ঝলমলে পূর্ণিমা by শফিক আল মামুন

বর্ষার আকাশ—এই মেঘ, এই বৃষ্টি। সবে বৃষ্টি শেষ হয়েছে। চারপাশ আলো-অন্ধকারের লুকোচুরি। কিন্তু নিকুঞ্জ আবাসিক এলাকায় পূর্ণিমার বাড়ির দোতলার ঘরটি আলো-কোজ্জ্বল! সাজানো-গোছানো ঘরটির চারপাশ কাজের স্বীকৃতির আলোয় ভরপুর।


জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার, মেরিল প্রথম আলো পুরস্কারসহ নানান স্বীকৃতির পদক ঘিরে রেখেছে ঘরটি। সবই পূর্ণিমার অভিনয়জীবনের প্রাপ্তি। এসব নিয়েই ভাবি। তখনো মেলে না দেখা তাঁর। একসময় তিনি এলেন। বসলেন মুখোমুখি। কিছু বলার আগেই উল্টো প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন, ‘কী কী জানতে চান?’
প্রশ্ন করে নিজেই হাসতে হাসতে শেষ! ‘আমি তো দেখছি নিজেই সাংবাদিকের মতো আপনাকে প্রশ্ন করে বসলাম!’
আমিও হাসলাম। বেশ সহজ হয়ে গেল পরিবেশটা। কথা না বাড়িয়ে প্রশ্ন করলাম, ‘চলচ্চিত্রে কত বছর হলো?’
ডানে-বাঁয়ে একটু মাথা ঝাঁকিয়ে ভাবলেন কিছুক্ষণ। তারপর বললেন ‘১৯৯৭ থেকে ২০১২ সাল—১৫ বছর।’
চলচ্চিত্রে এই দীর্ঘ ১৫ বছর পার করলেন পূর্ণিমা। পেছনে ফিরে তাকালে কী দেখা যায়?
নিচের দিকে তাকিয়ে একটু গম্ভীর হলেন। তারপর মাথা তুললেন। বললেন, এই দীর্ঘ সময়ে ভালো-খারাপ দুটো দিকই আমি দেখেছি। চলচ্চিত্রে কাজের বিনিময়ে আজ পূর্ণিমা হতে পেরেছি। এ জন্য এ অঙ্গনের মানুষ, দর্শকের কাছে আমি কৃতজ্ঞ। আর খারাপ দিকটা হলো, আমার নিজের খামখেয়ালির কারণে অনেক ভালো ভালো কাজ ছেড়ে দিয়েছি।’
‘সেটা কেমন?’
‘বলছি। কাজ শুরু হয়েছে। পরিচালক কিংবা প্রযোজকের কথাবার্তা আমার ভালো লাগেনি, তখনই কাজ বন্ধ করে অগ্রিম নেওয়া টাকা ফেরত দিয়ে ছবি ছেড়ে দিয়েছি। এমন অনেকবারই হয়েছে।’
চলচ্চিত্রের কক্ষপথে অভিনেত্রী পূর্ণিমাও পূর্ণিমার আলোর মতো জ্বলজ্বল! কী এর রহস্য?
‘জ্বলজ্বল কি না জানি না, তবে বলতে পারি, অশ্লীলতার জোয়ারের সময় আমি স্রোতে গা ভাসিয়ে দিইনি। ভালো চলচ্চিত্রে কাজ করতে চেয়েছি, করেছিও। এখনো করছি। দর্শকেরা তা গ্রহণ করেছেন।’ এভাবেই বললেন তিনি।
পূর্ণিমার কথা আর কাজ মিলে যায়। তাঁর অভিনীত এ জীবন তোমার আমার, মনের মাঝে তুমি, হূদয়ের কথা, আকাশ ছোঁয়া ভালোবাসা, শুভা, শাস্তির মতো অসংখ্য চলচ্চিত্র দেখার জন্য দর্শকও প্রেক্ষাগৃহে গিয়ে ভিড় করেছে।
অভিনয়জীবনে স্বীকৃতিও পেয়েছেন। ওই তো ও ঘর থেকে উঁকি দিচ্ছে মেরিল-প্রথম আলো পুরস্কার, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। তিন-তিনবার পেয়েছেন মেরিল-প্রথম আলো পুরস্কার। মনোনয়ন পেয়েছেন আরও বেশি। সর্বশেষ ওরা আমাকে ভালো হতে দিল না ছবির জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারও ঘরে তুলেছেন।
স্বীকৃতি নিয়ে পূর্ণিমা কী বলেন?
