পাখির নাম ঘাড়ব্যথা by আ ন ম আমিনুর রহমান

গত জানুয়ারির প্রথম নাগাদ এক দুপুরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন ভবন থেকে ফিরছি। অনুষদের কাছাকাছি আসতেই বাদামি-ধূসর একটি পাখি চোখে পড়ল পাশের আমলকী বাগানের দিকে উড়ে যেতে। ক্যামেরাটা সঙ্গেই ছিল, দূর থেকেই দুটো ‘ক্লিক’। ভিউ ফাইন্ডারে দেখে মনে হলো বাদামি কসাইয়ের বাচ্চা।


তেমন একটা গুরুত্ব দিলাম না। দুদিন পর পাখিটিকে আবার দেখলাম বেশ কাছ থেকে। এটা মোটেও বাদামি কসাইয়ের বাচ্চা নয়। সম্পূর্ণ আলাদা এক প্রজাতির পাখি।
এই পাখিদের রয়েছে অদ্ভুত অভিনয় ক্ষমতা, যা দিয়ে মানুষকে বোকা বানিয়ে নিজেকে রক্ষা করতে পারে সহজেই। এমনিতে এরা মাঠে বা গাছের পচা ডালে পোকামাকড় খুঁজে বেড়ায়। কদাচ কোনো মানুষ নাগালে চলে এলে ঘাড়ের পালক ফুলিয়ে, চোখ উল্টিয়ে ঘাড়-মাথা প্রায় ১৮০ ডিগ্রি কোণে ঘোরাতে থকে, মাঝে মাঝে লেজ নাড়ায় ও মাটিতে শুয়ে পড়ে। দেখে যে-কেউ ভাববে, পাখিটির ঘাড় ব্যথায় টনটন করছে ও সে মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে। এই অবস্থায় তাকে বাঁচানোর জন্য হাতে তুলে নিলেও চুপচাপ অসুস্থতার অভিনয় করে যাবে। লোকটি হয়তো ভাববে, ‘বেচারা অসহায় পাখি, বোধহয় আর বাঁচবে না। কী করা যায়?’ ভাবতে ভাবতে যেই না কিছুটা অন্যমনস্ক হবে, সেই সুযোগে পাখিটি হঠাৎ করেই তিরবেগে উড়ে চম্পট দেবে।
অদ্ভুত এই পাখিটির নাম ইউরেশীয় রাইনেক বা ‘রাইনেক’। পাখিটির কোনো বাংলা নাম না থাকায় ‘ইউরেশীয় ঘাড়বাঁকা’ বা ‘ঘাড়ব্যথা’ নামে ডাকা হয়। এরা কাঠঠোকরা-জাতীয় পাখি। তবে কাঠঠোকরাদের মতো ঠোঁট ছুরির ফলার মতো নয়, বরং তা আকারে ছোট। খাবারের জন্য বেশির ভাগ সময় মাটিতেই কাটায় বলে ‘মেঠো কাঠঠোকরা’ নামেও পরিচিত। বৈজ্ঞানিক নাম Jinx torquilla।
ঘাড়ব্যথা বাদামি-ধূসর পাখি। লম্বায় ১৯ সেন্টিমিটার। লেজ তুলনামূলকভাবে লম্বা। দেহের ওপরটা ধূসর। নিচটা হলদে ডোরাযুক্ত। পেটের দিকটায় কখনো-সখনো লালচে আভা দেখা যায়। একটি কালো দাগ চোখ-গাল হয়ে ঘাড়ের পেছন দিকে চলে গেছে। বাদামি ডানার ওপর কালো, হলদে ও ধূসর ফোঁটা এবং ডোরা। হলদে গলা ও বুকে কালো ডোরা। পেটে কালো রেখা। পা খাটো। ঠোঁট, পা ও পায়ের নালা বাদামি। পুরুষ ও স্ত্রী দেখতে একই রকম হলেও পুরুষগুলো যেন বেশি চকচকে।
ঘাড়ব্যথা বিরল প্রজাতির পরিযায়ী পাখি। সুদূর সাইবেরিয়া ও চীন থেকে লম্বা পথ পাড়ি দিয়ে শীতে এ দেশে আসে ও বসন্তে চলে যায়। শীতকালে প্রধানত সিলেট, চট্টগ্রাম, ঢাকা ও খুলনা বিভাগের গ্রামীণ এলাকায় দেখা যায়। গ্রীষ্মকালে খোলা ঝোপঝাড়, মাঠ ও কৃষিজমির ধারেকাছে এবং শীতকালে বাগান ও কৃষি খামারের আশপাশে থাকতে পছন্দ করে। একাকী বা জোড়ায় ঘুরে বেড়ায়। শুষ্ক মাটি বা পিঁপড়ার ঢিবিতে বসে বা লাফিয়ে লাফিয়ে খাবার সংগ্রহ করে। পছন্দের খাদ্য তালিকায় রয়েছে পিঁপড়া, পিঁপড়ার ডিম ও বাচ্চা এবং গুবরেপোকা। ভয় পেলে বুক ঠেকিয়ে মাটির সঙ্গে লেপটে থাকে। দেহের রঙ সহজেই এদের মাটির সঙ্গে মিলেমিশে যেতে সাহায্য করে। এ সময় সুযোগ পেলে আশপাশের ঝোপঝাড়ে আশ্রয় নেয়। ভয় কেটে গেলে ফের মাঠে আসে। সাধারণত চিঁউ-চিঁউ-চিঁউ-চিঁউ স্বরে ডাকে।
মে-জুলাই প্রজননকাল। এ সময় তির-তির-তির-তির স্বরে ডাকে। কোনো ছোট গাছের খোঁড়লে বাসা বানায়। সচরাচর কাঠঠোকরার পরিত্যক্ত বাসা ব্যবহার করে। বাসায় কেউ উৎপাত করলে সাপের মতো মাথাটিকে ঘুরিয়ে হিস-হিস শব্দ করে উৎপাতকারীকে ভয় দেখায়। এদের ডিমের রং সাদা।

No comments

Powered by Blogger.