঁছেনি কিংবা জোর করে ভয়ের শাসন দিয়ে যাঁরা নারী প্রগতি ঠেকিয়ে রাখতে চান, তেমন মানুষের মানসিকতার কোনো পার্থক্য নেই।
আর বোঝা গেল, বিজিএমইএতে তাঁদেরই প্রভাব মুখ্য। কারণ, পত্রিকায় প্রকাশিত মন্তব্যটি বিজিএমইএর বক্তব্য হিসেবেই এসেছে—কারও একক বক্তব্য নয়। এ ধরনের উক্তিতে দুঃখিত বোধ করলেও হয়তো বিস্মিত হওয়ার কোনো কারণ নেই। বস্তুত নারী নিজে যতই নিজের অধিকার ও মর্যাদা সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠুক না কেন, সমাজের অধিকাংশ ব্যক্তিই তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে নিজেকে গড়ে তুলতে সক্ষম হয়নি। এ কারণে তাদের মানসিকতা রয়ে গেছে সেই শত বছরের আগের সময়ের বাসিন্দাদের মতো, যাদের কাছে নারীর শ্রমের সর্বোচ্চ ব্যবহারটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তাদের কথায় মনে পড়ে গেল ২০-২২ বছর আগে অত্যন্ত রক্ষণশীল বলে পরিচিত একটি রাজনৈতিক দলের একজন নেতৃত্বস্থানীয় নারী নেত্রীর কথা, যিনি তাঁদেরই নিজস্ব পত্রিকার কলামে লিখেছিলেন, ‘নারীর বিবাহবিচ্ছেদের অধিকার সহজ করে দিলে তারা ঘণ্টায় ঘণ্টায় তালাক দেবে।’
আর আজকে ২০১২ সালের শেষার্ধে একদল ব্যবসায়ী বলছেন, নারীর মাতৃত্বকালীন ছুটি ছয় মাস করলে জন্মহার বেড়ে যাবে! নারীর প্রতি একই দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন! আর এর গভীরে রয়েছে পিতৃতান্ত্রিক চিন্তাধারা, যা ক্রমে পুরুষতান্ত্রিক চিন্তাধারায় রূপ নিয়েছে তারই প্রভাব, যেখানে নারীকে শুধু একটি নির্দিষ্ট ভূমিকার আলোকে চরিত্রায়ণ করা হয় এবং পাকাপোক্তভাবে এ কথা প্রতিষ্ঠা করা হয় যে নারীর কোনো রকম স্বাধীন চিন্তা, বিবেচনা বা সুচিন্তিত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার ক্ষমতাই নেই। তাঁকে কোনো রকম সুযোগ বা ক্ষমতা দিলেই এর অপব্যবহার ঘটতে বাধ্য। তাই বিজিএমইএর কর্তারা ভাবছেন, নারীকে এই ছয় মাস সময়টুকু সবেতন ছুটি দিলে তাঁরা ঘরে বসে সেই বেতনটুকু (সাকল্যে বোধ হয় মাসিক সাড়ে তিন হাজার টাকাও নয়) নেওয়ার জন্য শুধুই সন্তানের জন্ম দিতে থাকবেন! নারীর তো আর কোনো বিবেক-বুদ্ধি নেই, শুধু কিছু পয়সার লোভে কাজ করতে আসে। অতএব বসে বসে পয়সাটুকু পেলে সন্তান জন্ম দেওয়া তো নারীর পক্ষে কিছুই নয়! এর পরে আর কিছু কি বলার থাকে?
