সরেজমিন-মাদকের এক জমজমাট হাটে পুলিশের 'মানিব্যাগ অভিযান' by তোফাজ্জল হোসেন রুবেল

রবিবার সন্ধ্যা আনুমানিক ৬টা। রাজধানীর পল্লবী থানার টহল পুলিশের একটি গাড়ি এসে থামে মিরপুর ৬ নম্বর ঝিলপাড় বস্তির সামনে। আগে থেকে অদূরে দাঁড়িয়ে ছিল রূপনগর থানার পুলিশের আরেকটি টহল গাড়ি। পথচারীসহ আশপাশের লোকজন ধরে নেয়, স্থানীয় মাদক স্পট হিসেবে চিহ্নিত ঝিলপাড় বস্তিতে পুলিশের কোনো বিশেষ


অভিযানের প্রস্তুতি চলছে। কিন্তু বাস্তবে ঘটল উল্টোটা। কয়েকজন পুলিশ সদস্য গাড়ি থেকে নেমে বস্তিতে ঢুকে কয়েক মিনিটের মধ্যেই বের হয়ে এলেন। পরে বস্তির কয়েকজনের কাছ থেকে জানা গেল, মাদক ব্যবসায়ী নয়, ক্রেতারাই ছিল পুলিশের টার্গেট। বলা ভালো, ক্রেতারাও নয়, লক্ষ্য তাদের মানিব্যাগ। বস্তিবাসী জানায়, পুলিশ ভেতরে ঢুকে কয়েকজনকে ধরে একপাশে দাঁড় করায়। তারপর মানিব্যাগ কেড়ে নিয়ে চলে যায়। এই 'মানিব্যাগ অভিযান' প্রতিদিন কম করে হলেও চারবার চলে বলে তথ্য দেয় প্রত্যক্ষদর্শীরা।
এই প্রতিবেদক টানা কয়েক দিন ওই বস্তি এলাকায় গিয়ে বস্তির বাসিন্দা ও মাদকসেবীদের সঙ্গে কথা বলে অভিযোগ পান, প্রতিদিনই এ স্পটকে ঘিরে কয়েকটি স্থানে চলে রূপনগর আর পল্লবী থানার পুলিশের এই মানিব্যাগ বাণিজ্য। সরেজমিন ঘুরে ও এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সকাল থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত বস্তির কয়েকটি স্থানে টহল পুলিশ দাঁড়িয়ে থাকে। আর ভেতরে ছড়িয়ে থাকে পুলিশের কয়েকজন সোর্স। কেউ সেবন শেষ করে বস্তি থেকে বের হতে গেলেই সোর্সরা তাদের ধরে ধারেকাছে থাকা পুলিশ সদস্যদের কাছে নিয়ে যায়। গ্রেপ্তারের ভয় দেখিয়ে আদায় করা হয় মোটা অঙ্কের টাকা। এই মাদক সেবনকারীদের অধিকাংশই রিকশা ও বাস বা ট্রাকচালক এবং নিম্ন আয়ের লোক। ফলে নগদ যা পাওয়া যায়, সেটা নিয়েই ছেড়ে দেওয়া হয়।
গত রবিবার সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বস্তির চলন্তিকা মোড়, ৭ নম্বর মোড়, আরামবাগ ঢাল ও রূপনগর রজনীগন্ধা মার্কেটের গলিতে পুলিশের কয়েকজনকে এভাবে বসে থাকতে দেখা যায়। আগারগাঁও এলাকা থেকে আসা শহিদ ও রুবেল নামের দুই যুবক জানান, তাঁরা মাদক সেবন করে ফেরার পথে পুলিশ তাঁদের আটক করে দুজনেরই মানিব্যাগ কেড়ে নিয়ে ছেড়ে দিয়েছে। দুজনের মানিব্যাগে ৫০০ টাকার মতো ছিল।
শহিদ ও রুবেল আরো জানান, পুলিশের এই অভিযানের কথা তাঁরা জানেন এবং এ কারণেই মানিব্যাগে কম টাকা রাখেন। টাকা না থাকলে পুলিশ তাঁদের গ্রেপ্তার করবে, এই কারণে পরিমাণে কম হলেও কিছু টাকা রাখতে হয়।
