নদীভাঙন-চিলমারী নদীবন্দর: শত বছরের হাহাকার by নাহিদ নলেজ

ছোটবেলায় আমরা সবাই বর্ষাকাল নিয়ে লিখেছি পরীক্ষার খাতায়। এখন সব প্রচারমাধ্যমে বর্ষাকাল বন্যাকাল হিসেবে পরিচিত। চেয়ারম্যান-মেম্বারদের কণ্ঠে ত্রাণের আহাজারিও আমরা শুনছি। আরেক দিকে নদ-নদীর ব্যাপক ভাঙন, যেন নদ-নদী আমাদের শত্রু—কেন এই বৈপরীত্য?


অনেকগুলো প্রশ্নের মুখোমুখি আমরা। যে বাংলাদেশে সবাই জানত—বর্ষাকাল এলেই যেহেতু বানের পানি চলে আসে, সেহেতু শুষ্ক মৌসুমে বাড়িভিটা উঁচু করা হতো, যাতায়াতের জন্য প্রতি বাড়িতে ছোট ছোট নৌকা থাকত; সেই বাংলাদেশে বর্ষাকালে এই আহাজারি কেন? বিপর্যস্ত কেন যোগাযোগব্যবস্থা? যে নদ-নদীগুলো হাজার হাজার বছরধরে বর্ষার পানি ধারণ করতে সক্ষম ছিল ব্যাপক মাত্রার ভাঙন ছাড়াই, সেই পরিস্থিতির কেন বদল ঘটল?
আমি চলতি ভাঙনের সময় চিলমারী নদীবন্দরে দাঁড়িয়ে লোকজনের মুখে ব্রহ্মপুত্রের সঙ্গে কথা বলতে শুনেছি। এমনকি গণকমিটির ভাঙনবিরোধী মানববন্ধন ও গণমিছিল করার পর লোকজনকে বলতে শুনেছি—ব্রহ্মপুত্র নাকি খেপে গেছে। অর্থাৎ জনগণ এখনো নদ-নদীকে এমন কাউকে মনে করে; যে মন খারাপ করতে পারে, খুশি হতে পারে অর্থাৎ জীবন্ত সত্তা। কিন্তু আমাদের সমাজব্যবস্থা শুধু উৎপাদন সম্পর্কের মধ্যেই বদল ঘটায়নি, প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের মধ্যেও বদল ঘটিয়েছে; যার মধ্যে এসব বৈপরীত্যের শিকড় আমরা খুঁজে পাই।

২.
নদীবিজ্ঞানীরা যে ব্যাপারটি এই ভাঙনের কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন, তা হচ্ছে ব্রহ্মপুত্রের মতো নদগুলোয় বরফগলা পানি ও পাহাড়ি ঢল যখন নেমে আসে, তখন যদি শুধু পানিই নেমে আসত, তাহলে এই নদ দিনের পর দিন শুধু গভীর হতো, বন্যার প্রকোপ এ রকম বাড়ত না। কিন্তু তা হয় না। যেটা হয়, সেটা হচ্ছে বরফগলা পানি ও পাহাড়ি ঢলের সঙ্গে নেমে আসে পাথর, নুড়ি, বালু, মাটিসহ নানা রকম খনিজ পদার্থ। এসব বস্তুর কোনোটা পানির দ্রবণীয় ক্ষমতা ও ভরবেগের কারণে অধিক ঘন বস্তু ঢালের পাদদেশে আটকে যায়, তলদেশ ভরাট করে আর কিছু বস্তু পানির সঙ্গে মিশে সাগর পর্যন্ত পৌঁছে জোয়ারের বাধায় নতুন ভূমি সৃষ্টি করে। অর্থাৎ তলদেশ ভরাট হয়ে যাওয়ায় নদ-নদীর পানি ধারণক্ষমতা কমে যায়, প্রবাহপথে বাধা সৃষ্টি করে বন্যা ও ভাঙন যমজ বোনের মতো একসঙ্গে চলতে থাকে।
অন্যদিকে বন্যার পানির উচ্চতা যত বাড়তে থাকে, ভূগর্ভস্থ পানির উচ্চতাও বাড়তে থাকে, ফলে পানির ঊর্ধ্বমুখী চাপ মাটিকে আলগা করে ফেলে। এর ফলেও নদ-নদীর পানি যখন কমতে থাকে, তখন ভাঙনের তীব্রতা আরও বাড়তে থাকে।
ইতিহাসবিজ্ঞান এই বিশ্লেষণকে সঠিক বলে রায় দেয়। আসামের বনভূমি কেটে যখন চা-বাগান করা হলো, অর্থাৎ ইংরেজসৃষ্ট ভূমিধস যখন শুরু হলো, ফলাফল হিসেবে একমাত্র খাতের ব্রহ্মপুত্র কয়েকটি খাতে বইতে শুরু করল অর্থাৎ চরপ্রধান নদে পরিণত হলো। বন্যা ও ভাঙন কালীরূপ নিয়ে হাজির হলো।
এদিকে ১৯৫৪-৫৫ সালে পর পর ভয়াবহ বন্যার কারণে পাকিস্তান সরকার আমেরিকান বিশেষজ্ঞ ক্রগকে বাংলাদেশের বন্যা-সমস্যার সমাধানের দায়িত্ব দেয়, যা ‘ক্রগ মিশন’ নামে পরিচিত। ফলাফল হিসেবে ইপি ওয়াপদা ও পানি উন্নয়ন বোর্ড প্রায় ৩ দশমিক ৬ মিলিয়ন একর এলাকা বাঁধ দিয়ে ঘিরে দিয়েছে। ব্রহ্মপুত্র ও যমুনার নদীর পশ্চিম পাড়ে দশমিক ৫৮ মিলিয়ন একর জমিতে পানি ঢোকা সম্পূর্ণ বন্ধ করেছে। এবং সর্বমোট ৪ দশমিক ১৮ মিলিয়ন একরে পানি ঢুকতে সম্পূর্ণ বাধা পায়। ফলে চরাঞ্চলের চেয়ে লোকালয় নিচু হয়েছে এবং নদীভাঙনের হার কয়েক গুণ বেড়ে গেছে। আর বর্ষাকাল মানেই বাঁধ ভেঙে লোকালয়ে ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয় আর ত্রাণসংস্কৃতির রমরমা ব্যবসা। বিদেশি উদাহরণ হলো—এ রকম বাঁধ দেওয়ায় হোয়াংহো উপত্যকার চীনারা আজও বন্যার ভয়াবহতা থেকে রেহাই পায়নি। ইয়াংসির বাঁধ উঁচু হতে হতে ১০০ ফুট ছাড়িয়েছে।

