চরাচর-ফকিরাপুল by এস কবির

আমাদের প্রিয় শহর ঢাকার অনেক বিষয়ই আছে, যেগুলোর নামকরণ হয়েছে বিশেষ বিশেষ কারণে। শাঁখারি পট্টি, কাপ্তানবাজার, কারওয়ান বাজার- এসবের নাম হওয়ার পেছনে একটা করে ঘটনা বা কারণ আছে। যেমন আজকের প্রজন্মের কাউকে মতিঝিলের নাম কেন মতিঝিল- এটা বোঝানো সহজ নয়।


এখানে এই কিছুদিন আগেও একটা বিশাল ঝিল ছিল, তা এখন ইতিহাস। এই ঝিলসংলগ্ন জলাশয় রমনা পার্কের ভেতরে এবং ধানমণ্ডি লেক হয়ে বিচ্ছিন্নভাবে টিকে আছে। আর এই মতিঝিলের কথার সঙ্গে সঙ্গে চলে আসে ফকিরাপুলের কথা।
মতিঝিল তখন বিস্তৃত ছিল অনেক দূর পর্যন্ত। কমলাপুরের ভেতর দিয়ে এসে নটর ডেম কলেজের পেছন দিয়ে আরামবাগ, ফকিরাপুল ঘেঁষে চলে গিয়েছিল সেগুনবাগিচার দিকে। সেটা অবশ্য সেখানেই থামেনি। একসময় সেটা যুক্ত ছিল রমনা লেকের সঙ্গে। আর সেখান থেকে সেটা চলে গিয়েছিল হাতিরপুলের ভেতর দিয়ে কাঁঠালবাগান আর কলাবাগান ঘেঁষে বর্তমানের ধানমণ্ডি লেক পর্যন্ত। তারপর সেটা ধানমণ্ডি পার হয়ে চলে যায় ঢাকার সীমানায়। সে সময় শাহজাহানপুর, কমলাপুর, বাসাবো- এসব এলাকার লোকজনকে পার হতে হতো মতিঝিল। তখন এটা পার হওয়ার একমাত্র বাহন ছিল নৌকা। লোকালয় এবং বাজার হিসেবে ফকিরাপুল এলাকা তখন সদ্য গড়ে উঠেছে। আজকের যে রাজউক রোড, প্রথমে সেটা ছিল ডিআইটি রোড। তখনো সে রাস্তা হয়নি। ঝিলের ওপর দিয়ে সে রাস্তা হয় অনেক পরে। তখন বাজারের পাশ দিয়ে যে লোকালয় ছিল মানুষজন তার ভেতর দিয়ে গিয়ে হাজির হতো ঝিলের পাড়ে। সেখানে ঘাট ছিল নৌকার। নৌকায় যাওয়া যেত ওই পারে।
এলাকার প্রবীণ লোকদের সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, সেই নৌকাঘাটে এক ফকির বসে ভিক্ষা করত। ঝিল পার হওয়া লোকজনের কাছ থেকে সারা দিন চেয়েচিন্তে যা পাওয়া যেত তা-ই দিয়ে তার দিন চলত। নানা কারণে নৌকায় পার হওয়া নিয়ে সমস্যা হতো মানুষের। সেই ফকির একদিন চিন্তা করে এর বিকল্প কিছু করার। নৌকাঘাটসংলগ্ন ছিল কিছু কাঠের দোকান। সে সেসব দোকান থেকে ফেলে দেওয়া কিছু কাঠ জোগাড় করে। তারপর বাঁশ আর কাঠ দিয়ে বানিয়ে ফেলে একটা পুল। মানুষ সেই পুল দিয়ে পার হতে গেলে তাদের কাছ থেকে সে পয়সা নিত। লোকজন দেখে যে এখন তাদের পার হতে অনেক সুবিধা। আগের মতো নৌকার জন্য অনেক সময় ধরে বসে থাকতে হয় না। আর একটা লোক ভিক্ষা ছেড়ে আয়ের পথ বের করেছে, সেটাও বড় একটা বিষয়। সবাই তাকে খুশি মনেই পয়সা দিয়ে ঝিল পার হয়ে যেত। পরবর্তী সময়ে অবশ্য নগর কর্তৃপক্ষ পারাপারের জন্য একটা ভালো কাঠের পুল বানায়। কিন্তু তত দিনে অনেক সময় পার হয়ে গেছে। পুলটা ফকিরের পুল হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। শুধু তা-ই নয়, এলাকার বাজারের নামও হয়ে গেল ফকিরের পুল বাজার। আর পরে যখন লোকালয় বেড়ে অনেক বড় হলো, তখন সেটার নাম হলো ফকিরাপুল। আজ যেমন সেই ঝিলটাও নেই, সেই সঙ্গে হারিয়ে গেছে ফকিরের পুলটাও; কিন্তু রয়ে গেছে সেই নামটা।
এস কবির

No comments

Powered by Blogger.