এর আগে গত শুক্রবারও এই প্রতিবেদক সরেজমিনে অনুসন্ধান চালান এই বস্তিতে। সময় তখন আনুমানিক সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা। পল্লবী থানার একটি পিকআপ ভ্যান (ঢাকা মেট্রো ঠ-০২-১৭১৫) এসে থামে চলন্তিকা মোড়ে 'মা স্যানিটারি' দোকানের সামনে। মুহূর্তেই একজনের দেহ তল্লাশি করে গাঁজা পায় পুলিশ। পরে জানা যায়, ভ্যানে উঠিয়ে মিরপুর ১১ নম্বর ইয়ানথাই চায়নিজের সামনে নিয়ে পুলিশ ওই ব্যক্তিকে ছেড়ে দেয়। এই অভিযানে নেতৃত্ব দেন পল্লবী থানার এএসআই হাছান। রাত ৯টার দিকে এএসআই হাছান আবার আসেন। এক যুবক (সম্ভবত সোর্স) কিছু টাকা দেয় তাঁর হাতে। ভ্যানে বসেই পুলিশ সদস্যরা সেই টাকা ভাগ-বাটোয়ারা করে নেন। এ সময় সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে এএসআই হাছানের সঙ্গে কথা বলতে গেলে ভ্যানসহ দ্রুত কেটে পড়েন তিনি।
আসিফ নামে মিরপুর ৭ নম্বর সেকশনের এক বাসিন্দা বলেন, কয়েক দিন আগে রাসেল ও মাসুম নামে তাঁর দুই নিকটাত্মীয়কে আটক করে পুলিশ। ফোন পেয়ে ১১ নম্বর বাংলা স্কুলের সামনে গিয়ে দেখেন, তাঁদের পুলিশ ভ্যানে বসিয়ে রাখা হয়েছে। অভিযোগ, তাঁদের কাছে নাকি দুই পুরিয়া গাঁজা পাওয়া গেছে। আসিফ বলেন, 'পরে পুলিশের দাবি অনুযায়ী দুই হাজার টাকার বিনিময়ে তাদের ছাড়িয়ে আনি। পরে আটককৃতদের কাছ থেকে জানতে পারি, টাকা না দিতে পারলে পুলিশ তাদের মানিব্যাগ ও মোবাইল নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করেছিল।'
গত রবিবার সকাল ১১টায় ঝিলপাড় বস্তিতে ঢুকতেই দেখা যায় কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে মাদক বিক্রি করছে নেতা ধরনের একজন। তাকে ঘিরে রেখেছে আরো কয়েকজন খুচরা বিক্রেতা। বস্তির প্রবেশপথে থাকা দোকানির কাছ থেকে জানা যায়, এই নেতার নাম নজরুল ইসলাম নজু। সে মাদক বিক্রেতাদের নেতা। নজু আর তার ঘনিষ্ঠ সহযোগী আসাদ পুরো বস্তির নেতৃত্ব দেয়। আসাদ নিজেকে সরকারদলীয় লোক হিসেবে পরিচয় দেয়।
আওলাদ নামের একজন বস্তি বাসিন্দা জানান, নজরুল ইসলাম নজু দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে এই ব্যবসা চালিয়ে আসছে। সরকারদলীয় স্থানীয় ওয়ার্ড ও মহানগর পর্যায়ের কয়েকজন নেতাও এই বস্তি থেকে নজু ও আসাদের মাধ্যমে মাসোয়ারা নেন বলে আওলাদ অভিযোগ করেন।
সন্ধ্যার দিকে এক মহিলা প্রকাশ্যে বস্তির ভেতর ঘুরে ঘুরে মাদক বিক্রি করছিল। জানা যায়, তার নাম বাপ্পী রানী। স্থানীয় সন্ত্রাসী গালকাটা বাবুর স্ত্রী এই বাপ্পী। বাপ্পীর বাসা পল্লবী থানা এলাকার সাত নম্বর সেকশনে। সে এলাকায় রিকশায় ঘুরে ঘুরেও মাদক বিক্রি করে।
এ ব্যাপারে পল্লবী থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) আব্দুল লতিফ শেখ বলেন, তাঁরা মাদকের ব্যাপারে কাজ করে যাচ্ছেন। ঝিলপাড় মাদক স্পটে পুলিশের অভিযানের নামে অর্থ বাণিজ্যের ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বিষয়টি কৌশলে এড়িয়ে যান।
এ সময় উপস্থিত আরেকজন পুলিশ সদস্য বলেন, এটাও এক ধরনের শাস্তি। মানিব্যাগ কেড়ে নিলে তারা মাদক সেবন বন্ধ করে দেবে। বিক্রেতাদের কেন ধরা হয় না জানতে চাইলে এই পুলিশ সদস্য বলেন, ওরা স্থানীয় এবং ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত। ওদের ধরলে নানান ঝামেলা আছে। তা ছাড়া ক্রেতা না এলে এমনিতেই ওদের বাণিজ্য বন্ধ হয়ে যাবে। এ কারণেই তাঁরা ক্রেতাদের ওপর বেশি জোর দেন।