বুঝতে অসুবিধা হয় না, কেন মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশে, মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তি বলে দাবিদার রাজনৈতিক জোটের সরকারের আমলেও সর্বোচ্চ নেতৃত্বে নারী অধিকারের প্রতি আন্তরিক অঙ্গীকার থাকা সত্ত্বেও নারী নীতি নিয়ে এত বিড়ম্বনা। কেন এখনো গ্রামগঞ্জে নির্মম, নিষ্ঠুর সালিস বসিয়ে মেয়েদের সাজা দিতে এত উৎসাহ, কেন সর্বতো চেষ্টা সত্ত্বেও নারীর প্রতি যৌন হয়রানি রোধ করা এত কষ্টসাপেক্ষ! কারণ, এখনো নারীকে তাঁর নিজের অধিকারে, নিজের মর্যাদায় সমাজে সম-অবস্থানে দেখতে রাজি নন অনেকে। যাঁরা নিঃশর্তভাবে নারীর শ্রম, নারীর সেবা, নারীর আনুগত্য, নারীর জীবনের ওপর তাঁদের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ পেতে অভ্যস্ত, তাঁরা যে এ ধরনের কথা ভাববেন, বিশ্বাস করবেন এবং বলবেন, তাতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। আর এ ক্ষেত্রে যাঁরা নারীর অধিকার, মর্যাদার বিপক্ষে বুদ্ধিহীনতাকে দাঁড় করিয়েছেন, তাঁরা তো তাঁদের জীবিকা অথবা কঠিন করে বললে, মুনাফা অর্জনের জন্য নারীর ‘সস্তা শ্রম’-এর ওপরই নির্ভরশীল।
সে জায়গায় কোনো পরিবর্তন তাঁরা সহজে মেনে নেবেন কেন? তাঁরা প্রায়ই দাবি করেন যে এ দেশে তাঁরাই নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের পথ উন্মুক্ত করে দিয়েছেন। কথাটার মধ্যে এটুকু সত্যতা আছে যে তাঁরা ব্যবসা খুলে যেহেতু নারীকে সেখানে কাজ করার সুযোগটা এনে দিয়েছেন, নারীরা অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে একটা স্থান করে নিতে পেরেছেন। তবে তাঁরা নিজের কাছে নিজে এই প্রশ্নের উত্তরটা কি দেবেন যে যদি নারীদের পুরুষের তুলনায় বেশি পারিশ্রমিক দিতে হতো অথবা এত নিম্ন মজুরিতে নিয়োগ দিতে না পারতেন, কিংবা সাধারণভাবে নারীর যদি একটি অনুগত শক্তি হিসেবে পরিচিতি না থাকত, তাহলেও কি তাঁরা নারীদের এই সুযোগটুকু দিতেন? নারীদের সুযোগ দেওয়া কি নারীর অধিকার ও মর্যাদার প্রতি সম্মানবোধ থেকে আসে না? তা শুধুই কি নিজেদের মুনাফাকে সর্বোচ্চ পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া?
নারীর স্বাধীন সত্তা, তাঁর মর্যাদা ও বোধবুদ্ধির ওপর কোনো রকম সম্মানবোধ থাকলে আমার মনে হয় না তাঁরা এমন একটি বক্তব্য দিতে পারতেন। তাঁরাই সমাজের নীতিনির্ধারকদের সবচেয়ে কাছের মানুষ। তাঁদের প্রভাব, তাঁদের হুমকি, তাঁদের চাপ দেওয়ার ক্ষমতা সমাজের অন্য যেকোনো গোষ্ঠীর শক্তির তুলনায় বেশি। এর প্রতিফলন তো আমরা প্রতিনিয়ত নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের বাজারে, চলাচল ব্যবস্থায় ও জীবনযাপনের ক্ষেত্রে—যেখানেই বাজারের ওপর নির্ভরশীল, সেখানেই হাড়ে হাড়ে টের পাই। তবে এবার দেখতে পেলাম, শ্রমসচিব বেশ স্পষ্টভাবেই বলেছেন, বিজিএমইএর যুক্তি বাজে যুক্তি। নারীর অধিকারের প্রশ্নে সব ক্ষেত্রে সরকারের নীতিনির্ধারক ও আমলা স্তরে এই দৃঢ়তা যদি বজায় থাকে ও কার্যকর হয়, তাহলে অবশ্য আশার আলোটুকু নিভে যাওয়ার ভয় থাকে না।
সুলতানা কামাল: আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) নির্বাহীপরিচালক এবং সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা।

No comments

Powered by Blogger.