চলতি পথে-মাহিলারা সরকার মঠ by দীপংকর চন্দ

সকাল থেকেই বিষণ্নতার মোড়কে আবৃত ছিল প্রকৃতি। আকাশে ঘন কৃষ্ণবর্ণ মেঘ ছিল বহুবিচিত্র আকারের। নীরব, নিথর, শোকাবনত ছিল তারা, যেন সংকীর্ণ সময়ের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় জড়ো হয়েছে সবাই। এমন নিস্তরঙ্গ প্রহরে স্বাভাবিকভাবেই সাংসারিক ভাবনাগুলো পথভ্রষ্ট হয়, কক্ষচ্যুত হয় বুদ্ধিসর্বস্ব চিন্তাচেতনার জোরালো যুক্তিগুলো।


মনের অতলান্তিক অনুভবে কেন্দ্রীভূত হয় অপরাহত আবেগ। সেই আবেগে আক্রান্ত হই আমরা। ঘোরগ্রস্ত মানুষের মতো উঠে দাঁড়াই। বরিশালগামী বাসটি গৌরনদী অতিক্রম করে মাহিলারা বাজারে থামে স্বল্প সময়ের জন্য। আমরা নামি সেখানেই। শরীরের জড়তা কাটানোর লক্ষ্যে পথের পাশের টং দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে ধূমায়িত চায়ের পেয়ালা তুলে নিই হাতে। ঠোঁটে ছোঁয়াই। ঠোঁটের ছোট ছোট স্পর্শে একসময় ফুরিয়ে আসে চা এবং তারপর মহাসড়ক ধরে হাঁটতে হাঁটতে সামনে এগোই আমরা।
মহাসড়কের দুই পাশে সংখ্যাতীত মেহগনি আর কড়ইগাছ। সেই গাছগুলোর সবুজ-সতেজ পাতার ফাঁকে ফাঁকে ঘুরে বেড়ায় অন্যমনস্ক বাতাস। মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই মহাসড়কের বাঁ দিকে একটা শাখাপথ উদয় হয়। সেই পথে প্রবেশ করি এবার। শ্লথ পায়ে হাঁটতে থাকি। হাঁটতে হাঁটতে দেয়ালঘেরা একটা বাড়ি দেখি। দেখি একটা বিশাল পুকুর। সবুজাভ জলের সেই পুকুরের কাছেই দক্ষিণে খানিকটা কাত হয়ে থাকা একটি প্রাচীন মঠ। বরিশাল জেলার গৌরনদী উপজেলার মাহিলারা ইউনিয়ন ও বাটাজোর ইউনিয়নের সীমান্তরেখায় অবস্থিত এ মঠটিকে মাহিলারা সরকার মঠ নামেই চেনে সবাই।
মাহিলারা সরকার মঠ এলাকায় লাল-হলুদ রঙের তোরণ একটা। তোরণের পার্শ্বস্তম্ভ দুটিতেই বেশ বড় হরফে উৎকীর্ণ ‘জয়গুরু’ শব্দবন্ধটি। ১৪১১ বঙ্গাব্দের ৯ বৈশাখে নির্মিত তোরণটি অতিক্রম করে মঠ এলাকায় প্রবেশ করি আমরা। ভেতরে বেশ কয়েকটি স্থাপনার অসামঞ্জস্যপূর্ণ সহাবস্থান। খুঁটি আর টিন নির্মিত একটি দুর্গামণ্ডপ। একটি ভক্তাবাস। স্থাপনাগুলোতে চকিত দৃষ্টিপাত করে আরও সামনে এগোই আমরা। মাহিলারা মঠের নান্দনিক নির্মাণশৈলী উদ্ভাসিত হয় দৃষ্টিপ্রত্যক্ষে।