স্থানীয় সূত্র মতে, পল্লবী ৪ নম্বর রোডের ৭ নম্বর সেকশনের নার্গিস এলাকার সবচেয়ে বড় ইয়াবা ট্যাবলেটের ডিলার। তার কাছ থেকে খুচরা বিক্রেতারা ইয়াবা সংগ্রহ করে মহল্লায় ঘুরে ঘুরে বিক্রি করে। পুলিশের টহল টিমের লোকজন প্রতিদিন সোর্সের মাধ্যমে তার কাছ থেকে টাকা নিয়ে থাকে।
নবনির্মিত রূপনগর থানা কমপ্লেক্সের পাশে আরেক মাদক ব্যবসায়ী নাজমার বাসা। ঝিলপাড় বস্তির সবচেয়ে বড় গাঁজা ও হেরোইন বিক্রেতা সে। স্থানীয় সূত্র মতে, নাজমা দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে এলাকায় তার প্রভাব খাটিয়ে মাদক ব্যবসা করে যাচ্ছে।
পুলিশ সূত্র জানায়, গত ১৪ এপ্রিল রূপনগর থানা স্থাপিত হওয়ার পর গত আড়াই মাসে মাদকের মামলা হয়েছে ৬০টি। এর মধ্যে এপ্রিলে ১৩টি, মে মাসে ২৩টি, জুনে ১৪টি। কিন্তু কোনো মামলায়ই উল্লেখযোগ্য কোনো মাদক ব্যবসায়ীর নাম নেই বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়।
এই অবাধ মাদক বাণিজ্যের ব্যাপারে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের ঢাকা সার্কেলের উপপরিচালক আলী আসলাম হোসেন বলেন, ঝিলপাড় বস্তির মাদক বিক্রেতাদের ব্যাপারে তাঁরা অবগত আছেন। এই স্পটে শিগগিরই অভিযান চালানো হবে।
এ ব্যাপারে ডিএমপির মিরপুর জোনের পুলিশের উপকমিশনার ইমতিয়াজ আহম্মেদ বলেন, 'এই এলাকায় মাদক বিক্রির বিষয় তাঁদের নজরে রয়েছে। প্রায়ই অভিযান চালিয়ে যাচ্ছি। তবে বড় হোতাদের কাছে উপস্থিত মাদক না পাওয়ায় তাদের আটক করা সম্ভব হচ্ছে না।'
মানিব্যাগ বাণিজ্য বা শুধু ক্রেতাদের ধরার ব্যাপারে উপকমিশনার আরো বলেন, মানিব্যাগ নেওয়া হয়, সেটা ঠিক নয়। তবে ক্রেতাদের বেশি ধরা হচ্ছে, সেটা ঠিক। এটা তাঁদের একটা নতুন একটি কৌশল। প্রতিদিন এভাবে আটক করতে থাকলে তারা আর এ স্পটে আসবে না।
পুলিশের এই মানিব্যাগ বাণিজ্যের ব্যাপারে রূপনগর থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) শিকদার মো. শামিম হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, তাঁর কাছে এ ধরনের কোনো অভিযোগ নেই। মাদক বিক্রেতাদের না ধরে শুধু ক্রেতাদের ধরে পুলিশ এই ধরনের বাণিজ্য করছে কেন জানতে চাইলে ওসি বলেন, বড় মাদক বিক্রেতা বলতে এখানে তেমন কাউকে পাওয়া যায় না। তবে সম্প্রতি পাইকারি মাদক বিক্রেতা নজরুল ইসলাম নজুর ডান হাত বা একান্ত সহযোগী বাবু ও মুসলিম নামের দুজনকে আটক করা হয়েছে। তাঁর থানা এলাকায় প্রতিষ্ঠিত কোনো মাদক স্পট নেই দাবি করে তিনি বলেন, বিচ্ছিন্ন কিছু জায়গায় ভাসমান প্রক্রিয়ায় মাদক বিক্রি হয়।
এলাকাবাসী বলে, মাদক স্পটের মাঝখানে এই রূপনগর থানা হওয়ার পর অনেকে ভেবেছিলেন, এবার বুঝি মাদক ব্যবসা কমবে। কিন্তু আগের চেয়ে আরো বেপরোয়া হয়েছে মাদক ব্যবসা। রশিদুল নামের স্থানীয় এক বাসিন্দা কালের কণ্ঠকে জানান, মাঝেমধ্যে পুলিশের লোক এসে বস্তির পাশের চলন্তিকা ক্লাব মোড়ে মাদক বিক্রেতাদের সঙ্গেই আড্ডা দেয়।

No comments

Powered by Blogger.