‘আমি যে ভালো কাজ করলাম বা করেছি তার স্বীকৃতি এগুলো। সংখ্যায় বেশি না করেও কম কাজ, ভালো কাজ করে সম্মান, স্বীকৃতি নিয়ে টিকে থাকা যায়। তবে এ জায়গায় পৌঁছানো অতটা সহজ না। অনেকটাই স্বার্থপরের মতো।’
‘কেন?’ দ্রুতই প্রশ্ন করি।
‘আজ চলচ্চিত্রের অনেকেই হয়তো বলেন, পূর্ণিমাকে আমরা তৈরি করেছি। কিন্তু জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পাওয়ার পর যাদের কাছ থেকে অভিনন্দন পাব বলে আশা করেছিলাম, তাদের কাছ থেকে পাইনি। আবার টানা দু-তিনটি ছবি হিট—তাঁরাই আমাকে মাথায় করে রাখবেন। কোনো কারণে একটা ছবি ব্যবসাসফল না হলে সব দোষ পূর্ণিমার। এই বুঝি পূর্ণিমার দিন শেষ—চলচ্চিত্রের মানুষগুলোর কাছে বিষয়টি এমন। তবে ভালো কাজ করলে দর্শক আমাকে মনে রাখবেন। এটাই আমি বিশ্বাস করি।’ টানা বলে গেলেন তিনি।
সেই ধারাবাহিকতায় ভালো কাজ হিসেবে ছায়া-ছবি চলচ্চিত্রের কথাও তিনি বললেন। সম্প্রতি শেষ হয়েছে মুহাম্মদ মোস্তফা কামাল রাজ পরিচালিত চলচ্চিত্রটির শুটিং। ছবিটি নিয়ে তিনি বেশ আশাবাদী। ‘আমার দীর্ঘ চলচ্চিত্র জীবনে যতগুলো ছবিতে কাজ করেছি তা থেকে এ ছবিটি পুরো ভিন্ন। গল্প, গান থেকে শুরু করে পোশাক-আশাক। টিমওয়ার্কও ছিল অসাধারণ। মনের মাঝে তুমি ছবিটির এক অংশ হায়দরাবাদে শুটিং হয়েছিল। ওই সময় যেমনটা দেখেছি, শুটিং টিমের সবাই ছিলেন খুবই গোছানো এবং আন্তরিক, ছায়া-ছবির শুটিংয়ের সময়ও মনে হয়েছে আমি সে রকমই একটি শক্তিশালী টিমের সঙ্গে কাজ করছি।’ বললেন পূর্ণিমা।
কথার ফাঁকে ফাঁকে চোখ থেকে সাদা ফ্রেমের চশমা খুলে বারবার চোখ দুটো কচলাচ্ছিলেন। চোখে, মুখে বেশ দুর্বলতার ছাপ। বর্তমান কী নিয়ে ব্যস্ত?—এক ফাঁকে প্রশ্ন করি।
পূর্ণিমা বললেন, ‘চ্যানেল আইয়ের একটা অনুষ্ঠানে বিচারকের কাজ করছি। কক্সবাজারে ছিলাম। রাত ১২টা থেকে শুরু করে ভোর ছয়টা পর্যন্ত কাজ করতে হয়েছে। দু-তিন দিন ঘুমই হয়নি। ঢাকায় ফিরেই জ্বর। এখনো ঘুম-ঘুমভাব কাটেনি।’
হ্যাঁ, পূর্ণিমার আলো চলচ্চিত্র থেকে শুরু করে ছোট পর্দা, বিজ্ঞাপনে ছড়িয়েছে। এবার সেই আলোয় যোগ হয়েছে বিচারক পূর্ণিমা। এটি নতুন পরিচয়। প্রথমবারের মতো বিচারকের আসনে তিনি। চ্যানেল আই সেরা নাচিয়ে অনুষ্ঠানের বিচারকমণ্ডলীর একজন। কীভাবে যুক্ত হলেন এখানে? আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞাসা করি। পূর্ণিমা বললেন, ‘আমি এখানে আসতে চাইনি। কারণ, নাচের লোকজন এটা নিয়ে প্রশ্ন তুলবেন। ছোটবেলায় শিশু একাডেমীতে এক বছর নাচ শিখেছি। আর চলচ্চিত্রে কাজের সুবাদে যা শিখেছি, অভিজ্ঞতা এতটুকুই। কিন্তু চ্যানেল আই থেকে খুব জোরাজুরি করতে লাগল। তা ছাড়া দেখলাম যে এটা শুধু ক্লাসিক্যাল নাচ না, সব ধরনের নাচের প্রতিযোগিতা। এ জন্য রাজি হয়ে গেলাম।’
সময় গড়িয়ে যায়, নামে সন্ধ্যা। বাইরের আকাশে মেঘের ঘনঘটা। ঘন হয়েছে আঁধার। কিন্তু পূর্ণিমার আকাশে মেঘ নেই, সেই আকাশ এখনো ঝলমলে।

No comments

Powered by Blogger.