অষ্টকোনাকার মাহিলারা মঠটির উচ্চতা ভূমি থেকে প্রায় ২৭ মিটার। মঠের পশ্চিম দেয়ালে রয়েছে একটি খিলানযুক্ত প্রবেশপথ। সেই প্রবেশপথের ওপর বেশ কিছু অংশে মনোমুগ্ধকর অলংকরণ। ঠিক একই ধরনের অলংকরণ মঠের অন্যান্য দিকেও দৃশ্যমান। মঠটির চারপাশ ঘুরে দেখলাম আমরা। দেখতে দেখতে পরিচয় হলো স্থানীয় বাসিন্দা বাবুলাল দাসের সঙ্গে। পঞ্চাশোর্ধ্ব এ মানুষটি পানের বরজে কাজ করেন। তিনি আমাদের জানালেন, মঠটির আকৃতি কিংবা রং আদিতে এমন ছিল না। বর্তমানে মঠটিকে যেমন দেখছি আমরা, তা অন্ততপক্ষে চারবার সংস্কারের ফল। শিখর মন্দির শিল্পের অপূর্ব নিদর্শন এ মঠটি নির্মিত হয় ১৭৩৭ সালে। নির্মাতা সরকার রূমরাম দাসগুপ্ত নামের একজন প্রভাবশালী স্থানীয় বাসিন্দা। ব্রিটিশ আমলে প্রথমবার সংস্কার করা হয় এটি। দ্বিতীয়বার সংস্কার সাধিত হয় পাকিস্তান আমলে এবং তৃতীয়বার সংস্কার হয় বাংলাদেশ আমলে ১৯৯৬ সালে, যখন প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ গ্রহণ করে মঠটির রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব।
মাহিলারা সরকার মঠটির নিম্নাংশে বর্গাকার একটি কক্ষ। কক্ষটি ব্যবহূত হয় পূজার্চনার কাজে। প্রধান পূজারি মহারাজ শ্রীমৎ দয়াময় চৈতন্য ব্রহ্মচারীর অনুপস্থিতি সত্ত্বেও উন্মোচিত হলো কক্ষের প্রবেশপথের কাঠের দরজা।
দরজা অতিক্রম করে কক্ষের ভেতর প্রবেশ করলাম আমরা। স্বল্প পরিসর সেই কক্ষের অভ্যন্তরে ছোট্ট একটি বেদি। অনুচ্চ সেই বেদির ওপর রাধাকৃষ্ণের যুগলমূর্তি প্রতিষ্ঠিত। সুদৃশ্য সেই যুগলমূর্তির দুই পাশে গৌরানন্দ ও নিত্যানন্দের বিগ্রহ। এ ছাড়া রয়েছে সিমেন্টে ঢালাই করা শিবলিঙ্গ, মঙ্গলঘট, মাটির প্রদীপ, হাঁড়ি। কক্ষের অভ্যন্তরে চোখ বুলিয়ে আমরা আবার ফিরে আসি বাইরের পৃথিবীতে। আবার দৃষ্টি স্থাপন করি মঠটির বহিরঙ্গে। দক্ষিণে অনেকটাই বাঁকা মঠটি। অনেকটাই হেলানো, যেন ভিত্তিসহ উপড়ে পড়তে উদ্যত মাটির ওপর। ইতালির বিখ্যাত হেলানো মিনারের কথা মনে হয় আমাদের। মাহিলারা মঠটির নির্মাণশৈলীতেই কি হেলে থাকার রহস্য প্রোথিত? বাবুলাল দাস অবশ্য সন্দিহান এ বিষয়ে। তাঁর মতে, মাহিলারা মঠের দক্ষিণে বৃহদায়তন পুকুরটিই মঠের হেলে থাকার নেপথ্যে ক্রিয়াশীল। স্থানীয় কয়েকজন প্রভাবশালী মানুষের মৎস্য চাষজাতীয় কর্মকাণ্ডে সৃষ্ট জলজ আঘাতে ক্ষয়ে যাচ্ছে মঠসংলগ্ন পুকুরটির তলার মাটি। তাই দক্ষিণে অবস্থিত পুকুরের দিকেই দিনে দিনে হেলে পড়ছে মঠটি। এ বিষয়ে অবিলম্বে দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন। অনন্যসুন্দর এই পুরাকীর্তিটি অক্ষত অবস্থায় রাখতে হলে প্রয়োজন প্রত্নতাত্ত্বিক অধিদপ্তরের যথাযথ পদক্ষেপও। কিন্তু সেটি কি সম্ভব আদৌ? দীর্ঘশ্বাস নেমে আসে আমাদের বুক চিরে। নেতিবাচক নানা চিন্তা ঘুরেফিরেই উদয় হয় মনে। অথচ আমরা যে প্রাণপণে আঁকড়ে ধরতে চাই ইতিবাচক চিন্তাগুলোকেই—আমৃত্যু।
দীপংকর চন্দ

No comments

Powered by Blogger.