ফতোয়া নিয়ে মাইলফলক রায় by মুফতি মুতীউর রাহমান

ধর্মীয় বিষয়ে ফতোয়া দেওয়া যাবে। যথাযথ শিক্ষিত ও অভিজ্ঞ ব্যক্তিরা ফতোয়া দিতে পারবেন। তবে কাউকে তা মানতে বাধ্য করা যাবে না। শারীরিক ও মানসিক কোনো ধরনের শাস্তিও দেওয়া যাবে না। প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হকের নেতৃত্বে ছয় বিচারপতির পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে ১২ মে ২০১১ সালে এ রায় দেন।


রায়ে বলা হয়, হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে করা দুটি আপিল সংখ্যাগরিষ্ঠ মতামতের ভিত্তিতে আংশিক মঞ্জুর করা হলো। শুধু যথাযথ শিক্ষিত, যোগ্য ব্যক্তিরাই কেবল ধর্মীয় বিষয়ে ফতোয়া দিতে পারবেন। এটা ব্যক্তির স্বেচ্ছায় গ্রহণের ওপর নির্ভরশীল। এ ক্ষেত্রে কোনো ধরনের প্রভাব বা বলপ্রয়োগ করা যাবে না। রাষ্ট্রের প্রচলিত আইনে ব্যক্তির সাংবিধানিক অধিকার ও মর্যাদা ক্ষুণ্ন করে এমন কোনো ফতোয়া দেওয়া যাবে না। গ্রাম্য সালিশ, গ্রাম্য মোড়ল-মাতবররা বিভিন্ন সময় দোররা মারার ঘটনায় ফতোয়া দেশজুড়ে আলোচনার বিষয়বস্তুতে পরিণত হয়েছে। এ ধরনের সমাজপতি, গ্রাম্য সালিশ ও মোড়ল-মাতবরদের অনধিকার চর্চার কারণে বরাবরই দুর্নাম হয়েছে দেশের আলেম, ওলামা ও মুফতিদের। অথচ বাস্তবে ফতোয়া দেওয়া আর বিচার করার মধ্যে তালগোল পাকিয়ে ফেলার কারণেই বারবার বিব্রতকর পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে।
ইসলামের বিধান হচ্ছে বিচার করা, কোনো দণ্ড কার্যকর করার অধিকার একমাত্র দেশের বিচার বিভাগেরই রয়েছে। আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়াকে ইসলাম কখনও সমর্থন করে না। একজন যোগ্য মুফতির দায়িত্ব ও কর্তব্য হচ্ছে, তার কাছে কেউ কোনো বিষয়ে শরিয়তের বিধান জানতে এলে তাকে তা জানিয়ে দেওয়া_ এতটুকুই। এর চেয়ে অগ্রসর হয়ে কারও ওপর শরিয়তের কোনো বিধান চাপিয়ে দেওয়া, কোনো দণ্ড কার্যকর করার অধিকার কোনো মুফতির নেই। সেটা দেখবেন বিচারকরা, বিচার বিভাগের কাজ সেটা।
ফতোয়া দেওয়া একটি পবিত্র গুরুদায়িত্ব। এর জন্য ফিকাহ হাদিস তথা ইসলামের গভীর জ্ঞান প্রয়োজন। স্বীকৃতিও প্রয়োজন। প্রত্যেক সরকারেরই কর্তব্য হচ্ছে, যোগ্য ও বিজ্ঞ মুফতিদের খুঁজে বের করে তাদের ফতোয়া দেওয়ার স্বীকৃতি দেওয়া। অযোগ্যদের ফতোয়া দিতে নিষেধ করে দেওয়া। এ প্রসঙ্গে খতিব বাগদাদি (রহ.) তদীয় 'আলফকিস্ফহ ওয়াল মুতাফাকিস্ফহ' গ্রন্থে উল্লেখ করেন_ রাষ্ট্রপ্রধানের কর্তব্য হচ্ছে তার যুগের মুফতিদের খোঁজখবর নেওয়া। বাস্তবে যারা ফতোয়া দেওয়ার যোগ্য তাদের ফতোয়া দেওয়ার দায়িত্ব বহাল রাখা, স্বীকৃতি দেওয়া। আর অযোগ্যদের ফতোয়া দিতে নিষেধ করা। ভবিষ্যতে আর কখনও ফতোয়া দিলে যে তাদের কঠোর শাস্তি পেতে হবে এ ব্যাপারে সতর্ক, সাবধান করে দেওয়া। তদুপরি যদি সে আবারও ফতোয়া দেয় তাহলে তার বিরুদ্ধে কঠোর আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া। এ ক্ষেত্রে সরকার দেশের শীর্ষ, বরেণ্য, নির্ভরযোগ্য ও বিজ্ঞ ওলামায়ে কেরাম ও মুফতিদের বোর্ড গঠন করে তাদের যোগ্য ও বিজ্ঞ মুফতিদের তালিকা প্রণয়নে সরকারকে সহায়তা করার জন্য অনুরোধ করতে পারেন। নির্ভরযোগ্য ওলামায়ে কেরাম যোগ্য মুফতিদের যে তালিকা তৈরি করে দেবেন সরকার কেবল তাদেরই ফতোয়া দেওয়ার অনুমতি দেবে, অন্যদের ফতোয়া দিতে নিষেধ করবে। আমাদের দেশে সরকার যদি এ পদক্ষেপ আরও আগেই নিত তাহলে ওলামায়ে কেরাম ও মুফতি সমাজ সরকারকে এ নির্দেশনা আরও আগেই দিত, তাহলে যেখানে-সেখানে দোররা মারার ঘটনা ঘটত না। দেশের সচেতন আলেম সমাজ যদি গ্রাম্য মোড়ল, মাতবর ও সমাজপতিদের অনধিকার চর্চার বিরুদ্ধে যথাসময়ে সোচ্চার হতো, সরকারকে সতর্ক করত তাহলে হয়তো ফতোয়াকে কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হতো না।
দেশের সর্বোচ্চ আদালতের আপিল বিভাগের রায়ে ফতোয়ার বৈধতা অবশ্যই দেশের ইতিহাসে একটি মাইলফলক। একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। এ রায়ের মাধ্যমে ধর্মপ্রাণ মানুষের ধর্মীয় আবেগ ও অনুভূতির যথাযোগ্য সম্মান প্রদর্শন করা হয়েছে। আমাদের রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক জীবনে এ রায় অবশ্যই কাঙ্ক্ষিত ইতিবাচক অবদান রাখবে। তবে ভবিষ্যতে কোনো সুযোগসন্ধানী মহল যেন এ রায়ের অপপ্রয়োগ করতে না পারে। আর কখনও যেন কোনো কুচক্রীমহল ফতোয়াকে বিশ্ব দরবারে কুৎসিত ও কদর্য করতে না পারে সে জন্য আমাদের সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে। অন্যথায় এ রায়ের সুফল থেকে আমরা বঞ্চিতই থেকে যাব। এ দেশের আলেম সমাজের কর্তব্য, ফতোয়ার প্রকৃত পরিচয়, তাৎপর্য, মর্যাদা, গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা জনগণের সামনে তুলে ধরা এবং তথাকথিত গ্রাম্য সালিশে মাতবর, মোড়ল ও সমাজপতিদের নগ্ন অনধিকার চর্চা, দোররা মারা যে ফতোয়া নয় তা দেশের মানুষকে বোঝানো। এ কর্তব্য আলেম সমাজকে নিজেদের মর্যাদা রক্ষার জন্যই পালন করতে হবে।
 

No comments

Powered by Blogger.