উপকূল নিয়ে ভাবনা by মঈনুল আহসান মুন্না

'ধান, নদী, খাল এই তিনে বরিশাল'_ প্রবাদটি দীর্ঘকাল ধরে প্রচলিত হলেও বর্তমান সময়কালে বলতে হচ্ছে নদী, খাল থাকলেও বরিশাল ধানের উৎপাদনের জন্য আর বিখ্যাত নয়। খাদ্য উৎপাদনের দিক থেকে পিছিয়ে পড়ে বরিশাল বিভাগ ব্যাপক খাদ্য ঘাটতির এলাকা হিসেবে চিহ্নিত।


এ অঞ্চলে পতিত জমির পরিমাণ মোট জমির ৪০ থেকে ৪৫ শতাংশ। আবার আবাদি জমির অধিকাংশই একফসলি। অর্থাৎ এ যাবৎ উন্নয়নের ছোঁয়া বরিশাল বিভাগে আলোড়িত করতে পারেনি। তাই এমডিজির লক্ষ্য অর্জনে ক্ষুধা ও দারিদ্র্য নির্মূলে সারাদেশ যখন হাঁটি হাঁটি পা পা করে হলেও এগোচ্ছে, দারিদ্র্যের হার ক্রমান্বয়ে কমিয়ে আনতে পারছে, তখন বরিশাল বিভাগের ওপর দারিদ্র্যের বোঝা ৫২ দশমিক ১৬ শতাংশ (এপ্রিল ২০১০ পর্যন্ত)।
জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকিতে অবস্থান করছে দক্ষিণাঞ্চলের উপকূলীয় জেলাগুলো। বাংলাদেশের মোট ভূখণ্ডের ১৭ শতাংশ; অর্থাৎ উপকূলের সব জেলা সমুদ্রপৃষ্ঠের পানির উচ্চতা বৃদ্ধি পাওয়ার ৪০ বছরের মধ্যে তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কার কথা বলা হচ্ছে। পাশাপাশি বলা হচ্ছে, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে সিডর-আইলার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের পরিমাণ বেড়ে যাবে। এ অঞ্চলের মানুষের স্বাস্থ্যগত সমস্যা দেখা দেবে। বিভিন্ন চর্মরোগসহ স্বাস্থ্যহানি ঘটবে। এসব মোকাবেলায় স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ জরুরি।
পিছিয়ে পড়া অবস্থা কাটিয়ে উঠতে অবিলম্বে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। এর মধ্যে রয়েছে পতিত জমিকে আবাদযোগ্য করা। একফসলি জমি একাধিক ফসলি জমিতে পরিণত করা, লবণাক্ততাসহিষ্ণু বীজ উদ্ভাবন করে তা ব্যবহারে কৃষককে উদ্বুদ্ধ করা, পর্যাপ্ত বহুমুখী সাইক্লোন শেল্টার নির্মাণ, ভোলা থেকে শুরু করে বরগুনা, পটুয়াখালী, পিরোজপুর, বাগেরহাট, খুলনা, সাতক্ষীরা জেলার উপকূলকে ঘিরে এক কিলোমিটার ব্যাসার্ধের বনাঞ্চল গড়ে তোলা এবং দারিদ্র্য কাটিয়ে উঠতে সরকার গৃহীত সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর বলয় বৃদ্ধি করা।
উপকূলকে নিয়ে সম্ভাবনার যে নতুন দিক ভাবা যেতে পারে তা হলো_ বরিশাল, কুয়াকাটা, সুন্দরবনকে ঘিরে পর্যটনবলয় সৃষ্টি করা। বরিশাল থেকে কুয়াকাটা সড়ক সংস্কার দরকার। নদীপথে বরিশাল থেকে কুয়াকাটা, কুয়াকাটা থেকে সুন্দরবন, সুন্দরবন থেকে পুনরায় বরিশালে ফিরে আসতে মিনি জাহাজে ভ্রমণের এই প্যাকেজ ট্যুর পর্যটনের জন্য একটি মাইলফলক হতে পারে। কুয়াকাটায় আরও অধিকসংখ্যক মানসম্পন্ন হোটেল-মোটেল নির্মাণ, সুন্দরবনের হিরণ পয়েন্টসহ কয়েকটি পয়েন্ট ঘুরে দেখার সুবন্দোবস্ত থাকা। সড়কপথের উন্নয়ন, নৌপথে চলাচল করতে মিনি জাহাজের রুট সৃষ্টি করা। পর্যটকদের প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা বিধানের ব্যবস্থা করা। প্রাকৃতিক সপ্তাশ্চর্যের বন ক্যাটাগরিতে প্রথম স্থানের জন্য সুন্দরবনের লড়াই এখনও চলছে। এটি টিকে গেলে বহির্বিশ্বে এ বন সম্পর্কে পর্যটকদের আকর্ষণ বাড়বে। টিকে না গেলেও লড়াইয়ে থাকা নামের কারণে ভ্রমণের সুযোগ সৃষ্টি করা হলে এ থেকে আয় হতে পারে বহু বিদেশি মুদ্রা। এ অঞ্চল কাটিয়ে উঠতে পারে দারিদ্র্য।
উপকূলকে ঘিরে বনাঞ্চল গড়ে তোলা, পর্যাপ্ত সাইক্লোন শেল্টার নির্মাণ, দুর্যোগ থেকে আমাদের অনেকটা বাঁচাতে পারে এটা সত্য, তবে সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা গ্রহণ এবং দারিদ্র্য কাটিয়ে ওঠার দ্রুত ব্যবস্থা না নিতে পারলে আমরা মরার আগেই মরে যেতে পারি। সেই সকরুণ অবস্থা থেকে মুক্তি চাই। বাঁচতে চাই সবাই মিলে। ঘন ঘন প্রাকৃতিক দুর্যোগ উপকূলবাসীকে প্রতিনিয়ত জীবন-মৃত্যুর সম্মুখীন করে; লণ্ডভণ্ড করে দিয়ে যায় সবকিছু। তবুও মানুষ বাঁচে আশায়; আগামী দিনের পথচলার সম্ভাবনাকে সঙ্গে নিয়ে। নতুন দিক উন্মোচন করতে হবে নতুন চেতনা নিয়ে। জীবন-সংগ্রামে জয়ী হতে হবে জয়ের পথ ধরে।
মসিদবাড়ী সড়ক, পিরোজপুর
 

No comments

Powered by Blogger.