৩.
‘ব্রহ্মপুত্র মহাভাগো শান্তনু কুলনন্দন’—মন্ত্রটির মধ্যে যেমন আমরা ব্রহ্মপুত্রের সঙ্গে চীনা সাংপো নদীর সংযোগের সন্ধান পাই, তেমনি পূর্ববঙ্গের ‘গুয়া’ থেকে আসামের রাজধানী গুয়াহাটির নামকরণ এবং গুয়া থেকে সুপারি নামে পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে খ্রিষ্টপূর্ব ৩০০ অব্দ থেকে ৭০০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত পূর্ব বাংলার সঙ্গে আরব বণিকদের সম্পর্ক, ব্যবসা-বাণিজ্যের ইতিহাস সামনে চলে আসে, সেই সঙ্গে চলে আসে চিলমারী নদীবন্দরের নাম। কারণ আসাম থেকে বা বাংলাদেশ থেকে যে জাহাজগুলো আসাম-বাংলাদেশে যাতায়াত করত, সেগুলো চিলমারী বন্দর হয়েই চলত। চিলমারী নদীবন্দর ভৌগোলিক কারণেই আসাম-পূর্ব বাংলার দরজা হিসেবে বিখ্যাত। ভারত ভাগের কারণে এ বন্দরটি তার গুরুত্ব হারায়। সম্প্রতি ভুটানের রাষ্ট্রদূত এই বন্দর পরিদর্শন করেছেন আমদানি-রপ্তানির সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের জন্য। কারণ, নৌপথই হচ্ছে সস্তা ও সুলভ।
কিন্তু আমাদের রাষ্ট্রনেতাদের কী নির্মম ভূমিকা—যে ব্রহ্মপুত্র বাংলাদেশে প্রবাহিত জলের ৪৯ শতাংশ ধারণ করে চিলমারী বন্দর হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে, সেই বন্দরটি প্রতিবছর ব্যাপক ভাঙনের শিকার হয়, সেই বন্দরে নাব্যতার ঘাটতির অজুহাতে ফেরি যোগাযোগ বন্ধ রাখা হয়েছে, সেই বন্দরের এক নারী দুর্ভিক্ষের কালে বাসন্তী নাম নিয়ে ইত্তেফাক-এর পাতায় ক্ষুধা ও দারিদ্র্যের চিহ্ন হয়ে ওঠে। বর্ষাকাল এলেই ভাঙনের শব্দে যেখানে শুরু হয় ত্রাণের রাজনীতি ও ভিক্ষার সংস্কৃতি।

৪.
তাহলে ভাঙন, ভয়াবহ বন্যা ও মঙ্গার হাত থেকে এই অঞ্চলকে উদ্ধারের উপায় কী হতে পারে, এটা নিয়ে মানুষ ও প্রকৃতিবিচ্ছিন্ন নানা মুনি নানা মত দিয়েছেন। ফলে চিলমারীসহ উত্তরাঞ্চল পরীক্ষা ও মুনাফার ক্ষেত্র হয়ে উঠলেও ভাঙন, বন্যা ও মঙ্গা—এই তিনের হাত থেকে রেহাই মেলেনি। কিন্তু সহজ হিসাব, যে কারণে এই বর্ধিষ্ণু অঞ্চলটি মঙ্গা অঞ্চলে পরিণত হলো, সেই কারণের মধ্যেই নিহিত আছে সমাধান। হয়তো কেউ এটা বোঝেনি অথবা বুঝতে চায়নি। সেটা হচ্ছে নিয়মিত ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে খাতবহুল ব্রহ্মপুত্রকে একটি মাত্র খাতে প্রবাহিত করা, যার বাড়তি পাওনা হিসেবে অপসারিত পলি থেকে নতুন আবাদি ভূমি জেগে উঠবে, ব্রহ্মপুত্রের ধারণক্ষমতা বেড়ে গিয়ে বন্যা ও ভাঙন দুই-ই সহনীয় মাত্রায় চলে আসবে। আর নাব্যতা ফেরত পাওয়া এই নদে যদি চিলমারী বন্দরকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা যায়, তাহলে এই অঞ্চলে সমৃদ্ধির নতুন বাস্তবতা স্বাভাবিকভাবেই দেখা দেবে। মঙ্গা সত্য সত্যই মঙ্গলে যাবে।
নাহিদ নলেজ: সমন্বয়ক, গণকমিটি, কুড়িগ্রাম।
nahiduttar@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.